তৃতীয় ক্রুসেড
মুসলমানদের বিজয়ের খবর সারা ইউরোপে চরম উদ্বেগের সৃষ্টি করে। কারণ তাদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম মুসলমানদের হাতে চলে যাওয়া ক্রুসেডারদের জন্য মৃত্যু যন্ত্রণার মত ছিলো। এই খবরে পোপ ৩য় আর্বান হার্ট এটাক করে মারা যান। প্রতিশোধ নিতে পোপ ৭ম গ্রেগোরি পালটা ক্রুসেড নিয়ে যাওয়ার আহবান করেন। ফলে তৃতীয় ক্রুসেডের আয়োজন শুরু হয়। এবার পুরো ইউরোপ এতে যোগ দেয়। বিখ্যাত জার্মান সম্রাট ফ্রেডারিক বারবারোসা, ফ্রান্সের সম্রাট ফিলিপ অগাস্টাস এবং ইংল্যাণ্ডর রাজা রিচার্ড স্বয়ং এই যুদ্ধে অংশ নেন। একারণে তৃতীয় ক্রুসেডটি কিংস ক্রুসেড নামেও পরিচিত।
ইউরোপের তিন রাজার বিরাট এক যৌথ বাহিনী জেরুজালেমের দিকে যাত্রা করেন। ১১৯১ সালের এপ্রিল মাসে সুবিশাল এই বাহিনী রওনা হয়ে প্রথমে আক্রা বন্দর অবরোধ করে। সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী এই বন্দর রক্ষার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। কিন্তু ইউরোপ থেকে ক্রুসেডারদের কাছে লাগাতার যুদ্ধের রসদ আসতে থাকে।
সালাহউদ্দিনের বাহিনী এবং তৃতীয় ক্রুসেডের মধ্যে প্রথম এবং একমাত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৭ সেপ্টেম্বর, ১১৯১ সালে। মুসলিম বাহিনীর প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে দশ হাজার ক্রুসেডার সৈন্য নিহত হওয়া সত্ত্বেও তারা অবরোধ বহাল রাখে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী কোনো ইসলামী রাষ্ট্র সালাহ উদ্দিনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ফলে নিরুপায় হয়ে তিনি আক্রা থেকে পিছিয়ে যান।
সালাহ উদ্দিন শহরবাসীর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিতে শহরটি ক্রুসেডারদের হাতে ছেড়ে দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। সেই মতে মুসলমানরা দুই লাখ স্বর্ণমূদ্রা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ পরিশোধ করতে সম্মত হয়। একই সাথে পাচ শতাধিক খৃস্টান বন্দীকে ফেরত দেয়ার শর্ত মেনে নিয়ে শহরের মুসলমানরা অস্ত্র ফেলে দেয়।
কিন্তু রিচার্ড প্রথমেই সেখানে যুদ্ধাপরাধ করেন। আক্রা শহর অবরোধ করার সময় তার হাতে দুই হাজার সাতশো মুসলিম সৈন্য ধরা পড়লে তিনি মুক্তি পণের বিনিময়ে ফেরত দিতে রাজি হন। কিন্তু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে খানিক দেরি হলে তিনি সকল সৈন্যদেরে সারিবদ্ধ করে শিরচ্ছেদ করেন।
এরপর ক্রুসেডাররা আসকালান বন্দরের দিকে অগ্রসর হয়। আসকালান পৌঁছানোর পথে সালাহ উদ্দিনের বাহিনীর সাথে ক্রুসেডারদের খন্ড খন্ড লড়াই হয়। কিন্তু রসদ সল্পতার কারণে সালাহ উদ্দিন পিছু হটেন এবং নিজেই আসকালান শহর ধ্বংস করে দেন। ক্রুসেডাররা যখন সেখানে পৌছায় তখন সেখানে ইটের স্তুপ ছাড়া কিছুই পায়নি।
রিচার্ড উপকূলে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং দক্ষিণে আসকালান সুরক্ষিত করেন। এরই মধ্যে সালাহ উদ্দিন বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষার সব আয়োজন সম্পন্ন করলেন। কারণ তিনি জানতেন ক্রুসেডারদের টার্গেট ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। রিচার্ড তৎকালীন সময়কার সবচেয়ে ভারী অস্ত্র ও কামান সহ প্রায় ১৭,০০০ সৈন্য নিয়ে অভিযানে বের হন। গন্তব্যস্থলে পৌছালে তার সাথে সিভিলিয়ান হয়ে থাকা ও পলাতক ক্রুসেডাররা যোগ দেন। তাছাড়া সেই অঞ্চলের খৃষ্টান সৈন্য যারা আগে বল্ডউইন ও লুসিগনানের অধীনে ছিল তারাও সংঘবদ্ধ হন। অপরদিকে সালাউদ্দীনের সৈন্য সংখ্যা দিন দিন কমে আসছিল। কেননা তার লোকজন ছিল নানান অঞ্চল থেকে যুদ্ধ করতে আসা কৃষিজীবী মানুষ যারা পরিবার পরিজন ও ক্ষেত খামার রেখে বছরের পর বছর লেগে থাকার মত অবস্থানে ছিল না।
রিচার্ড আক্রা, জাফা, কেসারিয়া এবং টায়ার শহর গুলোতে মুসলমানদের পরাজিত করে নিজ দখলে নেন। দু-একটি শহরে চলমান তুমুল যুদ্ধে কখনও এই পক্ষ বা কখনও সেই পক্ষ বিজয় লাভ করতে থাকে। এর মধ্যে পবিত্র ভূমিতে পৌঁছানোর আগে ১০ জুন ১১৯০ তারিখে একটি নদী পার হওয়ার সময় ফ্রেডারিক মারা যান। তার মৃত্যু জার্মান ক্রুসেডারদের মধ্যে প্রচণ্ড শোকের সৃষ্টি করে এবং তার বেশিরভাগ সৈন্যই দেশে ফিরে আসে।
তুমুল যুদ্ধের পর ১১৯২ সালে রিচার্ড উল্লেখিত শহর গুলোতে তিনি নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখেন এবং বায়তুল মুকাদ্দাস আক্রমণ না করেই ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন আসেন। রিচার্ড তখন আহত ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি জেরুজালেম জয় করতে পারবেন বলে মনে করেননি অথবা বিজয় করলেও তা ধরে রাখতে পারবেন বলে নিশ্চিত ছিলেন না।
পরবর্তী বছর দামেস্ক শহরে সালাহ উদ্দিনের মৃত্যু হয়, ১১৯৩ সালের ৪ঠা মার্চ। তিনি মৃত্যুর আগে সব সম্পত্তি গরিব দুঃখীদের দান করে গিয়েছিলেন। মাত্র এক স্বর্ণমুদ্রা ও চল্লিশ রৌপ্যমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই ছিল না তার কাছে। তার দাফনের টাকাটাও ছিল না। দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাইরের বাগানে তাকে দাফন করা হয়।
ক্রুসেডদের অনুশোচনা ছিল যে রিচার্ড যদি কোন রকমে আরও একটি বৎসর থেকে যেতে পারতেন তবে সালাহ উদ্দীনের মৃত্যুতে তার উত্তরাধিকার নিয়ে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয় তার সুযোগে জেরুজালেম জয় করা যেত এবং হয়ত বিজয় আসত।