একবার একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল, নাম ছিল পাখিরপুর। সেখানে ছিল এক মেয়ে, তার নাম ছিল আঁচল। আঁচল ছিল একদম সাধারণ, কিন্তু তার মধ্যে এক বিশেষ ধরনের গুণ ছিল—সে যখন কিছু ভাবত, তখন সেই ভাবনা বাস্তবে পরিণত হতে শুরু করত।
কিন্তু আঁচল এই গুণটি জানত না, যতটা জানত না, ততটাই ভয় পেত। সে কখনো তার মনে যা ভাবত, সেটা অন্যদের শোনাত না, কারণ সে জানত না, যদি তার ভাবনা সত্যি হয়ে ওঠে? আর যদি কোনো খারাপ কিছু ঘটে?
একদিন আঁচল এক জাদুকরী বৃদ্ধার সাথে দেখা পেল। বৃদ্ধা বলল, "তুমি এমন একটি গুণ পেয়েছ, যা পৃথিবীতে কেউ পায়নি। তুমি যদি চাও, তুমি নিজের মনে যা ভাববে, তা পৃথিবীকে রূপান্তরিত করতে পারবে। কিন্তু সাবধান! ভাবনা শুধু তোমার নয়, পৃথিবীর সকল মানুষেরও হতে পারে। তাই তোমার মনে যদি কোনো খারাপ কিছু আসে, তবে তা তোমার পৃথিবীও নষ্ট করতে পারে।"
এ কথা শুনে আঁচল আরো ভয় পেয়ে গেল। সে জানত, তার মনে অনেক কিছু আসে, কিন্তু তার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা কখনো সে অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে চাইত না। অন্ধকার, একাকীত্ব, দুঃখের মত বিষয়গুলো। তাই সে এই ক্ষমতাকে সবসময় চাপা রাখতে শুরু করল।
তবে একদিন, গ্রামের মধ্যে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। পাখিরপুরে এক অজানা রোগ ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামবাসীরা একে একে অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। আঁচল জানত, তার এই ভয়াবহ ক্ষমতা যদি কিভাবে কাজে আসে, তাহলে হয়তো এই রোগ প্রতিরোধ করা যাবে। কিন্তু তার মন দ্বিধায় ছিল। সে জানত, যদি কোনো ভুলভাবে কিছু ভেবে ফেলেন, তাহলে রোগটা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
তবে তার মধ্যে একটা অদৃশ্য শক্তি জেগে উঠল। আঁচল সিদ্ধান্ত নিল, সে সেই রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, এবং নিজেকে বিশ্বাস করতে শুরু করল। সে তার মনের মধ্যে স্থির হয়ে ভাবল, "এই রোগ আমাদের গ্রামকে শেষ করতে পারবে না। আমি চাই, এই রোগ অদৃশ্য হয়ে যাক।"
আঁচলের ভাবনা মুহূর্তে সত্যি হয়ে উঠল। রোগটি একে একে পুরো গ্রাম থেকে চলে গেল। গ্রামবাসীরা আঁচলকে অনেক সম্মান দিল, তবে আঁচল জানত, সে কোনো অদৃশ্য শক্তির সাথে খেলেছে।
তবে ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। আঁচলের ক্ষমতা দিন দিন আরো শক্তিশালী হয়ে উঠল। সে একদিন ভাবল, "আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর। কিন্তু পৃথিবীটা খুব বড়, খুব অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি চাই পৃথিবী সব মানুষের জন্য সুন্দর হোক, শান্তিপূর্ণ হোক।"
এবার আঁচল তার চিন্তাটিকে শক্তিশালী করে তোলে। পৃথিবী বদলে গেল। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল, সমুদ্র শান্ত হয়ে গেল, মানুষের মন শান্তি ও সুখে পূর্ণ হয়ে গেল। তবে আঁচল বুঝতে পারল যে, শুধু পৃথিবী নয়, তার এই ক্ষমতা সবকিছু পরিবর্তন করতে পারে। তার মনে যা আসত, তা বিশ্বে কোনো না কোনো প্রভাব ফেলত।
এই ক্ষমতা নিয়ে আঁচল আরও অনেক সময় কাটাল, কিন্তু একদিন সে বুঝল যে, যত বেশি সে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে, তত বেশি তার নিজের ইচ্ছেগুলো পরিবর্তন হয়ে যায়। সে আর কোনো কিছু চিন্তা করার আগে আগে কিছু পরিবর্তিত হয়ে যায়। তখন সে জানতে পারে যে, তার মনে যা আসে, তা নিজের থেকেই সৃষ্টি হয়ে যায়, এবং তাকে কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
এবং একদিন, আঁচল নিজেই পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে ছিল এমন একটি মানুষ, যে কখনো তার ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল, কিন্তু সে জানত, কোনো একটি সীমানা ছাড়িয়ে গেলে, পরিবর্তন সবসময় আমাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। সবার মনে থাকে তার গল্প, যে একটি ছোট্ট মেয়ে, যিনি পৃথিবী বদলাতে পারতেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই হারিয়ে যান।