পোস্টস

ইন্টারভিউ

বিপর্যস্ত প্রকাশনা খাত চলছে টিকে থাকার সংগ্রাম

৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

লাবণী মণ্ডল

মূল লেখক লাবণী মণ্ডল



বিপর্যস্ত প্রকাশনা খাত
চলছে টিকে থাকার সংগ্রাম
লাবণী মন্ডল

সৃজনশীল মানুষ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার সৃজনশীল, মানসম্পন্ন বই। যা দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি দেশের জনগণের সাংস্কৃতিক মান বোঝা যায় সেখানকার প্রকাশনার মান দেখে। প্রকাশনা শিল্প শুধু মুনাফা কামানোর খাত নয়; বরং এটি জনগোষ্ঠীর মানস গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত। অথচ আমাদের দেশে এ খাতটি বরাবরই অবহেলিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার অভাবে এক সময় বইয়ের দোকানে সরগরম ‘আজিজ মার্কেট’ আজ পরিবর্তিত হয়েছে তৈরি পোশাকের মার্কেটে। এই একটি উদাহরণই বলে দেয় এ সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা স্তিমিত হয়ে পড়ার পেছনে বাজার অর্থনীতির প্রভাব কতখানি। রাষ্ট্র যখন জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করে না, বরং নিরুৎসাহিত করে; শিক্ষাব্যবস্থা যখন হয়ে পড়ে চাকরিকেন্দ্রিক; তখন সৃজনশীল প্রকাশনার পথও হয়ে পড়ে অবরুদ্ধ। এমন এক সময়ে দাঁড়িয়েও যারা সরকার-দলীয় ‘সহযোগিতা’ ছাড়াই প্রকাশনা খাতে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের হাজারো সালাম।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে গোটা বিশ্ব অর্থনীতি ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার প্রণোদনা প্যাকেজও ঘোষণা করেছে। ক্ষতি পুষিয়ে উঠছে কোনো কোনো খাত। তবে বাংলাদেশের প্রকাশনা খাতে যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তা কাটিয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। সরকার বিভিন্ন খাতে ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে; কিন্তু প্রকাশনা খাতকে খাদের কিনারা থেকে তুলে আনতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সরকারি দলের ঘনিষ্ঠতা যাদের রয়েছে, তারা বিভিন্ন পন্থায় প্রকাশনা চালিয়ে গেলেও, যাদের সে ‘সহযোগিতা’ নেই, তাদের কেউ কেউ প্রকাশনা বন্ধ রেখেছেন। আবার কেউবা অন্য কোনো পেশায় জড়িত হতে বাধ্য হয়েছেন। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এ খাতের সঙ্গে জড়িত। যাদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, অথবা আয় কমে গেছে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ। এ খাত সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। যেখানে উঠে আসে তাদের বৈষম্যের কথা, অব্যক্ত কষ্ট ও আর্তনাদ, যা দেখার মতো কেউ হয়তো নেই!

গত এক বছরেই শুধু নয়, কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী সময়েও দেশে মানসম্পন্ন প্রকাশনার অভাব দেখা গেছে। আর এ সময়ে যে প্রকাশকদের রাষ্ট্রীয় বা সরকার-দলীয় কোনো ব্যাকআপ নেই, তাদের প্রকাশনা টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের প্রকাশনা সংস্থা ‘ঘাস ফুল নদী’র প্রকাশক মুনীর মোরশেদ বলেন, “শুরুতেই বলে রাখিÑ ব্যবসায়িক বৈশিষ্ট্য, অবয়ব ও বিনিয়োগকৃত মূলধন অনুযায়ী এ দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি। অবশ্য সাম্প্রতিককালে দুয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় ঝুঁকেছে। তবে তা হিসাবের মধ্যে পড়ে না। শুরু থেকেই রাষ্ট্রের কাছে প্রকাশনা ব্যবসা ‘ট্রেড’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। কারণ, সরকার-রাষ্ট্র মনে করে প্রকাশনার বিকাশ ঘটলে মানুষের জানা-বুঝার দরজা খুলে যাবে। আর ‘যে যত জানে, সে তত কম মানে’। অথচ প্রকাশকরা ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে বৈধভাবে ব্যবসা করে। তারা প্রতি বছর ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন ফি দেয়, ভ্যাট দেয়, ট্যাক্স দেয়; কিন্তু তারা ব্যাংক ঋণ থেকে বঞ্চিত। ব্যাংকের কাছে ঋণ চাইতে গেলে কর্মকর্তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। কেউ কেউ ফিক করে হেসে বলেন, ‘মন্থর ও দুর্বল খাতে ঋণ দেবো, এতটা আহাম্মক আমরা নই।’ আর এত উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে এই অবিকশিত শিল্প লাভের মুখ তো দেখবেই না, বরং মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে। প্রকাশনা শিল্প নিয়ে বেশ কয়েকবছর আগে সরকার একটি নীতিমালা করেছিল বটে; কিন্তু সেটি খসড়া পর্যায়েই থেকে গেছে। এতদিনে হয়তো এটির ঠাঁই হয়েছে ভাগাড়ে। সুতরাং প্রকাশনা ব্যবসা শুরু থেকেই বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে এবং আজও সে ধারা অব্যাহতভাবে চলছে।”

প্রকাশকদের সংগঠিত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রকাশকদের রয়েছে দুটি সংগঠন। একটি বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, অন্যটি বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক পরিষদ। প্রথমটির বেশিরভাগ সদস্য প্রতিষ্ঠানই শিক্ষাবোর্ডের পাঠ্যবই ব্যবসায় যুক্ত। মূলত এটি মুষ্ঠিমেয় কয়েকজনের একটি সিন্ডিকেট। এই কয়েকজনই তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে এটিকে ব্যবহার করে। যখন যে দল সরকার গঠন করে, তখন তারা সেই দল ও সরকারে ভিড়ে যায়। তারা সরকার-রাষ্ট্রের একচেটিয়া আনুকূল্য পায়। সুতরাং সর্বস্বার্থে কাজ করার উদ্দেশ্য তাদের নেই। দ্বিতীয়টির অবস্থাও তথৈবচ। সরকারের কাছে নেতাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বই সরবরাহে অগ্রাধিকার পায়। তারা লবিং করে, চাপ সৃষ্টি করে। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের সর্বোচ্চ আইটেমের বই নির্বাচিত হয়, অনেক আইটেম ক্রয়যোগ্য না হলেও কেনা হয়। অন্যদিকে, ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর সৃজনশীল ভালো বই থাকা সত্ত্বেও তাদের বই নির্বাচিত হয় একটি বড়জোর দুইটি আইটেম।’ 

মুনীর মোরশেদ আরও বলেন, ‘ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রকাশকদের দুই বৃহৎ সংগঠনের নেতৃত্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা যেন প্রকাশকদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করিয়ে নিতে পারে।’ যারা নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়তে চান, তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, “বৃহৎ পুঁজি নিয়ে গড়তে পারলে হয়তো টিকে থাকতে পারবে। আর ক্ষুদ্র পুঁজি হলে টিমটিম করে জ্বলবে। তারপর একসময় নিভে যাবে। তবে শেষকথা বলি, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’।”
পুরানা পল্টনের প্রকাশনা সংস্থা ‘বিপ্লবীদের কথা’র স্বত্বাধিকারী শেখ রফিক বলেন, “স্বাধীনতার শুরু থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো প্রকাশনা সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোকে আমরা আসলে প্রকাশনা বলব কি-না, তা নিয়েই প্রশ্ন আছে! যেমন ধরুন, বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে তিন হাজার পত্রিকা রয়েছে, এর মধ্যে আসলে আমরা কয়টিকে ‘পত্রিকা’ হিসেবে ধরতে পারি! আমাদের দেশে মান যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রকাশনাকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। অর্থাৎ, একটি প্রকাশনার বই কেমন হবে; তার উদ্দেশ্য কি হবে; প্রকাশনা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হবে, না-কি শিল্প হবে; পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডারে তার সংযুক্তির অবদান কেমন হবে; জাতি নির্মাণে তার ভূমিকা কতটুকু থাকবে; সর্বোপরি, মানুষ ও মানবতার জন্য কি ভূমিকা পালন করবেÑ এসব বিষয়বস্তু পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে যে কোনো প্রকাশনা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে পারে। যদিও এর অনেকখানি দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল এই রাষ্ট্রের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের। যেহেতু তারা এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, সেহেতু প্রকাশকদের একাংশ এ কাজটি সম্পন্ন করতে উদ্যোগ নিতে পারত; কিন্তু কোনো পক্ষ থেকেই অর্থবহ কিছু হয়নি, এটিই বাস্তবতা। যে কারণে ব্যাঙের ছাতার মতো, সিএনজি-রিকশার মতো প্রতিদিন প্রকাশনা সংস্থা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। বই বাড়ছে, লেখক বাড়ছে, পাঠক-ক্রেতা বাড়ছে, সেলফি বাড়ছে, ভিডিও বাড়ছেÑ বাড়েনি শুধু জ্ঞানচর্চা। পরিবর্তন হয়নি শুধু দেশের জাতীয় চেতনা ও মূল্যবোধের।”

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে যে কত হাজার প্রকাশনা রয়েছে, তার কোনো হদিস কেউ জানে না। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলা একাডেমি ও সরকারি-বেসরকারি প্রকাশকগোষ্ঠী প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলার আয়োজন করে। এই আয়োজনে তাদের মনগড়া কিছু নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে ৩০০-৩৫০ প্রকাশনাকে বইমেলায় স্থান দেয়। নানা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসব প্রকাশনাকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়া হয়। এ দেশের সাধারণ মানুষ শেষ পর্যন্ত মিডিয়ার কল্যাণে প্রকাশনা বলতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বুঝে থাকে। এর বাইরেও রয়েছে হাজার-হাজার প্রকাশনা।’

প্রকাশনায় বৈষম্যের বিষয়ে শেখ রফিক বলেন, ‘এ ব্যাপারটি আমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে! যেমন ধরুন, আমি কোনো প্রকাশনা সমিতির সঙ্গে নেই। যে কারণে আমাকে সারা বাংলাদেশে যে বইমেলাগুলো হয়, তাতে ডাকা হয় না, অংশগ্রহণ করাও সম্ভব হয় না। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে আমাদের মতো প্রকাশনা আসলে টিকে থাকার সম্ভাবনাই নেই; কিন্তু ওই যে চিন্তার দায়, চেতনার ক্ষরণ! এসব থেকেই আমরা লড়ে যাচ্ছি। গত এক বছরে প্রকাশনা শিল্পের জন্য কোনো প্রণোদনা রাষ্ট্র দেয়নি। এবারের বইমেলার দিকেই তাকিয়ে দেখুন- এটি কোনো বইমেলা! একুশে বইমেলার একটি ইতিহাস, ঐতিহ্য রয়েছে। অথচ এবারের মেলায় তার মূল্যায়ন কোথায়! আমি এবার বইমেলায় অংশগ্রহণ করিনি। এবার বই প্রকাশ করবো কেমন করে? বেঁচে থাকার সংগ্রামেই তো বারবার হেরে যাচ্ছি। যে রাষ্ট্র জ্ঞানের জগতকে গুরুত্ব দেয় না, সে রাষ্ট্রের প্রকাশনারগুলোর অবস্থা এর চেয়ে ভালো হতে পারে কি!’

তিনি আরও বলেন, ‘এর থেকে উত্তরণের উপায় একটাই, তা হলোÑ রাষ্ট্রকে এর দায় নিতে হবে। এ চিত্র সবখানেই বিরাজমান। প্রকাশকদের জানা-বুঝার পরিধি বাড়াতে হবে। বৈষম্যহীন একটি জ্ঞানের জগত তৈরি করতে হবে, যা সম্ভব সমাজের সার্বিক পরিস্থিতি পাল্টানোর মধ্য দিয়ে।’

কথা হয় প্রকাশনা সমিতির সদস্য বাংলাবাজারের এক প্রকাশকের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার নাম ব্যবহার করবেন না, তাহলে যেটুকু সুবিধা পাই, সেটুকু থেকেও বঞ্চিত হব। আমরা মূলত বোর্ড বই ছাপি। অনার্স তৃতীয়, চতুর্থ বর্ষের। এবার এর কোনো চাহিদা নেই। পুস্তক প্রকাশনার সমিতিতে আমাদের মতো প্রকাশকরা বৈষম্যের শিকার হন। কেননা, আমাদের মতো প্রকাশনাগুলো লবিং করতে পারে না। বাজার দখলও করতে পারে না। ঘুরেফিরে নিজেদের যতটুকু চাহিদা, সেটুকুই; কিন্তু এবার তো তাও নয়। এরপর অনলাইন বুক শপ খুলেছি, সেখানেও তেমন কোনো সাড়া নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে বই জোগাড় করে বই বিক্রি করছি। বাংলাবাজারে বড় ধুরন্ধর না হলে টিকে থাকা দায়। আমরা হয়তো ছিটকে যাব। অথচ প্রকাশনা শিল্পে আমাদের টিকে থাকা জরুরি। সিস্টেম আমাদের ছুড়ে ফেলে দেবে। সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বড় বড় প্রকাশকরা লবিং করে যা করার করছে, আমরা চুনোপুটিরা বরাবরের মতোই বঞ্চিত। এটি আরও বেড়েছে করোনাকালীন সময়ে। এ থেকে উত্তরণ হতে হলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সংস্কৃতির মান বাড়াতে হবে। নিজেদের জানা-বুঝার পরিধি বাড়াতে হবে। মানসম্মত প্রকাশনাগুলোর প্রতি সুনজর দিতে হবে। সাংবাদিকরা তো এ সেক্টর নিয়ে কোনো কাজই করে না। মনে করে, এ সেক্টরে কোনো সংকট নেই, লবিং নেই, দালালি নেই। অথচ সব নেতিবাচকতায় পূর্ণ এ সেক্টর।’

কবি, লেখক টোকন ঠাকুর বলেন, ‘প্রকাশনাকে বাস্তবিক অর্থেই শিল্প ধার্য করা দরকার। তাহলে উন্নতি ঘটতে পারে। তবে প্রকাশকরা কেন ঐক্যবদ্ধ হতে পারছে না, এটি আমি জানি না। আমি প্রকাশক নই। তবে স্বার্থেই মানুষ জোটবদ্ধ হয়, স্বার্থেই জোট থেকে বেরিয়ে যায় বা যেখানে ইচ্ছা যায়, বা যায় না। এখানেও তেমনই স্বার্থের বিষয় থাকতে পারে। তবে যে কোনো উত্তরণের পথই তো লড়াই করা। দাবি আদায়ে এর বিকল্প নেই।’

মেসার্স নাবিলা পেপার হাউসের মালিক মো. নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। দেখছেন তো, পুরো দোকানে একা বসে আছিÑ এর থেকেই বুঝে নেনÑ কী অবস্থা! আমাদের দিকে সরকারও তাকায় না, কেউ-ই তাকায় না। প্রকাশকরা বই প্রকাশ করতে না পারলে আমাদের কাগজ বিক্রি হবে কিভাবে? ফকিরাপুলের সবাই ভেবেছিলাম, একটি মিছিল করব; কিন্তু বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আর এগোয়নি।’ ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘সব বন্ধ করে দেবো ভাবছি। বাড়িতে গিয়ে শাক-সবজি চাষ করে কোনোরকমে দিন কাটিয়ে দেবো না হয়! করোনাভাইরাস যে কি ক্ষতি করেছে, তার হিসেব মেলাতে পারব না। অথচ আমাদের এ সেক্টরের দিকে কোনো নজরই নেই কারও। এই সেক্টরকে গুরুত্ব না দিলে এখানকার মানুষও মুখ ফিরিয়ে নেবে। বেঁচে থাকার মতো উপার্জন করতে না পারলে কিভাবে ব্যবসা করবে? আমার বয়স ৫৯। আমি আর কতকাল এই সেক্টরের বৈষম্য দেখব। হয়তো ছেড়েই দেবো এ ব্যবসা।’

ফকিরাপুলের রবিন এন্ড ছোঁয়া বুক বাইন্ডিংয়ের মো. শাহীন বলেন, ‘এ যন্ত্রণা বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের প্রতিষ্ঠান তেমন বড় কোনো বাইন্ডিং কারখানা নয়। বড় প্রকাশনা কম আসে আমাদের কাছে। এবার তো ছোট প্রকাশনাগুলো বই ছাপাচ্ছেই না। প্রকাশকরা বই না ছাপালে আমরা কিভাবে চলব? আমরাও একই বৈষম্যের শিকার। একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত। লোক ছাঁটাই করেছি। আমি, আমার ছোটভাই আর একটি ছেলে আছি। এখনো কোনোরকমে টিকে আছি আমরা। এ অবস্থা শিগগিরই না বদলালে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে! বড় বাইন্ডিং প্রতিষ্ঠানগুলোই শুধু ঠিকঠাক টিকে রয়েছে। সবাই শুধু গার্মেন্টস শ্রমিক, পাটকল, ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করে, তাদের কথাই লেখে; কিন্তু আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে সরকারেরও কোনো মাথাব্যথা নেই, কারো কোনো কথাও নেই! এটিই বড় বৈষম্য। অথচ বাইন্ডিং ছাড়া বই কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় না।’

পুরানা পল্টনে ফুটপাতের বই বিক্রেতা আব্দুর রহিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘১৫-২০ বছর ধরে এই ফুটপাতে বই বিক্রি করছি। এর আগে আমার আব্বা ফুটপাতে বই বিক্রি করতেন। তার সঙ্গে আসতে আসতে আমিও বইয়ের দোকানদার হয়ে গেছি। ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার হয়, মাস্টারের ছেলে মাস্টার; আর বই বিক্রেতার ছেলে বই বিক্রেতা! কতবার উচ্ছেদ হয়েছি, আবার বসেছি। তারপরও বেঁচে থাকার মতো ইনকাম হতো। প্রচুর মানুষ ফুটপাতে ঘুরে ঘুরে বই কিনে; কিন্তু করোনাভাইরাস আমাদের শেষ করে দিয়েছে। কোনোরকমে দিন যাচ্ছে, রাত পোহাচ্ছে। এর মধ্যে আছে নিজের বউ-বাচ্চা, সংসার। সব জায়গায় শুধু বৈষম্যের মধ্যেই আছি। এখন কোনো ক্রেতা নেই বললেই চলে। যারা বই কিনে তাদের আয়ও খুব কম। জানেন, বড় লোকরা তো বই কিনে না। আর যারা বই কিনবে, তাদেরই চাকরি নেই, বেতন কমেছে, প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। দুনিয়ার সবখানে অভাব চলছে। কি আর বলব! আমাদের তো আর সরকার কোনো টাকা-পয়সা দেবে না। কতভাবে যে মানুষ বিপদের মধ্যে আছে, তা না দেখলে বোঝা যায় না। শুধু গার্মেন্টস আর রিকশা চালকরা নয়; আমাদের নিয়েও কথা বলা দরকার। বইয়ের পাশাপাশি ডায়েরি, কলমও বিক্রি করতাম। এবার দেখি ডায়েরিও বিক্রি হচ্ছে না, ক্যালেন্ডারও বিক্রি হচ্ছে না। তবে বইয়ের ব্যবসাটা নেশায় পরিণত হয়েছে, ছাড়তেও পারি না। ধরুন, চায়ের দোকান বা পুড়ির দোকান দিলেও তো অনেক বিক্রি হতো; কিন্তু তা করছি না। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে হয়তো বাড়ি গিয়ে কামলাই খাটতে হবে! অথচ সরকার একটু সুনজর দিলেই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম। দেখেন না, এবার মেলার কি অবস্থা! নামকাওয়াস্তে আয়োজন করেছে। বইমেলার সময় কিন্তু আমাদের ফুটপাতেও বিক্রি বাড়ে। এবার তার সম্ভাবনা জিরো। এটিই বৈষম্য। এর থেকে উত্তরণ পেতে হলে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে। মানুষজনের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে লেখক, সাংবাদিক শাহেরীন আরাফাত বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনোকালেই ক্ষমতাসীন সরকার বা রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা মুক্তচিন্তার পথ উন্মুক্ত করতে চায়নি। তাই সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের কথাও তারা ভাবেনি। যে কারণে প্রকাশনা খাত বা মানসম্মত বই নিয়েও তাদের মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি কখনো। একদিকে মানসম্পন্ন বইয়ের ঘাটতি, আবার অপরদিকে কোনো কোনো প্রকাশনা অত্যধিক মূল্য নির্ধারণ করে প্রথমেই বইকে সাধারণ পাঠকের নাগাল ছাড়া করে দেয়। কার্যত এসব বই সম্পদশালীদের বুকশেলফের শোভা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। অথচ এ নিয়ে বাংলা একাডেমির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বই পড়ার প্রবণতা কমে গেলেও, তা নিয়ে চিন্তিত নয়, সম্ভবত আনন্দিতই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি! যে কারণে এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই তাদের।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলোÑ মানুষ গাদাগাদি করে বাসে চড়ছে, কনুই মেরে হাঁটতে হচ্ছে; অথচ অবরুদ্ধ কেবল জ্ঞানচর্চাÑ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ; বন্ধ বইমেলা। গার্মেন্টস মালিক, ঋণ খেলাপিরা করোনাকালে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা পেল; অথচ প্রকাশনা খাতের দিকে কেউ তাকালো না! বাজার অর্থনীতির যুগে প্রকাশনা বা জ্ঞানচর্চার মূল্য নিতান্তই নগণ্য। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই তো পরীক্ষাকেন্দ্রিক, যা জ্ঞানচর্চা থেকে বিচ্ছিন্ন। করোনাভাইরাসের কারণেই প্রকাশনা খাতে এ ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। বরং করোনাভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্য খাতের মতো শিক্ষা ও প্রকাশনা খাতের প্রকৃত অবস্থা আজ আমাদের সামনে উন্মুক্ত। হাজারো কোটি টাকার ব্যবসা হলেও এসব খাতের নড়বড়ে ভিত্তিই বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী।’ 

উত্তরণের পথ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো শর্টকাট পথ নেই। পুরো শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন এবং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষের সঙ্গে এ বিষয়টি জড়িত। করোনাকালে আমরা দেখছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মুক্তচিন্তার বিকাশ না ঘটলে সাংস্কৃতিকভাবে একটি সমাজ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বর্তমানে আমরা এমনই এক আবদ্ধ জলাশয়ে বাস করছি। যেখানে পচা-গলা চেহারাটা প্রায়শ বেরিয়ে আসছে। সরকারি হিসাবে, গত এক বছরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল পাঁচ হাজারের মতো মানুষ। এ সময়ে আত্মহত্যা করে দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ। অথচ এর দায় কিন্তু রাষ্ট্র-সরকার নিচ্ছে না। হেফাজতে মৃত্যুর দায়ও তাদের নেই। জনগণের মোলিক চাহিদা পূরণের দায়ও তাদের নেই। এ থেকে বুঝা যায়, পুরো ব্যবস্থাটিই চায় না জনগণের সাংস্কৃতিক, মানসিক চেতনার উৎকর্ষ ঘটুক। তাই সংস্কার নয়; বরং পুরো ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই এ থেকে উত্তরণ সম্ভব।’