সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু মিলিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাগুলো তখনও গিজগিজ করছে মানুষের ভিড়ে। কেবল একটা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা আফরিন-এর মনে হচ্ছে, এই শহরের ব্যস্ততা তার জীবনে একটুও ছাপ ফেলতে পারছে না। যেন সে একদমই আলাদা, একা, নিঃসঙ্গ।
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই দিনে ওর বাগদান হয়েছিল, হৃদয়ের সঙ্গে। ছেলেটা ছিল একদম অন্যরকম—প্রতিটা মুহূর্তে হাসাতে পারত, খারাপ সময়েও পাশে থাকত। অথচ, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! এক সড়ক দুর্ঘটনায় হৃদয়কে হারাতে হয়েছে তাকে।
আফরিন এক মুহূর্তও ভুলতে পারেনি সেই দিনটার কথা। হাসপাতালের সাদা বিছানায় রক্তমাখা হৃদয়ের নিথর দেহটা দেখে ওর মনে হয়েছিল, সব শেষ। চোখের সামনে ভেঙে পড়েছিল স্বপ্নগুলো। মানুষজন সান্ত্বনা দিয়েছিল, "সময় সব ঠিক করে দেবে।" কিন্তু কেউ বুঝল না, সময় কেবল ক্ষত গভীর করে তোলে, ঠিক করে না।
হাতের কব্জিতে আঁকা ক্ষতগুলো দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কতবার যে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভেবেছে! কিন্তু পারেনি। মায়ের মুখটা মনে পড়ল, ছোট ভাইটার মুখ মনে পড়ল। তবু আজ, এই ব্যস্ত শহরের কোলাহলে দাঁড়িয়ে, ওর মনে হচ্ছে—এবার সত্যি মুক্তি দরকার।
সামনের রেলিংটা পেরিয়ে এক পা বাড়াতেই আচমকা একটা দৃঢ় হাত ধরে ফেলল ওর হাত। চমকে ফিরে তাকালো।
— "তুমি কি পাগল হলে? কী করতে যাচ্ছিলে?"
একটা অপরিচিত ছেলেকে দেখে বিস্মিত হলো আফরিন। ছেলেটার চোখে আতঙ্ক আর উদ্বেগ।
— "তোমার কী দরকার?" আফরিন ধরা গলায় বলল।
— "দরকার? তুমি জানো, তোমার এক পা বাড়ানোর মানে কী?" ছেলেটার কণ্ঠ দৃঢ়, তবু নরম। "তুমি মারা গেলে তোমার মা, ভাই কী করবে? তুমি ভাবছো, কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে, কিন্তু তাদের কষ্টের কি হবে?"
আফরিন চুপ।
ছেলেটা ধীরে ধীরে বলল, "আমি একটা গল্প বলি?"
আফরিন মাথা নাড়ল।
— "আমার ছোট বোনও এমনটাই করেছিল। ভাবতাম, ও খুব হাসিখুশি। কিন্তু একদিন ও চলে গেল, এভাবেই... সেদিন বুঝলাম, আমরা কেউই আসলে কারো দুঃখ পুরোপুরি বুঝতে পারি না। কিন্তু জীবন চলে যায় না, আমরা বেঁচে থাকি… কষ্ট নিয়েই, ভালোবাসা নিয়েই।"
আফরিনের চোখ ভিজে এলো। এই প্রথম কেউ ওর কষ্টটা সত্যি সত্যি বুঝল।
— "তুমি কী চাও?"
— "তোমার জীবন চাই। মরতে চাইলে পরে মরো, কিন্তু আগে বেঁচে থাকার একটা সুযোগ দাও।"
ছেলেটার কথা শুনে আফরিন এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, "তুমি কে?"
— "একজন মানুষ, যে হারিয়েছে, কিন্তু এখনো বেঁচে আছে।"
আফরিন ধীরে ধীরে পেছনে সরে এলো। আজ অনেকদিন পর বেঁচে থাকার জন্য একটা কারণ পেলো। জীবন, হয়তো এত সহজ না, কিন্তু হয়তো এটুকু যথেষ্ট—একটা হাত, যা শেষ মুহূর্তে ধরে রাখতে চায়।