আসলে নভেল বা উপন্যাস লেখা একটা মস্ত সফর যেখানে পথের প্রতিটি বাকে পথিক আবিস্কার করে আরো কতটা পথ বাকি আছে। অবশ্য প্রতিটি নতুন পথই আরেক দিগন্ত খুলে দেয়। মুশকিলটা হল সবাই এই দিগন্তের দেখাটা পায়না। এই কারনেই ৯০ শতাংশ লেখক তাদের উপন্যাস কখনো শেষ করতেই পারেনা। এই লেখাটা অবশ্য উপন্যাস শেষের না বরং শুরুর। শুধু শুধু জ্ঞান জাহির করাটা ক্ষমা করবেন। আমি নিজেই কোন ছাপানো লেখক নই। অন্তত এখনো তো নই। তাই এই লেখাটা যতটা না আপনার জন্য তার চেয়ে অনেক বেশি আমার নিজের জন্য। আপনিও যদি আমার পথের হয় থাকেন তবে আসেন একসঙ্গে একটা দিগন্তে তাকাই।
উপন্যাসের শুরুটা আপনার চিন্তা শুরুর মাইলফলক। আর শুরুতেই হয়তো আমরা সবচেয়ে ভালোটা দেয়ার আশা করিনা। অথবা পারিনা। মুশকিলটা হল এই অংশটাই আপনার লেখার সর্বাধিক পঠিত অংশ হতে যাচ্ছে। ধরেন ধ্রুব এষ দাদা একটা যারপরনাই চোখ চেয়ে থাকার মতন প্রচ্ছদ বানিয়ে দিল, পাঠক বইমেলায় গোত্তা খেতে খেতে আপনার বইটা হাতে তুলেও নিলো, কিন্তু এরপর আপনার প্রথম পাতার ওপর ভর করে গাটের পয়সা খরচ করে হয় সে বইখানা বগল দাবা করে বাড়ি যাবে আর নাহলে বিড়ালের মতন মুখ বাকিয়ে আলতো করে রেখে পাশের ইমদাদুল মিলনের বইটা তুলে নেবে। ধ্রুব এষ আরো আছে বাজারে। মনে রাখবেন, পাঠক কিসে আটকায়? - প্রথম পাতায়।
তা এত বক বকের পর আসি প্রথম পাতায় কি থাকা চাইঃ
প্রথম পাতায় থাকা চাই গল্পের মূল চরিত্র। আপনি কি গল্পের শুরুটাতে নায়কের গ্রাম ,নদী কিংবা ফ্যান্টাসির জাদুর দুনিয়া সাজাতে চান? পাতা চারেক লেখার পর তামিল হিরোর মতন বাঘের সাথে মল্লযুদ্ধে ইয়ান্না রাস্কেলা এন্ট্রি করবে মূল চরিত্র? আপনার স্বপ্নের গল্প ঠিক এইভাবেই হয়তো দেখেন, কেউ তাতে বাধা দিতে পারবেনা, মুশকিলটা হচ্ছে মানুষ সবচেয়ে বেশি এসোসিয়েট করে আপনার মূল চরিত্রের সাথে। আর না হলে করেনা। দুর্বল মূল চরিত্রের থাকলে আপনার গল্পের দুনিয়া পাঠককে ধরে রাখবেনা। ভালো বা খারাপ যাই হোক বাজিয়ে দেখতে প্রথম পাতায়ই তাঁর মুখদর্শন চাই। তার পর আসে তার পৃথিবী বা আপনার জ্ঞানী জ্ঞানী কথা। সেই একজন যতই চমৎকার হোক না কেন তাকে প্রথম পাতায় খুজে, না পেয়ে, একবিংশ শতাব্দির টিকটক পরিমান মনোযোগের পাঠক, হুমায়ুন আহমেদের হিমু কিনে বসে থাকবে। এই হিমু তার বাসায় আছে। তাও আপনারটা নিবেনা।
তা শুধু আপনার নায়ক/নায়িকা থাকলেই হবেনা। প্রথম অধ্যায়ের কনফ্লিক্ট বা প্রথম উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রথম পাতায় আটলে ভাল। ভাবছেন কি যা তা বলছি। বলা নাই কওয়া নাই নায়ক চুমো খেয়ে বসবে বা ঠাস করে মেরে দেবে চড়। বেচারা নায়িকার কি রকম ভিরমি খাওয়ার দশা বলুন তো। আরে এই খানেই তো মজা। আগে মেরে দেবেন চড়, পরে ঘটনা বুঝিয়ে বলবেন। চড়খানা ব্যাকস্টোরিতে টেনে নেবে কিন্তু ব্যাকস্টোরি সে কাজ করবে না। বুঝলেন, দুনিয়ায় একটু চালাক না হলে …
আর একটা বিষয় আনা যেতে পারে লেখার ভেতরে, আর এখানেই আসলে লেখকের মুন্সিয়ানা বোঝার পালা শুরু। এই বইয়ের কাহিনীর ভাব (মুড) প্রথম পাতায় সেট করতে হবে। আসলে ভাব ব্যাপারটা একটু গভীর। ধরেন একটা চটপটে প্রেমের কাহিনী লেখা হচ্ছে। আপনি শুরু করলেন মেঘলা আকাশ আর নায়িকার অসুস্থ মায়ের কাশির দৃশ্য দিয়ে।হতেই পারে আপনার গল্পের শুরু এইখানে। পরে খুবি চটপটে আর রোমান্টিক হয়ে উঠবে। গোলাপের বুকে নিয়ে এয়ারপোর্টে দৌড়া দোড়ীও আছে। কিন্তু শুরু এইটাই হয়। আপনার চিন্তা ভাবনা ঠিক আছে কিন্তু এইটা ভাবের বিপরীত। শুরু হইতে পারে নায়িকা এলেমেন্ডা ফুল হাতে হোচট দৌড়তে লাফাতে গিয়ে কোথাও হোচট খেয়ে মায়ের বকা খেল। এখানে উজ্জ্বল রঙের ফুল আর নায়িকার চপলতা, হাল্কা মেজাজের ব্যাপার স্যাপার দিয়ে মুড সেট করে দিলেন উপন্যাসের। পরে মায়ের কাশী দিয়ে কনফ্লিক্ট ঢুকিয়ে দিলেন। আসলে ভাবের অমিল বিষয়টা পাঠক সরাসরি বলতে না পারলেও, কোথাও একটা খচ খচ করবে।
এইবার আসে থিমের পালা। থিম জিনিসটা আসলে আরো একটু গভীর। এইটা দাবী করে আপনার গল্পের ব্যপারে আপনার স্পস্ট ধারনা। আসলে আপনার গল্পটা কি নিয়ে। এইটা কোন ভাবে আসলে মুড থেকে আলাদা। ধরেন হ্যারি পটারের পুরা গল্পই জাদুর দুনিয়ায় হ্যারির এডভেঞ্চার নিয়ে, কিন্তু আসলে এই বইটার মূল থিম হল সাধারন মাগলদের দুনিয়া আর জাদুর দুনিয়ার কন্ট্রাস্ট বা বিপরীত মুখিতা। যেই কারনে এইটা শুরু হয় এইভাবে। “Mr. and Mrs. Dursley, of number four, Privet Drive, were proud to say that they were perfectly normal, thank you very much.”। এইটুকুনেই কিন্তু রাউলিং খেলা দেখিয়ে দিয়েছে। পুরা বই যেখানে হ্যারি মাগল দুনিয়া থেকে অবাক বিস্ময়ে জাদুর দুনিয়া আবিস্কার করতে থাকে ,সেই থিম সে প্রথম বাক্যেই দেখিয়ে দিতে পেরেছে। এখানে এক দম্পতি বলছেন যে তাঁরা খুবই সাধারন। এই নিয়ে তারা গর্বিত। না বলার মাঝেই রাউলিং বুঝিয়ে দিয়েছেন অসাধারন কিছুর বিপরীতেই তারা অমন। এভাবে যদি থিমটা সেট করে নেয়া যায় পাঠক আরাম বোধ করেন। যদিও খুব একটা বোঝেন না কেন। আসলে গাড়ির কলকব্জা বোঝা তাঁদের কম্মো নয়। আরামে গাড়ি চালানোর নিশ্চয়তাই আমাদের দায়িত্ব।
আচ্ছা এই চারটা নিয়ে সর্বশেষ বড় লেখক সাদাত হোসাইনের প্রথম উপন্যাস আরশীনগরের প্রথম প্যারা কিভাবে লেখা হয়েছে দেখিঃ
“নিলুফা বেগম মারা গেলেন সন্ধ্যাবেলায়। (থিম মৃত্যু, মুড সন্ধ্যা)
তার পাশে কাপড়ের পুটলির ভেতর শুয়েছিল আরশী (প্রধান চরিত্র ১) … নিলুফার শরীরের অবস্থা ভালো ছিলনা। … নিলুফার অবস্থা দেখে খোদেজা দাই আতকে উঠল (প্রথম কনফ্লিক্ট) । সে নিলুফার শাশুরী ( তৃতীয় প্রধান চরিত্র) আম্বরী বেগম আর স্বামী মজিবর মিয়াকে ডাকল। তারপর কাপা গলায় বলল “ বিপদ, মহাবিপদ। ডাক্তার (৪র্থ প্রধান চরিত্র) ডাক্তে হইবো। ডাক্তার ডাইকা আনো।“ (থিম মৃত্যু, মুড ডার্ক)
আরশীনগর লেখকের সবচেয়ে জনপ্রিয় বই। আর তার আগে সাদাত হোসাইন, সাদাত হোসাইন ছিলেন না। পাঠক ভীড়ের মাঝেই এই বইটা খুজে আপন করে নিয়েছিল। ভেবে দেখেন লেখক, ফর্মুলা খারাপ না।