সাতটা ত্রিশ বেজে গেছে। অফিস পুরো ফাঁকা, আমি বাদে আর কেউ নেই। সবশেষে আমিও অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গেটে সোহাগ ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। তিনি বললেন,"কি ব্যাপার রায়হান সাহেব, আজকাল আপনাকে বেশ মনমরা মনে হচ্ছে। শরীরটা ঠিক আছে তো?" আমি হালকা হাসি দিয়ে বললাম, "শরীর ঠিকই আছে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?" "ভুলে অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ফেলে এসেছি, সেটাই আনতে যাচ্ছি।" "আচ্ছা, তাহলে আগামীকাল দেখা হবে?" "হ্যাঁ, অবশ্যই। নিজের শরীরের খেয়াল রাখবেন। মনে রাখবেন, শরীর ভালো থাকলে মনও ভালো থাকে।" সোহাগ ভাই অফিসের দিকে ফিরে গেলেন, আমিও হাঁটতে শুরু করলাম। নির্জন রাস্তায় একা হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে গেলাম। সেই সময়ের কথা মনে পড়ল, যখন আমি আমার পরিবারের সাথে থাকতাম। কত আনন্দেই না কাটত দিনগুলো! একাকীত্ব কেমন জিনিস, তখন জানতামই না। আর এখন, এই একাকীত্ব যেন আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি এসে পৌঁছালাম। গ্যারেজে আবিলের সাথে দেখা হলো। আবিল বলল,"বাবু, আজ আপনার প্রিয় খিচুড়ি রান্না করেছি, খেয়ে নেবেন?" আমি ক্লান্ত স্বরে বললাম, "ঠিক আছে।" আবিল একটু ইতস্তত করে বলল, "আরেকটা কথা বলব, যদি কিছু মনে না করেন?" আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, "বলো।" "আজকাল আপনাকে কেমন যেন অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে। শরীর ঠিক আছে তো?" আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, "হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।" বলে ঘরের দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার, সোহাগ ভাইয়ের জিজ্ঞেস করা একই প্রশ্ন আবিলও করল! আমি কি সত্যিই এতটা বদলে গেছি? এতটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি? পুরোনো দিনের কথা বেশি ভাবছি? টেবিলে বসে খাবারের দিকে তাকালাম। আমার পছন্দের খাবার সামনে থাকলেও, খেতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আমায় অদৃশ্য শেকলে বেঁধে রেখেছে। একাকীত্ব আমাকে ক্রমশ গিলে ফেলছে, এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। খাবার না খেয়েই উঠে পড়লাম। মনটা ভারী লাগছিল। একটু বাইরে হাঁটতে ইচ্ছে হলো। ঘর তালাবদ্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই গ্যারেজে আবিলের সাথে আবার দেখা হলো। সে বিস্ময়ের সুরে বলল, "বাবু, এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?" আমি সংক্ষেপে বললাম, "বাইরে একটু হাঁটবো।" আবিল চিন্তিত মুখে বলল, "তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরবেন, প্লিজ। আজ আপনাকে কেমন যেন লাগছে।" আমি মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি, আজ আকাশে পূর্ণিমার আলো। জোছনায় পুরো শহর স্নান করছে, অনেকগুলো তারাও দেখা যাচ্ছে। রাস্তার বেশিরভাগ ল্যাম্পপোস্ট নষ্ট হয়ে গেছে, মাত্র কয়েকটা টিমটিম করে জ্বলছে। আশপাশে কোনো মানুষ নেই। পুরো এলাকা শুনশান। ঠান্ডা বেশ পড়েছে, অথচ আমি পাতলা একটা টি-শার্ট পরে আছি, তাই শীত আরও বেশি লাগছে। নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পেছন থেকে কেউ আমার হাতটা টেনে ধরল! আমি চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকালাম। একটা ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে নীলচে সাদা ফ্রক, মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,"তুমি কে? এত রাতে এখানে কী করছো? তোমার বাবা-মা কোথায়?" মেয়েটি শান্ত গলায় বলল, "আমার নাম জয়ী। তুমি আমাকে চিনবে না।" "তাহলে এত রাতে এখানে কেন?" মেয়েটির ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠল, "আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।" আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, "সাহায্য? কীসের সাহায্য?" "তোমার জীবনের একটি বড় মিথ্যা ফাঁস করতে এসেছি।" মেয়েটার কথাটা শেষ না হতেই আমার মাথাটা কেমন যেন ঘুরতে লাগল। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে গেল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না—আমার সাথে আসলে কী ঘটছে? চোখ মেলে দেখি, আমি একটা বেঞ্চের ওপর বসে আছি। আমার পাশে সেই মেয়েটাও বসে আছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমি কোথায় আছি? এটা কোন জায়গা?" মেয়েটা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, "সব বলব, আগে আমার সঙ্গে চলো।" তারপর সে সামনের দিকে তাকিয়ে একটা টানেলের দিকে ইশারা করল, "ওটা দেখছ? এর ওপারে গেলেই তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।" আশপাশ দেখে মনে হলো আমি কোনো গিরিখাতের মধ্যে আছি। মাথা ঘুরিয়ে বাম দিকে চেয়ে দেখি বিরাট বড়ো এক পাহার,ডান দিকে, কুয়াশায় আচ্ছন্ন একটা টানেল। এর ভেতরটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল—টানেলের ওপারে এমন কী আছে যেখানে গেলে আমার সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে? আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, "আমি টানেলের ওপারে যেতে চাই না। আর আমার কোনো প্রশ্নের উত্তরেরও দরকার নেই। তুমি আমাকে আমার আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাও।" মেয়েটা ধীর গলায় বলল, "আমি তোমার সাহায্য করতে চাই। টানেলের ওপারে গেলে তোমারই ভালো হবে।" আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। মনে হচ্ছিল, এটা হয়তো হ্যালুসিনেশন। মেয়েটা যেন আমার মনের কথা পড়ে ফেলল, "না, তোমার কোনো হ্যালুসিনেশন হচ্ছে না। তুমি পুরোপুরি সুস্থ। আমার কথা শোনো, টানেলের ওপারে চলো।" আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, "টানেলের ওপারে গেলেই যদি ফিরে যাওয়ার পথ পাওয়া যায়, তাহলে আমি যেতে রাজি।" মেয়েটা খুশি মনে বলল, "ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। চলো!" সে হাঁটতে শুরু করল, আর আমি তার পেছন পেছন চলতে লাগলাম। টানেলের ভেতরে ঢুকতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মনে হলো, আমি অন্য কোনো জগতে প্রবেশ করছি। চারপাশটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দূরে একটা আলো দেখতে পেলাম। আলোটা ক্রমেই বড় হয়ে আসছে। মনে হলো, আমরা যেন অন্য এক জগতে পৌঁছে গেছি। টানেলের ওপারে এসে দেখি, আমরা একটা পুরোনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে সব কিছু অদ্ভুত লাগছিল। আমি বিস্মিত হয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমরা এখন কোথায় আছি?" মেয়েটা কোনো উত্তর দিল না। আমি আবারও বললাম, "এটা কী জায়গা? কিছু বলবে?" এবার মেয়েটা বলল, "শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখো, বেশি প্রশ্ন কোরো না।" আমি পেছনে ফিরে টানেলের দিকে তাকালাম, কিন্তু... টানেলটা উধাও! সেখানে কোনো টানেলের চিহ্নও নেই। "কী! টানেলটা কোথায় গেল?" বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম আমি। মেয়েটা শান্ত গলায় বলল, "সে সব চিন্তা পরে করো। আগে ওই দিকে তাকিয়ে দেখো।" সামনে তাকিয়ে দেখি, বাড়ির দরজা খুলে একটা মেয়ে বেরিয়ে আসছে। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, "রূপা! এটা কীভাবে সম্ভব?" রূপা তো সাত মাস আগেই মারা গেছে! তারপর যা দেখলাম, তাতে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। দেখলাম, রূপার পেছনে পেছনে আরেকজন বেরিয়ে আসছে। আর সে কেউ নয়—আমি নিজেই! "এটা... এটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তাহলে ওটা কে?" মেয়েটা মৃদু হেসে বলল, "তুমি টাইম ট্রাভেল করে সাত মাস অতীতে চলে এসেছো।" আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, "কি? টাইম ট্রাভেল?" "হ্যাঁ। তুমি এখন তোমার স্মৃতির ভেতর আছো। আজ থেকে সাত মাস আগে তোমরা এখানে এসেছিলে, তোমাদের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। আর পার্কিং লটে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা লাল গাড়িটা দেখছ?" আমি গাড়িটার দিকে তাকালাম। চেনা চেনা লাগল। "ওটা তো আমার গাড়ি!" মেয়েটা বলল, "ঠিক বলেছ। এবার ভালো করে দেখো, তোমার গাড়ির নিচে কে আছে?" আমি নিচে তাকিয়ে দেখি, একটা লোক গাড়ির নিচে শুয়ে কী যেন করছে। কিছুক্ষণ পর সে উঠে দাঁড়াল। আমি চমকে উঠলাম, "আরে! এ তো আমার ছোট কাকা, সুরেন কাকা!" মেয়েটা বলল, "ঠিকই ধরেছো। জানো, উনি গাড়ির নিচে কী করছিলেন?" "না, জানি না। উনি কী করছিলেন?" মেয়েটা গভীর গলায় বলল, "তোমার কাকা তোমার গাড়ির ব্রেক ফেইল করিয়ে দিয়েছিল।" আমি শিউরে উঠলাম, "না, এটা হতে পারে না!" "তোমার বিশ্বাস না হলে একটু অপেক্ষা করো।" আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখলাম, অতীতের আমি আর রূপা গাড়িতে উঠলাম। আমি ড্রাইভিং সিটে, রূপা আমার পাশে। গাড়িটা স্টার্ট দিলাম, আর আমরা বেরিয়ে গেলাম। আমি ফিসফিস করে বললাম, "এটাই সেই দিন, যেদিন রূপা মারা গিয়েছিল।" আমার মনে পড়ে গেল—সেদিন ব্রেক ফেল করায় আমার গাড়ি একটা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল। রূপা ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছিল, আর আমি কোনো মতে বেঁচে গিয়েছিলাম। আমার চোখ ভিজে গেল। মেয়েটা বলল, "এখন কি বুঝতে পারলে, তোমার কাকা কেন গাড়ির নিচে ছিল?" আমি মাথা নাড়লাম, "মানে, কাকাই আমার গাড়ির ব্রেক ফেল করিয়েছিল?" "ঠিক তাই।" আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। সম্পত্তির লোভে আমার কাকা আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল! মেয়েটা বলল, "আমার কাজ ছিল তোমাকে সত্যটা জানানো। বাকিটা তোমার ব্যাপার।" তারপর হঠাৎই আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। আমি কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল। চোখ খুলে দেখি, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন—আমার প্রতিবেশী সুন্ময়বাবু আর আবিল। "আপনি সারারাত কোথায় ছিলেন?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আবিল। আমি কোনো উত্তর দিলাম না। সুস্ময়বাবু বললেন, "এসব পরে জানা যাবে। আগে বিশ্রাম করুন।" কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর, আমি বেরিয়ে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে নেমে গ্যারাজে গেলাম। আবিল আমাকে দেখে বলল, "কোথায় যাচ্ছেন?" আমি ধীর গলায় বললাম, "কাকার বাড়ি যাচ্ছি, একটু দরকার আছে।" আবিল বলল, "ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি ফিরবেন।" আমি গ্যারাজের বাইরে বেরিয়ে এলাম। গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেই গাড়ি... যেটা এক্সিডেন্টের পর আর চালানো হয়নি। একটা ট্যাক্সিতে উঠে কাকার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বললাম, "এই ঠিকানায় নিয়ে চলুন।" আমার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—আমি যখন কাকার সামনে যাব, তখন তিনি সত্যিটা স্বীকার করবেন, নাকি বলবেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? Etar ekta sonkhepe likhe den previw text