বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স একটি বিবৃতি দিয়েছেন, ২০২৪ সালের জুলাই এবং আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিসের প্রতিবেদনটি একই সাথে হৃদয়বিদারক এবং উদ্বেগজনক। প্রতিবেদন অনুযায়ী ১লা জুলাই থেকে ১৫ই আগস্টের মধ্যে যে ১৪০০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে শতাধিক ছিল শিশু।
বাংলাদেশের শিশুদের সাথে "আর কখনোই যেন এমনটি না ঘটে" তা নিশ্চিত করার জন্য ইউনিসেফ বাংলাদেশের সকল মানুষের কাছে আহ্বান জানিয়েছে।
ওদিকে কয়েকটি আয়নাঘর উন্মোচিত হয়ে পড়ায় সেসব তথ্য ও ছবি উড়িয়ে দিয়ে বিগত সরকারি দল আওয়ামী লীগ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জনপ্রিয় সংলাপ ধার করে নিয়ে বলছে, 'নাটক কম করো পিও!
কী বিস্ময়কর আমাদের রাজনৈতিক অধঃপতন! জাতিসংঘ এসে আমাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য ও উপাত্ত সহকারে প্রতিবেদন দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ বলছে, ক্ষমতায় থাকতে নৃশংস পদক্ষেপ নিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। বিক্ষোভ ঘিরে ১৪০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, ১৩৫২৯ জন আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ ভাগই শিশু। রাজনীতি, ক্ষমতার ভাগাভাগি ও লুটপাট করবেন আপনারা, সেখানে শিশুদের কেন প্রাণ দিতে হলো? এই জবাব আওয়ামী লীগের কাছে নাই। দলটির চার দশকের সভাপতি বলছেন, এর সবটাই নাকি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মেটিক্যুলাস ডিজাইন অনুযায়ী করা। এর পেছনে নাকি কলকাঠি নেড়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসন। আচ্ছা তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, আওয়ামী লীগ উত্থাপিত এই অভিযোগটি সত্য। কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কে ছিল? ওই আওয়ামী লীগই তো? তাহলে এতগুলো প্রাণ বিনাশের দায় তাদের ওপর কেন বর্তাবে না? কোন যুক্তিতে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বিরোধিতা করবে আওয়ামী লীগ? এই প্রতিবেদন তো ড. ইউনূস সরকার উপস্থাপন করে নাই। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তী সরকার হস্তক্ষেপ করবার সক্ষমতা রাখে এমন দাবিও কেউ তুলেনি। তাহলে সবকিছুই আওয়ামী লীগ অস্বীকার করে কোন মুখে? ডিনায়াল দিয়ে সবকিছু জাস্টিফাইড করা যায় আসলে?
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে জানিয়েছেন, জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের সহিংস কর্মকান্ডের পাশাপাশি বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ছিল। ক্ষমতায় থাকার জন্য হাসিনা সরকার ক্রমাগত নৃশংস পদক্ষেপ নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেছিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট মোটেও একপেশে না। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে আগস্ট এর শুরু থেকে পরবর্তী সময়ে স্বয়ংস মব (বিশৃঙ্খল জনতা) পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিশানা করে হত্যা সহ গুরুতরক প্রতিশোধ মূলক কর্মকাণ্ড করেছে। এ সময় হিন্দু, আহমদিয়া মুসলিম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীর সদস্যরাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের বাড়িঘরে হামলা ও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হামলা হয়েছে মাজার, মন্দিরসহ ধর্মীয় স্থাপনায়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তিদের এসব অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে ভুক্তভোগীদের মানবাধিকার রক্ষা করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার।
গতকাল বুধবার জেনেভায় বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংগঠিত ঘটনা প্রভাবে বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের দপ্তরের (OHCHR) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
আওয়ামী লীগ বরং তাদের সময়ে সংঘটিত স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় স্বীকার করে আইনি প্রক্রিয়াকে সহায়তা করতে পারে। এবং যেসব পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক ব্যর্থতা ও ক্ষমতার লোভের কাছে পরাস্ত হয়ে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, সেসব মানুষ ও পরিবারের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে পারে। জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারে জুলাইয়ের ভুলের পুনরাবৃত্তি এই জীবনে আর কখনো করবে না। অতঃপর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার চাইতে পারে। এটা তাদেরকে করতে হবে, যদি তারা রাজনীতিতে ফিরতে চায়, ভোটে অংশগ্রহণ করতে চায়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছেন গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজের ছবি। প্রথম আলো আজকে তাদের শীর্ষ সংবাদে ছবিটি ছাপিয়ে লিখেছে, গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজ রিকশার পাদানিতে। রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ তাঁকে নিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালে। ৪ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে ছবিটি তোলেন মানবজমিন পত্রিকার ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ। সেই ছবির স্কেচ স্থান পেয়েছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রচ্ছদে।
প্রথম আলো তাদের আরেকটি সংবাদে লিখেছে, গোলাম নাফিজ রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি তে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করে কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিল। পরিবারসহ থাকত মহাখালীতে। দুই ভাই তারা। নাফিজ ছোট।
গত ১২ আগস্ট প্রথম আলোয় 'পাদানিতে ঝুলতে থাকা গুলিবিদ্ধ নাফিজ তখনও রিকশার রড ধরে ছিল' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজকে পুলিশ যখন রিকশার পাদানিতে তুলে দেয়, তখনো সে রিকশার রডটি হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল। রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ তাঁকে নিয়ে রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে ঢুকতে গেলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বাধা দেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক। পরে ১৭ বছরের গোলাম নাফিজকে নিয়ে রিকশাচালক খামারবাড়ির দিকে চলে যান।
হায় আওয়ামী লীগ! এরপরও বড় গলায় কথা বলবার মুখ আপনাদের থাকে? একজন প্রান্তিক রিকশাচালকের মানবিকতা, দয়া, সহমর্মিতা ও মহানুভবতার ধারেকাছেও আপনারা নাই। ক্ষমতার মোহ আপনাদের অন্ধ করে দিয়েছিল। হৃদয়ে মোহর মেরে রেখেছিল। আপনারা মানুষ চিনতেন না, মানবাধিকার বুঝতেন না, চিনতেন কেবল অবৈধ অর্থের দানবীয় লালসা আর বেপরোয়া ক্ষমতার চরম অপব্যবহার।
তাইতো রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে মারাত্মক দৈন্যদশায় পড়া আপনাদেরকে এখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের মুখের স্লোগান ধার করে বলতে হচ্ছে, 'নাটক কম করো পিও!' যেই কথাটি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আপনাদের প্রতি অনাস্থা দিয়ে ছাত্র-জনতা তীর হিসেবে ছুঁড়ে মেরেছিল।
আমরা বলব, শতাধিক শহীদ শিশুদের মুখ মনে করো আওয়ামী লীগ। মনে করো রিকশায় ঝুলে থাকা শহীদ গোলাম নাফিজের নিথর দেহ। অনুশোচনার বোধ তোমাদেরও আসতে পারে। উপলব্ধি তোমাদেরও হতে পারে, 'মানুষ ভুল করে, ক্ষমা চায় এবং ক্ষমা পায়ও।'
ইউনিসেফের মতো করে আমরাও দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, কোথাও কোনো মানুষের সাথে কখনোই যেন মানবতাবিরোধী এমন ট্রাজিক ঘটনা আর না ঘটে।
লেখক: সাংবাদিক
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫