
সন্ধ্যার পর থেকে শ্যামনগর গ্রামে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। দিনের আলোয় যে পথঘাট চেনা চেনা লাগে, রাত নামতেই তা হয়ে ওঠে আতঙ্কের ছায়ায় মোড়া। গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে এক পুরনো জমিদারবাড়ি বহু বছর ধরে ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু গ্রামবাসীরা বলে, ওটি কেবল ধ্বংসস্তূপ নয়—ওই বাড়ির প্রতিটি ইট, প্রতিটি দরজা-জানালার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর অস্তিত্ব।
শুনতে পাওয়া যায়, শত বছর আগে সেই বাড়িতে বাস করত চিত্রাঙ্গদা নামে এক রমণী। তার রূপ ছিল অভিশপ্ত, তার শরীর ছিল কামনার কারাগার, আর তার ভালোবাসা ছিল মৃত্যুর ফাঁদ। পুরুষেরা একবার তার চোখের দিকে তাকালে আর ফিরতে পারত না। একে একে সবাই হারিয়ে গিয়েছিল তার বাহুডোরে, আর সকালে পাওয়া যেত তাদের বিবস্ত্র, রক্তশূন্য মৃতদেহ।
লোকেরা বলে, চিত্রাঙ্গদা কোনো সাধারণ নারী ছিল না। তার দেহের মধ্যে বাস করত এক ভয়ংকর পিশাচিনী, যে কামনার নামে পুরুষদের আত্মা শুষে নিত। শত বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আজও রাতের বেলায় কেউ যদি ভুল করে সেই পোড়ো বাড়ির সামনে দিয়ে যায়, তবে শুনতে পাবে এক মিষ্টি ডাক—এক নারীময় আহ্বান, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে টেনে নেয়।
সুমিত একজন শহুরে সাংবাদিক। অতৃপ্ত রহস্যের সন্ধান করা তার নেশা। শ্যামনগরের পোড়ো জমিদারবাড়ি নিয়ে যখন সে লোকমুখে গল্প শুনল, তখনই ঠিক করে নিল, সে নিজের চোখে সত্যটা দেখে আসবে।
বন্ধুরা তাকে সাবধান করল, "সুমিত, অনেকেই গেছে ওই বাড়িতে, কেউ আর ফেরেনি!"
কিন্তু সে হাসল।
"ভুত-প্রেত কিছুই হয় না। সবই মানুষের কল্পনা!"
রাতের অন্ধকারে একাই সে রওনা দিল জমিদারবাড়ির দিকে। পূর্ণিমার আলোয় বাড়ির ভগ্নপ্রায় অবয়ব যেন আরও বেশি ভয়ংকর দেখাচ্ছিল। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আর সেই সঙ্গে এক অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ ভেসে এলো।
হঠাৎ—
"তুমি এসেছো?"
সুমিত চমকে তাকাল।
এক অপূর্ব সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। তার শরীরে রক্তলাল শাড়ি, যা বাতাসে উড়ছিল। গভীর কালো চোখ, ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি।
সে এগিয়ে এলো।
"আমি অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছি…"
তার গলার স্বর কোমল, কিন্তু তাতে লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত মোহ। সুমিতের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল।
নারী ধীরে ধীরে তার হাত ধরে টেনে নিল ভিতরের দিকে…
সুমিত বুঝতে পারছিল, তার শরীরের প্রতিটি কোষ যেন সেই নারীর স্পর্শ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ঠাণ্ডা বাতাসে শিহরণ জাগানো সেই হাত তাকে টেনে নিয়ে গেল পোড়ো জমিদারবাড়ির ভেতরে। ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে চারপাশের পরিবেশ বদলে গেল।
ম্লান প্রদীপের আলোয় দেখা গেল, ঘরের দেয়ালজুড়ে ঝুলছে পুরনো সব ছবি—সব পুরুষদের ছবি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিটি ছবির চোখ যেন জীবন্ত, যেন তারা তাকিয়ে আছে, যেন কিছু বলতে চায়।
সুমিত অস্বস্তি অনুভব করল।
"এসো… বসো…"
নারী তার হাত ধরে বিছানার দিকে টেনে নিল।
সুমিত তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল, সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। শরীরের প্রতিটি নার্ভ জেগে উঠেছে, কামনা তার রক্তে দাউ দাউ করে জ্বলছে। নারীর দৃষ্টি বিদ্ধ করছে তাকে, তার নিঃশ্বাস যেন এক রহস্যময় মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে।
নারী ধীরে ধীরে সুমিতের কাছে এল, তার হাত সুমিতের মুখ ছুঁয়ে গেল। ঠাণ্ডা! অথচ শরীরের ভেতর দিয়ে গরম একটা শিহরণ ছড়িয়ে গেল।
"তুমি কি জানো, আমি কত একা?"
তার গলায় এক অদ্ভুত দুঃখ লুকানো, এক অদ্ভুত আকুলতা।
সুমিত উত্তর দিতে পারল না। তার শরীরের সমস্ত রক্ত যেন আগুন হয়ে উঠেছে, নারীর শরীরের উষ্ণতা কাছে টেনে নিচ্ছে তাকে।
সে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না…
সে হাত বাড়িয়ে দিল সেই নারীর দিকে…
ঠিক তখনই…
"বাঁচাও!!!!"
এক বিকট চিৎকার ভেসে এলো চারপাশ থেকে!
সুমিত চমকে উঠল! চারপাশে তাকিয়ে দেখল, সেই ছবিগুলোর পুরুষেরা যেন কাঁদছে, যেন সাহায্য চাইছে!
"ফিরে যাও! পালাও!"
সুমিত হতভম্ব হয়ে গেল।
কিন্তু নারী হাসল।
এক বিভীষিকাময়, ভয়ংকর হাসি!
তার চোখ আগুনের মতো জ্বলতে লাগল, শরীরের শাড়ি বাতাসে উড়ে উঠল, আর তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো লম্বা, ধারালো দাঁত!
"তুমি কি জানো, ভালোবাসা আর মৃত্যু কতটা কাছাকাছি?"
নারীর মুখ বিকৃত হয়ে গেল। তার সুন্দর মুখের নিচে লুকিয়ে ছিল এক ভয়ংকর দানবী, এক অভিশপ্ত পিশাচিনী!
সুমিত দৌড়াতে চাইল, কিন্তু তার শরীর যেন পাথর হয়ে গেল। নারী ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো…
সুমিতের শরীর জমে গিয়েছিল। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অনিন্দ্যসুন্দরী নারী মুহূর্তের মধ্যে ভয়ংকর কিছুতে পরিণত হয়েছে। তার ঠোঁটের কোণে মোচড়ানো বিকৃত হাসি, ধারালো নখ, আর সেই রক্তলাল চোখ!
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক ছিল তার উপস্থিতি।
তার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে, প্রতিটি স্পর্শে এমন এক কামনার আগুন ছিল, যা প্রতিরোধ করা অসম্ভব!
সে ধীরে ধীরে সুমিতের কাছে এলো, তার বরফ-ঠাণ্ডা আঙুল বুলিয়ে দিল সুমিতের মুখে।
"তুমি তো পালাতে পারবে না, সুমিত…"
তার কণ্ঠস্বর ছিল বিষাক্ত মধুর মতো।
"তুমি আমায় কামনা করছো… তাই না?"
সুমিত কিছু বলতে পারল না।
তার মাথার ভেতর যেন একটা ঝড় বইতে শুরু করল। একদিকে ভয়, অন্যদিকে অদ্ভুত এক আকর্ষণ, যা তাকে এক অসম্ভব মোহের দিকে টেনে নিচ্ছিল।
নারী তার শরীর সুমিতের গায়ে ঠেসে ধরল। তার ঠোঁট এক ইঞ্চি দূরে…
ঠিক তখনই!
চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, অন্ধকার আরও ঘন হয়ে এলো। হঠাৎই সুমিত অনুভব করল, কিছু একটা তার শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে…
না, এটা শরীরী সুখ নয়… এটা এক অদ্ভুত যন্ত্রণা!
তার রক্ত যেন শুষে নেওয়া হচ্ছে!
"উমমম…"
নারী তার চোখ বন্ধ করে এক তৃপ্তির শব্দ করল।
সুমিতের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল!
সে বুঝতে পারল—
এই নারী পিশাচিনী!
সে কামনার মাধ্যমে পুরুষদের আত্মা গ্রাস করে!
তার শরীরের উষ্ণতা মিথ্যা! তার আবেগ মিথ্যা! তার ভালোবাসা এক ভয়ংকর ফাঁদ!
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে…
নারী তার ঠোঁট চেপে ধরল সুমিতের ঠোঁটে, আর সেই মুহূর্তে সুমিত অনুভব করল, তার সমস্ত শক্তি যেন চুষে নেওয়া হচ্ছে!
চারপাশের দেয়ালে ঝুলে থাকা ছবির চোখগুলো আরও বড় হয়ে গেল, তারা যেন হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে, আর্তনাদ করছে!
"না… না… আমাকে ছাড়ো…"
সুমিত শেষবারের মতো চিৎকার করল…
তারপর—
শুধু নীরবতা।
সকালের প্রথম আলো যখন পোড়ো জমিদারবাড়ির জানালায় পড়ল, তখন সেই বিছানায় সুমিতের বিবস্ত্র দেহ পড়ে ছিল… নিঃসাড়, রক্তশূন্য…
আর তার পাশেই বসে ছিল সেই নারী, ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় তৃপ্তির হাসি নিয়ে।
সে আবার অপেক্ষা করতে লাগল…
নতুন শিকার…
নতুন কামনার বলির …
(সমাপ্ত)