Posts

পোস্ট

ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা কি কোনো মানসিক রোগ?

February 14, 2025

Sanzeeda Sirajee

17
View

একটা সময় পাখি হতে চাইতেন, পাখির মতো ডানা মেলে বিশাল আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াতে  চাইলেও এখন বদ্ধ রুমে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন? রোদ ভালো লাগে না,কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না,পছন্দের কফিটা খেতে খেতে আকাশ দেখতে ইচ্ছে হয় না আর।নিজের অজান্তেই ভাবছেন আপনি  ডিপ্রেশনে আছেন কি না,নাকি নিজেকেই মানসিক রোগী ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন? চলুন জেনে নিই ডিপ্রেশন  নিয়ে আরও বিস্তারিত -


 

এই যে আম্মু বকা দিলে,পছন্দের ড্রেসটা কিনতে না পারলে বা প্রিয়জন সময় না দিলেই আমাদের হুটহাট মন খারাপ হয়ে যায়, এটাই কি ডিপ্রেশন?  উত্তর হলো-নাহ! যখন কারো কমপক্ষে দুই সপ্তাহজুড়ে দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকে,

মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে কিংবা হঠাৎ রেগে যায়

আগে যেসব কাজ বা বিনোদন ভালো লাগত, এখন সেগুলো ভালো লাগার পরিবর্তে বিরক্ত লাগে তখনই একজন মানুষ ডিপ্রেশনে আছে বলে ধারণা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রায় ২৬ কোটির ও বেশি মানুষ এই মুহুর্তে গুরুতর ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার শিকার।২০১৮সালের জরিপ ও গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায়  ৬.৭% মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছেন।বর্তমান সমাজে ডিপ্রেশনকে গুরুতর মানসিক ব্যাধি হিসেবে গন্য করা হয়। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের উদাসীনতা নতুন নয়। এমনকি মানসিক রোগ নিয়ে রয়েছে নানা অসচেতনতা, ভ্রান্ত ধারণা এবং ভুল বিশ্বাস। মানসিক সমস্যাকে কেউবা আবার পাগল, উদ্ভট বা বিকৃত মানসিকতার সাথেও তুলনা করেন।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণভাবে দেখা যায়, যিনি এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তার নিজের মধ্যেও এক ধরনের ‘স্টিগমা’ কাজ করে।

ডিপ্রেশন কত ধরনের হতে পারে

মেজর ডিপ্রেশন ডিসঅর্ডার: এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরন, অন্তত দুই সপ্তাহ ধরে ক্রমাগত দুঃখ এবং ক্রিয়াকলাপে আগ্রহ হারানোর সাথে জড়িত। 

ক্রমাগত বিষণ্নতাজনিত ব্যাধি, যা পূর্বে ডিসথাইমিয়া নামে পরিচিত।

সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার: এটি সাধারণত শরৎ এবং শীতকালে ঘটে।

প্রি পিরিয়ড ডিসফোরিক ডিসঅর্ডার: কিছু মহিলাকে তাদের মাসিক চক্রের আগে প্রভাবিত করে। 

প্রসবোত্তর বিষণ্নতা: যা প্রসবের পরে বিকাশ করতে পারে। 

Atypical depression :মেজাজ প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং বৃদ্ধি ক্ষুধা. 

মনস্তাত্ত্বিক বিষণ্নতার মধ্যে হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রম অন্তর্ভুক্ত।

ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা  কেন হয়?

ডিপ্রেশন  দুর্বলতার কোনো লক্ষণ নয়। সবচেয়ে দৃঢ়চেতা ব্যক্তিদেরও এটি হতে পারে — এমনকি বিখ্যাত ব্যক্তি, ক্রীড়াবিদ এবং তারকারাও মানসিক অবসাদে ভুগতে পারেন।

কখনও কখনও বিষণ্নতার একটি স্পষ্ট কারণ থাকতে পারে , অনেকসময় না-ও থাকতে পারে। হতাশা, ভয়, বা আপনার প্রিয় কোনও বস্তু বা ব্যক্তিকে হারানোর কারণে এটা হতে পারে।

নিচে কয়েকটি সাধারণ কারণ বর্ণনা করা হলো-

জীবনের ঘটনা এবং ব্যক্তিগত পরিস্থিতি:

চাপ বা কষ্টদায়ক ঘটনার কারণে মানসিক অবসাদ থেকে ডিপ্রেশন শুরু হতে পারে, যেমন শোক, সম্পর্ক ভাঙ্গন, বা চাকরি হারানো।

যদি কেউ  বন্ধু বা পরিবারহীন একাকী জীবন কাটায় তাহলে তার মানসিক অবসাদগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

শারীরিক স্বাস্থ্য:

ঘুম, খাদ্যাভাস, ব্যায়াম, আমাদের বিভিন্ন বিষয় সামাল দেওয়ার প্রক্রিয়া, সবকিছুই আমাদের মেজাজকে প্রভাবিত করতে পারে।

ক্যান্সার এবং হৃদরোগের মতো দীর্ঘমেয়াদী কষ্টদায়ক অসুস্থতা, যেমন আর্থ্রাইটিস

ভাইরাল সংক্রমণ যেমন 'ফ্লু' বা গ্ল্যান্ডুলার জ্বর, বিশেষ করে অল্পবয়সীদের মধ্যে

হরমোনের সমস্যা, যেমন সুপ্ত থাইরয়েড

এমন অবস্থা যা মগজ বা স্নায়ুকে প্রভাবিত করে।

শৈশবের ট্রমা

শৈশবের খারাপ অভিজ্ঞতা(শারীরিক, যৌন অথবা মানসিক), অবহেলা,বাবা-মায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সহিংস কোনও ঘটনা প্রত্যক্ষ করা, অথবা অস্থিতিশীল পারিবারিক পরিবেশ।

অ্যালকোহল ও মাদক ব্যবহার

নিয়মিত ঘন ঘন মদ্যপান করা অথবা গাঁজার মতো মাদক ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদে বিষণ্ণতার কারণ হতে পারে।

বংশগত কারণ

ডিপ্রেশনের কারন হিসেবে জিনগত ত্রুটির প্রমান পাওয়া গেছে।পিতামাতা বা নিকটাত্মীয় কারো ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা থাকলে কোন ব্যক্তির ডিপ্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে।

যেসকল শিশুর মা অথবা বাবার গুরুতর মানসিক রোগ আছে, তাদের মধ্যে প্রতি ৩ জনের মধ্যে ১ জনের মানসিক রোগ বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।

 ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার সাধারণ লক্ষণগুলো:

শারীরিকভাবে আপনার মনে হতে পারে যে:

-মনোযোগ কমে যাওয়া

- ক্লান্তি বোধ করা

-ভুলে যাওয়া

- ঘুমের সমস্যা যেমন-খুব ভোরে ঘুম ভাঙা বা ঘুম না হওয়া বা কখনো বেশি ঘুম।

- রুচির সমস্যা যেমন- খেতে ইচ্ছা না করা, খিদে না থাকা বা বেশি খাওয়া।

- ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া।

- যৌনস্পৃহা কমে যাওয়া।

- নিজেকে অপরাধী, ছোট ভাবা।

- মাথাব্যথা, মাথায় অস্বস্তি, মাথা-শরীর-হাত-পা জ্বালা করা, গলার কাছে কিছু আটকে থাকা, শরীর ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, বুক জ্বালা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি।

- কমফোর্ট ইটিং’র (মানসিক অবসাদের কারণে অপ্রয়োজনীয় খাবার খাওয়া)কারণে  ওজন বৃদ্ধি পাওয়া

মানসিকভাবে আপনার যা মনে হতে পারে –

-অসুখী, হতভাগা, নিরাশ, অবসাদগ্রস্ত — এই অনুভূতিগুলো লেগেই থাকবে এবং দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে আরও তীব্র হবে বিশেষত সকালে।

-মানুষের সাথে মেশার আগ্রহ কমে যাবে।

-সঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে না পারা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে যাওয়া।

-আত্মবিশ্বাস হারিয়ে নিজেকে দোষী এবং অযোগ্য মনে হওয়া।

অন্য মানুষের দৃষ্টিতে আপনার যা যা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে:

-কর্মক্ষেত্রে ভুল করা।

-অস্বাভাবিকভাবে শান্ত এবং অনাগ্রহী, অথবা লোকেদের এড়িয়ে চলা

-স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন

-স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খিটখিটে

-স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বা কম ঘুমানো

-সঠিকভাবে নিজের যত্ন না নেয়া

নিজে বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশনে ভুগলে কি করবেন?

যদি নিজের মধ্যে বিষণ্নতার উপস্থিতি বুঝতে পারেন, তবে নির্ভরযোগ্য বন্ধু, স্বজনকে বিষয়টি জানান, মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

 যেসব কাজ করতে আপনার ভালো লাগে বা লাগত, যাতে আপনি আনন্দ পান বা পেতেন, সেগুলো করুন।

 নিয়মিত গোসল করুন, নখ কাটুন, দাঁতের যত্ন নিন। পরিষ্কার পোশাক পরুন।

প্রথমবার মানসিক অবসাদে ভোগার পর দ্বিতীয়বার এই অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ, তাই সাহায্য দরকার হলে কীভাবে পাওয়া যাবে তা জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

সুতরাং, আপনার যদি মনে হয় যে কারও সাথে কথা বলা উচিত, নিজেকে আটকে রাখবেন না, কারণ এটাই আপনাকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সাহায্য করবে।

মাঝেমধ্যে অন্যদেরকে আপনার অনুভূতি বোঝাতে বেগ পেতে হতে পারে। হাল ছাড়বেন না এবং নিরাশ হবেন না, আপনি অবশ্যই সঠিক সাহায্য পাবেন।

প্রিয়জনের বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন কাটাতে আপনার করণীয়ঃ

প্রিয়জনের মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা দিলে তাঁকে দ্রুত মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যেতে সাহায্য করুন।

 সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে উৎসাহী করুন

ডিপ্রেশনের চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও -

তার কথা শুনুন: এটি সহজ শোনলেও বাস্তবে কঠিন হতে পারে। আপনাকে একই কথা বারবার শুনতে হতে পারে। কোনও সমস্যা নিয়ে রোগী পরামর্শ না চাইলে নিজ থেকে পরামর্শ দেবেন না, এমনকি আপনার কাছে পরিষ্কার সমাধান থাকলেও না।

তার সাথে সময় কাটান: মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তির সাথে সময় কাটানো তার জন্য সহায়ক। তাকে জানান যে আপনি তাদের পাশে আছেন, এটি তাকে কথা বলতে এবং সুস্থ হওয়ার জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে।

তাকে আশ্বস্ত করুন: মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে তিনি কখনও সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে বিশ্বাস করা কঠিন হবে। তাকে আশ্বস্ত করুন যে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন, তবে আপনাকে বারবার এটি করতে হতে পারে।

তাকে নিজের যত্ন নিতে সহায়তা করুন: তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার কিনছেন ও খাচ্ছেন কি না দেখুন, তার খাবারের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে ফলমূল ও সবজি থাকা নিশ্চিত করুন। তাকে বাইরে বের হতে এবং কিছু ব্যায়াম ও আনন্দদায়ক কাজ করতে সাহায্য করতে পারেন। অ্যালকোহল ও ওষুধের মাধ্যমে তাদের মানসিক অবস্থা ভালো করার প্রচেষ্টার চেয়ে এটি ভালো হবে।

তার কথা গুরুত্বসহকারে নিন: তার অবস্থা খারাপের দিকে গেলে, জীবন শেষ করে ফেলার কথা বললে অথবা এমনকি নিজের ক্ষতির কথা বললেও কথাগুলো গুরুত্বসহকারে নিন। নিশ্চিত করুন যে তিনি তার ডাক্তারকে এগুলো জানাচ্ছেন।

তাকে সহায়তা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন: তাকে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে, ওষুধ খেতে বা তার থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলরের সাথে কথা বলতে উৎসাহিত করুন। যদি তিনি তার চিকিৎসার বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন, তাহলে তাকে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করতে উৎসাহিত করুন।

নিজের যত্ন নিন: মানসিক অবসাদগ্রস্ত কাউকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের মানসিক শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হতে পারে, তাই নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখুন

Comments

    Please login to post comment. Login