ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। জানালার কাঁচের ওপারে অস্পষ্ট শহর। মেহরিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কয়েক মাস হলো সে বিধবা হয়েছে। তার জীবন যেন থমকে গেছে।
তার চারপাশের মানুষজন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে, কিন্তু সে পারেনি। রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটে, একা বিছানায় শুয়ে আরিফের কথা মনে পড়ে।
তার ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে সায়ন'এর নাম। অফিসের সহকর্মী, কিন্তু সম্পর্কটা কেবল সহকর্মীতেই সীমাবদ্ধ নেই।
— "হ্যালো?"
— "আপনি কি আবার মন খারাপ করে বসে আছেন?" সায়নের কণ্ঠে মৃদু হাসির ছোঁয়া।
— "তেমন কিছু না।"
— "আজ একটু বাইরে যাবেন? কফি খেতে?"
মেহরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, "না, আজ না।"
সায়ন হাল ছাড়ে না, "একদিন তো যেতে হবে। জীবনে ফিরে আসতেই হবে, মেহরিন!"
মেহরিন জানে, সায়ন ঠিকই বলছে। কিন্তু সে কি পারে সত্যিই জীবনে ফিরতে?
একজন বিধবা মেয়ের সমাজে টিকে থাকা খুবই কষ্টকর আর সেই সাথে আবার কম বয়স হলে তো কথাই নাই।
যে দিন বর মারা গেলো তার পর দিনেই মেহরিন কে ওর শশুর বাড়ী থেকে বাবার বাসায় পাঠিয়ে দেয় এই বলে যে আপনাদের মেয়ে আপনারা রাখেন আমাদের ছেলেকে তো খেয়ে ফেলল এখন না জানি আর কি হয়। তারপর থেকে বাবার বাসায়, লেখাপড়া জানা ছিল তাই এক মাস হলো একটা চাকরি করছে। নিজেকে তো টানতে হবে, না হলে তো বাবার উপর বোজ হয়ে যাবে, মেহরিন কে ওর বাবা মা অনেক আদর করে কিন্তু ভাই এর বউ তো আর বুজবে না তাছাড়া দিন শেষে ভাইও নিজের বউ কেই প্রাধান্য দেয়।
রাতের খাবার শেষে ফোন স্ক্রলে ব্যস্ত মেহরিন। হঠাৎ মেসেঞ্জারে একটা অচেনা নাম দেখে তার বুক কেঁপে ওঠে—ফারহান।
"কেমন আছো, মেহরিন?"
ফারহান—তার প্রথম প্রেম। কলেজের দিনগুলোতে তারা যেন আলাদা একটা দুনিয়ায় বাস করত। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝি আর অভিমান তাদের আলাদা করে দিয়েছিল।
মেহরিন দ্বিধাগ্রস্ত। উত্তর দেবে কি দেবে না?
শেষ পর্যন্ত শুধু লিখল—
"ভালো আছি।"
কিন্তু সত্যিই কি সে ভালো আছে?
এদিকে সায়ন প্রতিদিনই একটু একটু করে মেহরিনের জীবনে রঙ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি নামে। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা মেহরিন ছাতা আনেনি।
সায়ন এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলে, "বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যাবে।"
— "আমার কিছু হবে না," মেহরিন সংক্ষেপে উত্তর দেয়।
সায়ন হেসে বলে, "তাহলে আমিও ভিজব!"
সে ছাতাটা বন্ধ করে দেয়। দুজন একসঙ্গে ভিজতে থাকে।
মেহরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, "সায়ন, তুমি কেন আমার জন্য এত কিছু করো?"
— "কারণ আমি চাই তুমি আবার হাসো, আবার ভালোবাসো।"
মেহরিন কিছু বলে না। কিন্তু বুকের কোথাও যেন একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।
কিছু দিন পর ফারহান হঠাৎ করেই একদিন মেহরিনকে দেখা করার জন্য অনুরোধ করে।
ক্যাফেতে দেখা হয়।
— "তুমি এখনো আগের মতোই আছো, শুধু চোখগুলো একটু বেশি বিষণ্ণ হয়েছে," ফারহান মুগ্ধ চোখে বলে।
— "মানুষ বদলে যায়," মেহরিন সংক্ষেপে উত্তর দেয়।
ফারহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে, "তুমি কি জানো, আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম? তোমাকে হারানোর পর বুঝেছি, সত্যিকারের ভালোবাসা কী।"
মেহরিন কিছু বলে না, শুধু কফির কাপে চামচ নাড়তে থাকে।
ফারহান মেহরিনের হাতটা ছুঁয়ে বলে, "আমি ফিরে এসেছি, মেহরিন। এবার আর হারাবো না!"
মেহরিন দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। তার মন তোলপাড় হতে থাকে।
সায়ন আর ফারহান দুই দিক থেকেই ভালোবাসার টান দিতে থাকে মেহরিনকে।
একদিন সায়ন মেহরিনকে একটা কফিশপে নিয়ে যায়।
— "আমি তোমাকে ভালোবাসি, মেহরিন। আমি চাই তুমি আমাকে একটা সুযোগ দাও," সায়ন চোখে গভীর আকুতি নিয়ে বলে।
ঠিক তখনই দরজার বাইরে ফারহান দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভুল বুঝে ফেলে, ভাবে মেহরিন হয়তো সায়নকে ভালোবাসে।
ফারহান হতাশ হয়ে চলে যায়।
সেদিন রাতে মেহরিন ফারহানকে ফোন দেয়, কিন্তু ফারহান ফোন ধরে না।
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ করেই ফারহানের সঙ্গে দেখা হয়।
— "তুমি কি সায়নকে ভালোবাসো?" ফারহানের গলা কাঁপছিল।
মেহরিন বিভ্রান্ত হয়ে যায়, "কেন তুমি এমন বলছ?"
— "আমি দেখেছি, ওর সঙ্গে তুমি কতটা স্বচ্ছন্দ! আমি তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম!"
মেহরিন হতাশ কণ্ঠে বলে, "ভালোবাসা কি অপেক্ষার খেলা, ফারহান? তুমি যখন চেয়েছিলে, তখন আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে। আমি আর অতীতের সেই মেহরিন নেই!"
ফারহানের চোখে জল চলে আসে।
মেহরিন বুঝতে পারে, সত্যিকারের ভালোবাসা কখনোই দ্বিধাগ্রস্ত হয় না।
সে জানে, সায়ন তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে, তাকে সুখী দেখতে চায়।
এক সন্ধ্যায় সে সায়নকে ফোন দেয়—
— "তুমি কি আমাকে সত্যি ভালোবাসো?"
সায়ন চুপ করে থাকে, তারপর বলে, "এ প্রশ্নের উত্তর কি আমি দিতে হবে?"
— "তাহলে একটা কথা বলো, তুমি কি সারাজীবন আমাকে হাসাতে পারবে?"
সায়ন মৃদু হেসে বলে, "সারাজীবন নয়, তার চেয়েও বেশি সময় ধরে!!!
মেহরিনের মন অদ্ভুত এক দোটানায় আটকে থাকে।
একদিন সায়ন তাকে চা খেতে নিয়ে যায় শহরের এক নিরিবিলি জায়গায়।
— "একটা কথা বলো, মেহরিন," সায়ন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে।
— "কি কথা?"
— "তুমি কি একবারের জন্য হলেও চেয়েছিলে, আরিফের পরে কেউ তোমার জীবনে আসুক?"
মেহরিন চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর ধীরে বলে, "আমি জানি না। কখনো ভাবিনি।"
সায়ন হাসে, "ভাববে কবে? জীবন তো অপেক্ষা করবে না।"
সেদিন সায়নের কথাগুলো মেহরিনের মনে গভীর দাগ কাটে। সে বুঝতে পারে, সে চাইলেও জীবন থেকে পালাতে পারবে না।
কিন্তু তার ভাবনার মাঝেই আসে নতুন এক ভুল বোঝাবুঝি!
এই দিকে ফারহান নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। মেহরিন কে দেখার পর থেকে ওর মন শুধু মেহরিন এর কথাই মনে করিয়ে দেয়।
এভাবেই চলতে থাকে......
ফারহান একদিন হঠাৎ করেই মেহরিনের অফিসের সামনে চলে আসে।
— "তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।"
দীর্ঘদিন পর পুরনো প্রেমিকের চোখের দিকে তাকিয়ে মেহরিনের মন দ্বিধায় ভরে যায়।
— "আমার মনে হয় না, আর বলার কিছু আছে," মেহরিন শান্তভাবে উত্তর দেয়।
— "তবে কি সত্যিই তুমি সায়নকে ভালোবাসো?"
— "ফারহান!"
— "জানতে চাই, কারণ আমি আজও তোমাকে ভালোবাসি।"
এই বলে ফারহান মেহরিন এর হাতটা আবারো ধরে কিন্তু মেহরিন আজ হাত টা সরিয়ে দেয় না কারণ সেই মুহূর্তে মেহরিন মনের অজান্তে অনেক কিছু ভাবতে থাকে।
সেই মুহূর্তে সায়ন দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে ফেলে।
সে ভাবে, মেহরিন হয়তো এখনো ফারহানকে ভুলতে পারেনি।
সায়ন কোনো কথা না বলে চলে যায়, কিন্তু তার মন ভেঙে যায়।
সেদিন থেকে সায়ন বদলে যায়। সে আর মেহরিনের সঙ্গে আগের মতো হাসি-ঠাট্টা করে না, তার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে।
মেহরিন বুঝতে পারে, সায়ন কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু কী কারণে সে বোঝে না।
এভাবেই অনেক দিন চলতে থাকলো। কিন্তু ধীরে ধীরে মেহরিন আরও বেশি করে সায়ান কে অনুভব করতে লাগলো।
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়, মেহরিন মনের অজান্তে সায়ান কে ভাবতে থাকে। সায়ান মেহরিন কে একটু খুশি দেখে আরো কষ্ট পায়। সায়ান মনে মনে ভেবে নেয় নিশ্চয়ই ফারহান কে ভাবছে। মেহরিন হঠাৎ তাকাতেই সায়ান কে দেখে ওর কাছে আসতে যাবে, সায়ান সেখান থেকে চলে যায়।
মেহরিন এভাবে আর শয্য করতে না পেরে,
একদিন অফিসে মেহরিন সরাসরি জিজ্ঞেস করে, "সায়ন, তুমি আমার সাথে কেন এমন আচরণ করছ?"
সায়ন গভীর চোখে তাকায়, "তোমার কি সত্যিই কিছু বোঝার বাকি আছে?"
মেহরিন কিছু বলার আগেই সে চলে যায়।
সেই রাতে মেহরিন খুব কান্না করে। সে বুঝতে পারে, সায়নের অভাব তার হৃদয়ে শূন্যতা তৈরি করেছে।
সায়ন একদিন ট্রান্সফার নিয়ে অন্য শহরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অফিস এর কেও একজন ফোন করে মেহরিন কে জানায়।
মেহরিন খবর শুনে ছুটে আসে।
— "তুমি চলে যাচ্ছো?"
— "হ্যাঁ, তাতে কি আসে যায়?"
— "তুমি কি এভাবেই আমাকে ফেলে চলে যাবে?"
সায়ন একটু কষ্টের হাসি দিয়ে বলে, "তুমি তো আমাকে কখনো আটকে রাখোনি, মেহরিন!"
তখনই মেহরিন চোখের জল আটকাতে না পেরে বলে, "আমি ভুল বুঝেছিলাম, সায়ন! আমি কখনো বুঝতে চাইনি, কিন্তু আজ আমি জানি—আমি তোমাকে ভালোবাসি!"
সায়ন হতবাক হয়ে যায়।
মেহরিন চোখের জল মুছে সায়নের হাত ধরে বলে, "প্লিজ, থেকো!"
কিন্তু তখনও সায়ান বিশ্বাস করতে পারে না বলতে থাকে,টি তাহলে ওই দিন যা দেখলাম সব মিথ্যা তাই বলতে চাচ্ছো, সায়ান রাগ হয়ে বলল।
মেহরিন কিছুই বুজতে না পেরে, আবার বলল কি বলছো ঠিক করে বলো এই ভাবে আমি বুজতে পারছি না।
সায়ান রাগ হয়ে বলল ওই দিন কফি শপে যা হয়েছিল, আমি সব দেখেছি।
মেহরিন একটু সময় নিয়ে বললো, তুমি ফারহান এর কথা বলছ?
সায়ান বলল হ্যাঁ, তোমরা দুই জন হাত ধরে ছিলে। মনে পড়ছে,,,,,
মেহরিন বললো ওই দিন হাত ধরা টাই দেখতে পেলে, এর পর কি হলো সেটা দেখনি। ফারহান যখন আমার হাতটা ধরেছিল আমি ওই মুহূর্তে তোমার কথা ভাবছিলাম। যখন বুজতে পারলাম সাথে সাথে ওর হাত টা সরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, আমি সায়ান কে ভালবাসি। ওর সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাই।
সায়নের ঠোঁটে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে ওঠে।
— "যদি থেকে যাই, তুমি কি সত্যি আমাকে হাসতে শেখাবে?"
— "না," মেহরিন মাথা নেড়ে বলে, "তুমি আমাকে হাসতে শেখাবে!"
এই বলে দুইজন জড়িয়ে ধরলো নিজেদের।
এভাবেই মেহরিন আর সায়ান একে অপরকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার উপায় খুঁজে পেলো।।।।।।।