Posts

চিন্তা

বাংলা মায়ের অমর সন্তান প্রতুল মুখোপাধ্যায়

February 15, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

28
View

তীব্র জাতীয়তাবোধ কখনো কখনো ভালো যদি সেই তীব্রতায় অন্যের প্রতি ঘৃণা বা প্রতিহিংসা না থাকে। এমন ভালোর মহত্তম স্বাজাত্যবোধের চর্চাটাকে আজীবন জারি রেখেছিলেন বিপ্লবি গীতিকবি ও গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

বাংলা মায়ের নিখাদ সন্তান তাঁর মাকে মনে রেখেছিলেন সর্বান্তকরণে। রাজনৈতিক বিভাজনের বলি হয়ে নিজ জন্মভূমি হারিয়ে ফেললেও আপন মাটির মায়া কখনোই কাটিয়ে উঠেননি।

বাংলায় আর গান গাইবেন না, বাংলার গানও গাওয়া হবে না; বাংলার মায়াভরা পথটায় আর হাঁটবেন না মহৎ মানুষ প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

বরেণ্য গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী অশীতিপর প্রতুল মুখোপাধ্যায় মৃত্যুর আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আজ তিনি মহাকালের অসীম পথরেখায় পদার্পণ করলেন। আর কোনো দাবিদাওয়া রাখলেন না। যা দিয়ে গেলেন সেটাই হয়ে রইল অমরত্বের মহাসোপান।

১৯৪২ সালের ২৫ জুন অবিভক্ত বাংলার বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। দেশভাগের সময় সপরিবার ভারতে পাড়ি জমান তিনি। ছোটবেলা থেকেই নিজের লেখা গানে সুর দিতেন। তাঁর অনেক সৃষ্টির মধ্যে ২০১১ সালের মার্চে প্রকাশিত ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি সর্বমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। আজকের বাঙালির মধ্যে এই গানটি একবারও গুনগুনিয়ে গাননি এমন মানুষ মেলা ভার।

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় অ্যালবামের মধ্যে ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’, ‘যেতে হবে’, ‘ওঠো হে, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’, ‘তোমাকে দেখেছিলাম’, স্বপনপুরে’, ‘অনেক নতুন বন্ধু হোক’, ‘হযবরল’, ‘দুই কানুর উপাখ্যান’, ‘আঁধার নামে’ ইত্যাদি অগ্রগণ্য।

তিনি যদি কেবল আর কোনো গান না লিখে কেবলমাত্র 'আমি বাংলায় গান গাই'টিই লিখে যেতেন তবু তিনি বাংলা শিল্পাঙ্গনের ইতিহাসে মহিয়ান বলে অভিষিক্ত হয়ে থাকতেন।

অনেকেই তাঁকে বিপ্লবী ও অতি জাতীয়তাবাদী বলে ভ্রম করেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায় বরং গণমানুষের কাছের মানুষ হিসেবে বহুবছর আদৃত থাকবেন। ভাবীকাল তাঁর গানের চর্চা নিয়ে অধিকতর গবেষণা করলেই দেখবেন মিস্টার মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে কাঠিন্য বলে কিছু ছিল না। গানের মাধ্যমে তিনি মা, মাটি ও মানুষের মধ্যে এক ঐশ্বরিক ঔদার্য, ভীষণ সারল্য ও ঐন্দ্রজালিক মায়াবাদের চর্চা করেছেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানকে অন্তরে রাখলে হৃদয় আর্দ্র হয়, দেশাত্মবোধ জাগে, অনৈর্বচনীয় প্রেম ফল্গুধারার মতো উৎসারিত হয়।

প্রতুল মুখোপাধ্যায় গাইতেন যতটা না ভালো তার চেয়ে ঢের বেশি আবেগমথিত ও সংবেদনশীল ছিল তাঁর লেখনি। যেই লেখার কলমকে তিনি জনমদুখী বলে উল্লেখ করে তাকে বেচতে মানা করেছেন। পৃথিবীর তাবৎ কিছু বর্জন করে ফেলা যায়, কিন্তু অনুধাবনের চোখ, গহিন মনের করুণ কান্না, বাঁচিয়ে রাখা অসীম স্বপ্ন আর মনের কথা লিখবার স্বাধীনচেতা কলম কখনোই বেচা যায় না। তাই তো কবি প্রতুল মুখোপাধ্যায় বলেন:
আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাখর খানি
বেচোনা বেচোনা বন্ধু তোমার চোখের মণি।
কলা বেচো, কয়লা বেচো, বেচো মটরদানা
বুকের জ্বালা বুকেই জ্বলুক, কান্না বেচোনা।
ঝিঙে বেচো পাঁচ সিকেতে, হাজার টাকায় সোনা
বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচোনা।
ঘরদোর বেচো ইচ্ছে হলে, করব নাকো মানা
হাতের কলম জনম দুখী, তাকে বেচোনা।

শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: সাংবাদিক
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login