প্রথম দেখা: বৃষ্টি ভেজা রাত
রাত তখন প্রায় বারোটা। শহরের রাস্তায় টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, বাতাসে এক ধরনের বিষণ্নতার ছোঁয়া।
রিহান ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখ ছিল মোবাইলের স্ক্রিনে, কিন্তু মন ছিল শূন্য। হঠাৎ তার চোখ গেল রাস্তার এক কোণে—একটা মেয়ে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, নিঃসঙ্গ, অবিচল।
সে এগিয়ে গেল, "একটা ছাতা দরকার?"
মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল, কিন্তু মুখ দেখা গেল না, শুধু চোখ দুটো—অদ্ভুত বিষাদময়, যেন গভীর সমুদ্রের মতো কষ্ট লুকিয়ে আছে।
একটা শব্দও না বলে মেয়েটি দৌড়ে চলে গেল।
রিহান অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল, বুকের মাঝে অদ্ভুত কিছু অনুভব করল।
বারবার দেখা, বারবার টান
কয়েকদিন পর, এক বুক স্টোরে আবার দেখা হয়ে গেল।
"আবার দেখা হয়ে গেল, মিস বৃষ্টি?"
মেয়েটি তাকিয়ে অবাক হল। "আপনি?"
"তুমি সেদিন বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?"
মেয়েটি হাসল, কিন্তু সেই হাসিতে কষ্ট লুকানো ছিল। "কারণ বৃষ্টি কান্না ঢেকে দেয়।"
রিহান অনুভব করল, এই মেয়ে তার মতোই একাকী।
বয়সের ব্যবধান, তবু অন্তরের টান
রিহান জানত, এই সম্পর্ক ভুল। সে ৩৮, আরিয়া মাত্র ২৩।
কিন্তু যতবার সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে, ততবার ভাগ্য তাদের একত্র করেছে।
একদিন, এক পার্টিতে তুর্য—যে আরিয়াকে ভালোবাসত—রিহানের সামনে এসে দাঁড়াল।
"তুমি কি সত্যিই ভাবছ, এই বয়সের ব্যবধান পেরিয়ে তুমি ওর পাশে থাকতে পারবে?" তুর্য বিদ্রুপ করল।
রিহান কিছু বলল না।
কিন্তু সেদিন রাতে, আরিয়া রিহানের হাত ধরে বলল, "ভালোবাসা কি বয়স দেখে?"
সমাজের চোখ, বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা
সমাজ এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি।
আরিয়ার পরিবার বলল, "সে তোমার বাবার বয়সী!"
তুর্য রাগে ফেটে পড়ল। "তুমি কি জানো, সে কার সঙ্গে জড়িত ছিল?"
রিহান অবাক হয়ে তাকাল।
তুর্য একগাল হেসে বলল, "তোমার বাবার ব্যবসা কে ধ্বংস করেছিল, জানো? রিহান! সে তোমার বাবাকে দেউলিয়া করেছিল!"
আরিয়া শিউরে উঠল।
রিহান বোঝানোর চেষ্টা করল, "আমি জানতাম না যে... তোমার বাবা সেই ব্যবসায় জড়িত ছিলেন।"
কিন্তু আরিয়া বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল।
বিদ্রোহ ও ভালোবাসার পরীক্ষা
রিহান সব ছেড়ে চলে গেল।
আরিয়া ভেঙে পড়ল, তবুও পরিবারের চাপে বিয়েতে রাজি হতে বাধ্য হল।
বিয়ের দিন সকালে, তুর্য বিজয়ের হাসি হাসল।
কিন্তু সে জানত না, রাতের আঁধারে কেউ একজন নিঃশব্দে চলে গেছে...
আরিয়া একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে:
"আমি হয়তো তোমার সাথে থাকতে পারলাম না, রিহান। কিন্তু ভালোবাসা কখনো মরে না।"
আরিয়া সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল, ঢেউয়ের গর্জন তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছিল।
বহু বছর পর, এক বৃদ্ধ রিহান সেই জায়গায় এসে দাঁড়াল, হাতে আরিয়ার সেই শেষ চিঠি।
"অপেক্ষার শেষ হয়েছে, আরিয়া। এবার আমি তোমার কাছে আসছি..."
এরপর রিহান কিছু ভাবতে শুরু করলো ফ্ল্যাশব্যাকে
আরিয়ার বিদায়ের পর
আরিয়া চলে যাওয়ার পর, রিহানের জীবন থমকে গেল। সে আর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকল না, কোনো কিছুর প্রতিক্রিয়া দেখাল না।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর পরিবর্তনটা ঘটল তুর্যের মধ্যে।
আরিয়ার মৃত্যু তাকে উন্মাদ করে তুলল। সে আরিয়াকে ভালোবাসত, কিন্তু সে-ই ওর জীবন শেষ করে দিল! এই অপরাধবোধ থেকে পালানোর জন্য সে নেশায় ডুবে গেল, নিজের জীবনও ধ্বংস করে দিল।
অন্যদিকে, আরিয়ার পরিবারও ভেঙে পড়ল। তারা বুঝতে পারল, তাদের সিদ্ধান্তই মেয়ের জীবন শেষ করে দিল। কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না।
রিহানের প্রতিশোধ
তুর্যের প্রতারণা, পরিবারের নিষ্ঠুরতা—সবকিছু মিলিয়ে রিহানের একটাই লক্ষ্য হয়ে গেল।
সে প্রতিজ্ঞা করল, তুর্যকে ধ্বংস করবে।
শুরু হল এক ভয়ংকর খেলা।
রিহান ঠান্ডা মাথায় তুর্যের ব্যবসা ধ্বংস করল, তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করল।
একদিন, তুর্য এক অন্ধকার ঘরে মদের বোতল হাতে বসে ছিল। রিহান সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
"এত সহজে শেষ হতে দিচ্ছ না, তাই তো?" তুর্য হাসল।
"তুমি যা করেছ, তার শাস্তি পেতেই হবে," রিহান বলল।
"শাস্তি? আমি তো নিজেই মরে গেছি, রিহান! ও চলে যাওয়ার পর আমি আর কিছুই অনুভব করি না।"
রিহান চুপ করে রইল। সে জানত, আরিয়ার মৃত্যু শুধু তাকে না, তুর্যকেও শেষ করে দিয়েছে।
শেষ দেখা
বহু বছর পর, এক বৃদ্ধ রিহান সেই জায়গায় এসে দাঁড়াল, যেখানে আরিয়া শেষবারের মতো ছিল।
হাতে ছিল সেই পুরোনো চিঠি, যা সে এত বছর ধরে বুকে আগলে রেখেছিল।
সে চোখ বন্ধ করল। বাতাসে ভেসে আসছিল আরিয়ার হাসির প্রতিধ্বনি।
"অপেক্ষার শেষ হয়েছে, আরিয়া। এবার আমি তোমার কাছে আসছি..."
সাগরের গর্জনের মধ্যে রিহান ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল…
একটা গল্প শেষ হলো। কিন্তু ভালোবাসা কখনোই শেষ হয় না...