শীতের সকাল। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পুরো গ্রাম। বড় রাস্তার পাশের ছোট্ট কাঠের চায়ের দোকানটার সামনে বসে আছেন আনোয়ার চাচা। হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, পাশে পুরোনো একটা ট্রাঙ্ক। তার চোখ কিন্তু কুয়াশার চেয়েও ঘোলা—অপেক্ষার ধুলোমাখা বছরগুলো তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে।
— "আজও আসবে না বাবা?"
তার পাশে বসা দোকানি কাশেম মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
— "চাচা, আর কতদিন অপেক্ষা করবেন? ছেলে তো আসবে না!"
আনোয়ার চাচা কোনো উত্তর দিলেন না। শুধু দূর থেকে আসা প্রতিটা গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
আজ থেকে ১৫ বছর আগে...
সোহেল ছিল আনোয়ার চাচার একমাত্র ছেলে। পড়াশোনায় মেধাবী, সবার আদরের। ছোট গ্রাম থেকে শহরে পড়তে গিয়েছিল। স্বপ্ন ছিল বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে, বাবা-মাকে সব সুখ দেবে।
— "বাবা, আমি বড় কিছু হবো, দেখো!"
আনোয়ার চাচার তখন চোখে পানি চলে এসেছিল। তিনি ছেলেকে দোয়া দিয়ে শহরে পাঠিয়েছিলেন।
প্রথম কয়েক বছর চিঠি আসত, ফোন আসত। কিন্তু ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে গেল।
একদিন খবর এলো—সোহেল বিদেশ চলে গেছে। অনেক টাকা কামাচ্ছে। নতুন জীবন শুরু করেছে। কিন্তু একবারও ফিরে আসেনি।
মা কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে গেলেন। বাবা প্রতিদিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন।
— "আমার ছেলে আসবে। সে কথা দিয়েছে।"
গ্রামের সবাই বুঝিয়ে বলত—"চাচা, ছেলে ভুলে গেছে আপনাকে!"
কিন্তু আনোয়ার চাচা বিশ্বাস করতেন, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয় না।
আজও সেই একই জায়গায় বসে আছেন তিনি। চায়ের কাপ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। একটা বাস থামল।
একজন যুবক নামল, দেখতে অনেকটা সোহেলের মতো। আনোয়ার চাচা উঠে দাঁড়ালেন, চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
— "সোহেল!"
কিন্তু যুবকটা অন্যদিকে চলে গেল। তিনি আবার বসে পড়লেন, নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন।
সন্ধ্যায় কাশেম মিয়া এসে দেখলেন, আনোয়ার চাচা নেই। শুধু কাঠের বেঞ্চে পড়ে আছে একটা চিঠি।
"বাবা, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। যদি কখনো ফিরে আসিস, আমাকে কবরস্থানে খুঁজিস।"