প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক'-এর একটি কপি পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তিনি সেটি পড়ে একটি ছোট্ট প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। ১৩৩৫ সালের ২২ অগ্রহায়ণ শান্তিনিকেতনে বসে লেখা ওই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: 'কল্যাণীয়েষু, তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে। বড়ো জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উলটো। ইতি।'
১৯৩৭ সালে জীবনানন্দের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' প্রকাশিত হলে জীবনানন্দ এবারও এর একটি কপি রবীন্দ্রনাথকে পাঠান। সঙ্গে একটি চিঠি। বরিশালের সর্বানন্দ ভবন থেকে ১৯৩৭ সালের ৫ মার্চ লেখা ওই চিঠিতে জীবনানন্দ ৯ বছর আগে তাঁকে লেখা একটি চিঠির জন্য রবীন্দ্রনাথকে ধন্যবাদ জানান এবং স্বীকার করেন যে চিঠিটি তাঁর কাছে একটি মূল্যবান সম্পদ।
'ধূসর পাণ্ডুলিপি' পড়ে রবীন্দ্রনাথ আরেকটি চিঠি দেন মাত্র দুই লাইনে। ১৯৩৭ সালের ১২ মার্চ শান্তিনিকেতন থেকে লেখা ওই চিঠিতে কবিগুরু লেখেন—'তোমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।' দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের এই চিঠির সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জীবনানন্দের কবিতার বাঁক বদলের ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট। কেননা, প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক'-এ তাঁর যে ভাষা ও ঢং, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'তে তা থেকে বেরিয়ে একেবারে নিজস্ব ভাষা ও ঢংয়ে আবির্ভূত হন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মাত্র তিনটি শব্দে বলছেন, 'তাকিয়ে দেখার আনন্দ'; অর্থাৎ জীবনানন্দের কবিতার যে চিত্ররূপময়তা, রবীন্দ্রনাথ সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
অগ্রজ কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামেই ছয়টি কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশ।
সেই পঙ্ক্তিমালার একটি এমন...
অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমি অবশেষে
কোনো এক বলয়িত পথে
মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতন এক বিভা
দেখেছি রাত্রির রঙে বিভাসিত হয়ে আপনার প্রতিভা
বিচ্ছুরিত করে দেয় সংগীতের মতো কণ্ঠস্বরে।'
১৩৯১ সালে 'প্রতিক্ষণ' পত্রিকায় প্রকাশিত 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামে কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন, তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) জন্য পৃথিবী অপেক্ষা করছিল:
'তারপর তুমি এলে
এ পৃথিবী সলের মতন
তোমার প্রতীক্ষা করে বসেছিল।'
অতঃপর...
১৯৩৮ সালে কবিগুরু বিশ্বভারতী থেকে'বাংলা কাব্য পরিচয়' নামে বাংলা কবিতার যে সংকলন প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে জীবনানন্দের 'মৃত্যুর আগে' কবিতাটি তিনি সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলেন।
আজ আমরা আরেকবার সেই 'মৃত্যুর আগে' পাঠ করি...
আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;
আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:
পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;
আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত
এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে,
আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের ’পরে হাত,
সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;
শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ
আমরা পেযেছি যারা ঘুরে ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস;
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হ’য়ে ঝরেছে দু-বেলা
নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’যে গেছে তারে;
মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ‘য়ে আছে,
নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে,
খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে;
বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে;
আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল-লাল ফল
পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে;
যত নীল আকাশেরা র’য়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;
পথে-পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে;
আমরা দেখেছি যারা শুপুরীর সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ,
প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতে সবুজ সহজ;
আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর
পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
ক’য়ে গেছে; আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা;
চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির:
পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;
আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কি বুঝিতে চাই আর? . . . রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক
শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!
রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য শিল্পকর্মের তুল্য বিচারে কবিতা ছিল জীবনান্দের প্রথম পছন্দ। কবিগুরুর গানও জীবনানন্দ বেশ পছন্দ করতেন। বিয়ের প্রথম রাতে নবপরিণীতা লাবণ্যকে রবীন্দ্রনাথের 'জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে' গানটি গাইতে অনুরোধ করেছিলেন। লাবণ্য দাশ তাঁর লেখা 'মানুষ জীবনানন্দ' গ্রন্থে জানিয়েছেন, 'ফুলশয্যার রাতে তাঁর সর্বপ্রথম কথা হলো—আমি শুনেছি তুমি গাইতে পারো। একটা গান শোনাবে? আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা? “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে” গানটা যদি জান, তবে সেটাই শোনাও। আমার এখনও মনে পড়ে, প্রথমবার গাইবার পর তিনি আরও একবার গাইতে বললেন।' লাবণ্য জানাচ্ছেন, অনেক দিন পরে তিনি হাসতে হাসতে জীবনানন্দকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ফুলশয্যার রাতেই তিনি এই গানটি কেন শুনতে চেয়েছিলেন? তখন জীবনানন্দ হেসে উত্তর দিলেন, এই লাইন দুটির অর্থ বলো তো—'আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া,/ তোমার বীণা হতে আসিল নামিয়া'। লাবণ্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। জীবনানন্দ বললেন, জীবনের শুভ আরম্ভেই তো এ গান গাওয়া উচিত এবং শোনাও উচিত।
এমনই এক অভাবনীয় জীবনবোধের আনন্দে দেদীপ্যমান জীবনানন্দ দাশের কথা, গান, কবিতা। আমরা যতবার তাঁর ভাবরসে অবগাহন করি ততবার আমোদে আন্দোলিত হই। এমন মহত্তম আনন্দের সৃষ্টিকর্তা সেই জীবনানন্দে বুঁদ হয়ে থাকবার ঘোরলাগা নেশার অবসান কখনোই হবে না। না মৃত্যুর আগে না পরে।
শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি।
🫡
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
তথ্যঋণ:
আমীন আল রশীদ
দৈনিক প্রথম আলো