আকাশে মেঘের খেলা, অদ্ভুত দোলনের মতো। কখনো সাদা, কখনো ধূসর, কখনো হঠাৎ কালো। পুকুরের জলে তার প্রতিবিম্ব ঝিলমিল করে। বাতাসে এক ধরনের ভারি ভাব। পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি একা। সে নিশ্চুপ, এই নির্জন জায়গায়, যেন তার নিজের একটা গল্প আছে।
হালকা গোলাপি শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে, বাতাসে তার চুল উড়ছে। তার চোখে একধরনের গভীরতা, যা দেখে মনে হয় যেন সে কিছু খুঁজছে—কিন্তু সে নিজেই জানে না কী। পুকুরের পানি ছুঁয়ে যাওয়া বাতাস যেন তাকে ডাকছে। "মেয়ে..." শব্দটা বাতাসের সাথে মিশে যায়।
ঠিক তখনই পাতার ঝনঝন শব্দ আদারীকে চমকে দেয়। সে ফিরে তাকায়। সেখানে কেউ নেই। কিন্তু সে স্পষ্ট অনুভব করে যে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক অজানা ভয় জাগে তার মনে।
"কে?" সে এক ধরনের আতঙ্কে চিৎকার করে। কিন্তু কোনো উত্তর আসে না।
তার চারপাশের পরিবেশ আরও নিস্তব্ধ হয়ে যায়। পুকুরের পানিতে ঢেউ থেমে গেছে। বাতাস থেমে গেছে। যেন প্রকৃতি নিজেই এক শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত তৈরি করেছে।
হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে একটা ছায়ামূর্তি ভেসে এল। লম্বা কালো পোশাক পরা লোকটা ধীরে ধীরে কাছে এল। কালো মুখোশে মুখ ঢাকা। তার হাতে একটি লম্বা, চকচকে ছুরি। অধীরের শরীর অবশ হয়ে গেল। সে তার পা নাড়াতে চাইল, দৌড়াতে, কিন্তু তার পা মাটিতে আটকে গেছে।
"তুমি... কে?" তার গলা কাঁপছিল।
কোন উত্তর নেই। আগন্তুক এগিয়ে আসছে, এক এক ধাপ। মুখোশের ফাঁক দিয়েই তার চোখ দেখা যায়। এক ধরনের শীতল উন্মাদনা আছে ওই চোখে, যা অদ্রির শরীর দিয়ে শীতল স্রোত পাঠায়।
মেয়েটি শেষবারের মতো চিৎকার করে, "আমাকে বাঁচাও!"
কিন্তু পুকুরের ওপারের সজাগ গাছগুলোও তার চিৎকারে কাঁপে না। পুকুরের পানিতে ঝড় নেই। সবকিছু সত্ত্বেও পৃথিবী চুপ।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে লোকটি মেয়েটির হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। মেয়েটি লড়াই করছে, কিন্তু তার শক্তি কমে যাচ্ছে। ততক্ষণে ছুরিটা উঁচু হয়ে আছে।
প্রথম আঘাতটি মেয়েটির পাঁজরের ডান পাশে আঘাত করে। চিৎকারে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। রক্ত বের হয়ে পুকুর পাড়ে পড়ে। তারপর একের পর এক আঘাত। পুকুর পাড়ের ঘাস রক্তে ভিজে গেছে। প্রতিটি আঘাতে মেয়েটির শরীর কেঁপে ওঠে। তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
লোকটি তার কাজ শেষ করে ধীরে ধীরে চলে গেল। মেয়েটির নিষ্প্রাণ দেহটি পড়ে রইল। তার শরীর রক্তে ঢাকা, চুল এলোমেলো হয়ে মাটিতে পড়ে ছিল। পুকুরের জলে রক্তের দাগ দেখা গেল, আর জলের ঢেউ যেন ধীরে ধীরে রক্তে মিশে যাচ্ছে।
চারিদিকে নীরবতা। পাখিরা গান গাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। পুকুরের ওপারের ঝোপ থেকে একটা কাক ডেকে উঠল, যেন এই নিষ্ঠুরতার সাক্ষী।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি শুরু হলো। মেঘের খেলা বন্ধ হয়ে আকাশ থেকে এক প্রকার অশ্রু ঝরতে লাগল। বৃষ্টির ফোঁটা রক্ত ধুয়ে ফেললেও পুকুরের ঘোলা জলে একটা স্থায়ী ছাপ পড়ে যায়।
নিতি পুকুরের ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে শূন্যতা, মনে গভীর শূন্যতা। কিছু দিন আগে তার মা মারা গেছে, এবং এই পৃথিবী যেন তার জন্য থেমে গেছে। নিতি ছোটবেলায় মায়ের সাথে পুকুর পাড়ে বসে গল্প শুনত, হাসত, স্বপ্ন দেখত। আজ সেই পুকুরের জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখলেও মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। শীতল বাতাস তার চুল এলোমেলো করে দিলেও সে নড়েনি। মনে হচ্ছিল পুকুরের জল, মেঘলা আকাশ আর নিথির শূন্য দৃষ্টি—সবকিছু মিলে এক নীরব দুঃখ প্রকাশ করছে। নিথির চোখে একটাই প্রশ্ন, "মা তুমি কোথায়?"
আকাশে মেঘের গর্জন, পুকুর পাড়ে নিতি বাকরুদ্ধ হয়ে দেখছে। ছোট্ট মেয়ে নিথির মনে হয় তার জীবনে আনন্দ হারাম হয়ে গেছে। তার মা অনেক আগেই মারা গেছেন। তার সৎ মা তাকে প্রতিদিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। রাতের আঁধারে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিতি নিঃশব্দে পুরনো বইগুলো খুলে দেয়।
সৎ মায়ের একমাত্র সন্তানের দেখাশোনা করতে গিয়ে নিথিকে শুধু কাজের মেশিনে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু নিথির মনে পড়ে প্রতিশোধ আর মুক্তির স্বপ্ন। মেঘের গর্জনে মনে হয় প্রকৃতিও তার কষ্টে ব্যথিত।
পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে নিতি ভাবছে, এই জীবন কি কখনো বদলাবে? ধূসর আকাশ আর তার চারপাশের ভয়ংকর বাস্তবতা যেন এক হয়ে গেছে।
শীতের সকাল। কুয়াশায় আচ্ছন্ন এক নির্জন আমের বাগান। বাগানের মাঝখানের পুকুরটি নীরব, শান্তিপূর্ণ অথচ ভয়ঙ্কর। কিন্তু সেই নির্জনতা ভেঙ্গে যায় পুকুর থেকে ভেসে আসা জটিল গন্ধে। গ্রামবাসীরা প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত পুকুরের কাছে থামে।
পুকুরের পানিতে লাল দাগ। রক্তের ! তাতে ভাসছে এক তরুণীর দেহ। মেয়েটার সাদা শাড়িটা লালে ভিজে, চোখ দুটো আধো খোলা। মনে হয় যেন সে নীরব কান্নায় চিৎকার করছে। ভয় আর বেদনা তার মুখে লেগে আছে।
পুকুরের জল মৃদু ঢেউ তুলছে, কিন্তু সেই ঢেউগুলি তার চেয়ে বেশি কিছু বহন করছে বলে মনে হচ্ছে .
একটি ঠান্ডা স্রোত - মৃত্যুর ছায়া। আম গাছের ছায়া পুকুরের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে অদ্ভুত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। পুকুরের ধারে কিছু ভাঙা কাঁচ, চুলের স্ট্র্যান্ড এবং অন্যান্য ছোট চিহ্ন পড়ে আছে।
গ্রামের সবাই পুলিশ ডাকতে দেরি করেনি। মুহূর্তের মধ্যে সেখানে তদন্ত শুরু হয়। মেয়েটি কে? মেয়েটা এভাবে মারা গেল কিভাবে? পুকুরের এই ভয়াবহ দৃশ্য নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
পুলিশ এসে পুকুর থেকে মেয়েটির লাশ উদ্ধার করে। বাগানের নিস্তব্ধতায় প্রতিধ্বনিত হল পুলিশের সাইরেনের শব্দ। পুকুরের রক্তমাখা জল যেন মৃত্যুর সাক্ষী।
পুলিশ কর্মকর্তা রিহাদুল চৌধুরী তদন্ত শুরু করেন। সে তার পুরনো বন্ধু গোয়েন্দা রাহাত আহমেদকে ফোন করে এই জটিল খুনের সমাধানে সাহায্য করে।
রিহাদুল ও রাহাত দীর্ঘদিনের বন্ধু। কলেজ থেকেই তারা একে অপরের শক্তি। রিহাদুলের ধৈর্য এবং নিয়মতান্ত্রিক চিন্তা রাহাতের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং সূক্ষ্ম বিশ্লেষণাত্মক দক্ষতার সাথে মিশেছে। এই জুটি অনেক কঠিন মামলার সমাধান করেছে। এবারও একই দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। রাহাতের চোখ প্রশ্ন করে, "এটা কি শুধুই খুন, নাকি এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে?"
এই বাগানের মালিক আরমান কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। শরীরটা যে তার প্রেমিকের, সেটা বুঝতে পেরে সময় তার জন্য থেমে গেছে।
আরমানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, ঠোঁট কাঁপে। তার বুকের ভিতর ঝড় বয়ে যায়, তবুও সে বাইরে থেকে শান্ত থাকার চেষ্টা করে। সে চুপচাপ পকেট থেকে ফোন বের করে। সে গোপনে কাকে ডাকতে চাইছে? তার চোখে ভয়, গলায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বারবার ফিরে তাকায়, যেন কেউ তাকে দেখছে।
"সব শেষ," সে ফিসফিস করে বলে। তার কণ্ঠে আতঙ্ক আর অপরাধবোধের মিশ্রণ স্পষ্ট। ফোনের ওপারের মানুষটি কি অন্ধকারে তার সঙ্গী? নাকি এটা তার ভয় ঢাকবার চেষ্টা?
নিথি শান্ত, বিনয়ী মেয়ে। কিন্তু তার জীবন কেমন হয়েছে তা জেনে যে কারো হৃদয় ভেঙে যাবে। নিথির মা তাকে কখনো ভালোবাসার ছায়াও দিতে পারেনি। ছোটবেলা থেকেই নিতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। কিন্তু মামার গালাগালি তার মামার নিষ্ঠুরতায় ছাপিয়ে গেল।
নিথির মামা তার নিজের বোনের মেয়েকে এমন নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করেছে যে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। নিতি মামার বাড়ি গেলে চারপাশের বাতাস থেমে যেত। তার চাচার চোখ সবসময় তাদের মধ্যে একটি অদ্ভুত পৈশাচিক চেহারা ছিল.
একদিন রাতে, যখন সারা বাড়ি ঘুমিয়ে ছিল, তখন তার মামা নিথিকে তার ঘরে ডেকেছিলেন। নিতি ভয়ে কাতর হয়ে ঘরে ঢুকল। মামার মুখে একটা কুৎসিত হাসি ছিল এবং তার হাতের ভঙ্গি ছিল শিকারের জন্য প্রস্তুত সাপের মতো।
চাচা তাকে দেয়ালে ঠেলে দিলেন। নিতি চিৎকার করার চেষ্টা করল, কিন্তু তার মুখ শক্ত হাতে ঢেকে গেল। তার নিষ্পাপ শরীর হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর খেলার মাঠ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে চাচার অত্যাচার। নীথির চোখ থেকে অবিরাম যে অশ্রু প্রবাহিত হয় তা তার হৃদয়ে ধ্বংসের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
পরদিন সকালে নীথি সেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু সে বাকরুদ্ধ। তার শরীরে একাধিক ক্ষত আছে, কিন্তু তার মনে আরো গভীর ক্ষত। সে চুপ করে থাকে, যেন কিছুই হয়নি। কারণ সে জানে যে তাকে কেউ বিশ্বাস করবে না, কেউ তাকে সাহায্য করবে না।
নিথির অত্যাচারের গল্প তার জীবনের প্রতিদিনের অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই নির্যাতনের শেষ কোথায়? নিতি কি এই ভয়ংকর পরিবেশ থেকে মুক্ত হবে? নাকি তার জীবনের আলো চিরতরে নিভে যাবে?
এই ঘোর অন্ধকারে একদিন অদ্ভুত কিছু ঘটে গেল। রাতের আঁধারে নীথির মামা যখন তার ঘরে ঢুকলেন, তখন ঘরের বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। ঘরের কোণ থেকে ধীরে ধীরে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। নীথি ভয় পেয়ে বিছানার এক কোণে কুঁকড়ে যায়।
ছায়াটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল। নিথি দেখল ওটা ওর মা। কিন্তু মায়ের মুখে একটা অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর ভাব ছিল। তার চোখ দুটি আগুনের স্রোতের মতো, এবং তার ঠোঁটের কোণে রাগ জড়ো হচ্ছিল।
তার মায়ের আত্মা চাচার দিকে চলে গেল। নিথির চাচা প্রথমে ভয় পেলেও নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আত্মা তাকে গ্রাস করতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। নিথির মায়ের হাত, যেটা একসময় ওকে মারতে উঠত, এখন মামার গলায় চেপে ধরল।
"তুমি আমার মেয়েকে নষ্ট করেছ? তুমি আর বাঁচবে না!" পৃথিবীর সব রাগ যেন জড়ো হয়ে গেল নিথির মায়ের আত্মার গলায়।
তার মামা পালানোর চেষ্টা করলেও ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় কোন অদৃশ্য শক্তি। নীথি আতঙ্কিত হয়ে তার চাচাকে মেঝেতে পড়ে যেতে দেখে। তার মায়ের আত্মার চোখ আগুনের মতো জ্বলছিল। কিছুক্ষণ পর নিথির মামা শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন।
মায়ের আত্মা নিথির দিকে চলে গেল। নিতি ভয়ে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। মায়ের আত্মা তার মাথায় হাত রাখল।
"ভয় পেও না মা। আমি এখন সব ঠিক করে দেব।" মায়ের কন্ঠে এক অদ্ভুত কোমলতা ছিল, যেন মুছে দিতে চায় অত্যাচারের সব বেদনা।
তারপর তার মায়ের আত্মা ধীরে ধীরে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। নিতি বুঝতে পারল আজ তার জীবনের একটা অধ্যায় শেষ হয়েছে, কিন্তু আরেকটা শুরু হতে চলেছে।
এমনকি যদি তার মায়ের আত্মা তাকে রক্ষা করে তবে এই রাতের ভয়ানক স্মৃতি তাকে চিরকাল তাড়া করবে।
আত্মা প্রতিশোধ চায়। শবনম কুয়োর কাছে গিয়ে তার লাশ নিজের বাড়িতে করে নেয়। তান্ত্রিক বললেন, "এই আত্মাকে তুষ্ট করতে, আমাদের অবশ্যই তার মৃত্যুর বিচার দিতে হবে। ন্যায়বিচার না হলে তার আত্মা কখনই মুক্তি পাবে না।"
তান্ত্রিকের পরামর্শে গ্রামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। আয়েশার মৃত্যুর গল্প সবাইকে শোনানো হলো। গ্রামের প্রবীণরা তার প্রতি অবিচারের কথা স্বীকার করেন এবং তার আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
অবশেষে জটিল মন্ত্রের মাধ্যমে শবনমের শরীর থেকে আত্মাকে মুক্ত করেন তান্ত্রিক। এতে শবনম লুটিয়ে পড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিছুদিনের মধ্যেই সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু সেই রাতের স্মৃতি নিতি ও তার পরিবারের মনে স্থায়ী দাগ রেখে যায়।
গ্রামের কূপ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ, গ্রামের লোকেরা মানত করল
নিথির মায়ের আত্মা ভূত হয়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর গল্প শুরু হয়েছিল একটি অশুভ রাতে। নিথি গ্রামের নিষ্পাপ মেয়ে, বয়স মাত্র চৌদ্দ। তার মা, মিসেস শবনম, গ্রামের সবচেয়ে আদরের মহিলা ছিলেন। নিথির বাবা শফিক ছিলেন একজন কৃষক। পরিবারটি খুবই সাধারণ হলেও তাদের মধ্যে গভীর ভালোবাসা ছিল।
অশুভ রাতের শুরু
সেই রাতে চাঁদ মেঘে ঢাকা ছিল। গ্রামের প্রবীণরা বলতেন, এমন রাতে গ্রামে অশুভ আত্মা প্রবেশ করে। সেদিন গ্রামের কুয়া থেকে পানি আনতে গিয়েছিল শবনম। কিন্তু ফেরার পথে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সে হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে থেমে গেল। গ্রামের কূপ সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছিল, বিশেষ করে যখন রাতে সেখানে না যাওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়েছিল। সতর্কতা উপেক্ষা করেন শবনম।
রাত গভীর হলে শফিক লক্ষ্য করলো শবনম এখনো ফেরেনি। চঞ্চল নিথিকে নিয়ে মায়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। তাদের সঙ্গে যোগ দেন গ্রামবাসীরা। কূপের কাছে গিয়ে দেখেন শবনম নিথর পড়ে আছে। তার মুখ ভয়ঙ্করভাবে বিকৃত ছিল, তার চোখ খোলা ছিল কিন্তু এখনও. তিনি বেঁচে আছেন কি না তা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছে। হঠাৎ, মেয়েটি জোরে চিৎকার করে উঠল। দ্রুত শবনমকে বাসায় নিয়ে আসা হয়।
আচরণে পরিবর্তন
এ ঘটনার পর শবনমের আচরণে পরিবর্তন আসতে থাকে। নিথি আর শফিকের সাথে কথা বলার সময় সে খুব অনুপস্থিত থাকতো। মাঝে মাঝে গভীর রাতে তাকে বাড়ির আশেপাশে ঘুরতে দেখা যেত। সে প্রায়ই বলত যে কেউ তাকে ডাকছে। কে এই "কেউ" সে ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
শবনমের এই পরিবর্তন দেখে গ্রামের এক প্রবীণ রুহি দাদি বলেন, শবনমকে কোনো অশুভ আত্মা দখল করেছে। গ্রামের মসজিদের ইমামকে ডাকা হলো। ইমাম শবনমের জন্য কোরআন তেলাওয়াত করলেও শবনম তার সামনে ভয়ঙ্কর আচরণ শুরু করে। তার শরীর কাঁপতে শুরু করে, এবং সে এমন একটি কণ্ঠে চিৎকার করে যা সবাইকে আতঙ্কিত করে তোলে।
শবনমের আচরণের পরিবর্তন নিথির জীবনকে উল্টে দেয়। ওর মা মাঝে মাঝে ওর দিকে এমন ভাবে তাকাতো যেন নিথি ওর বাচ্চা নয়, অপরিচিত। একদিন রাতে নীথি লক্ষ্য করলো শবনম তার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। নিথি চিৎকার করে, কিন্তু শবনম হেসে বলে, "আমি তোমার মা নই, আমি তাকে নিতে এসেছি।"
এই ঘটনা নিথির উপর গভীর দাগ ফেলে। সে বুঝতে পারে তার মা আর আগের মতো নেই। সে তার বাবাকে বলে, কিন্তু শফিক তাকে বিশ্বাস করতে চায় না। ‘তোমার মা অসুস্থ, ভয় পেয়ো না’, তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে শফিক গ্রামের এক তান্ত্রিকের কাছে সাহায্যের জন্য যায়। তান্ত্রিক গ্রামের সীমানায় থাকতেন, এবং তার সম্পর্কে অনেক ভয়ঙ্কর গল্প শোনানো হয়েছিল। তিনি বলেন, শবনমের শরীরে একটি অশুভ আত্মা প্রবেশ করেছে এবং এই আত্মা সহজে মুক্তি পাবে না।
তান্ত্রিক একটি পূজার আয়োজন করে। পুজোর সময় হঠাৎ শবনম উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তুমি আমাকে থামাতে পারবে না, আমি এই শরীরেই থাকব। এই কথাগুলো এমন কন্ঠে বলা হয় যা একেবারেই শবনমের স্বাভাবিক কণ্ঠের মতো নয়। তার চোখ রক্ত লাল হয়ে যায় এবং তার শরীর অসাধারণ শক্তি অর্জন করে। পাঁচজনও তাকে ধরে রাখতে পারেনি।
অনেক চেষ্টার পর তান্ত্রিক জানতে পারলেন এই আত্মাটি আয়েশা নামের এক মহিলার, যে বহু বছর আগে গ্রামে মারা গেছে। আয়েশা খুব বীভৎসভাবে মারা গেল; তাকে গ্রামের কূপের পাশে হত্যা করা হয় এবং তার লাশ কূপে ফেলে দেওয়া হয়, যাতে তারা আর রাতে সেখানে যেতে না পারে।
এই গল্পটি শুধু নিথি ও তার মায়ের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার বর্ণনাই নয়, অতীতের অন্যায়-অবিচারের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তাও শিক্ষা দেয়।
পুলিশ লাশটি পোস্টমর্টেমে পাঠায়।
পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কি কোনো চমকপ্রদ তথ্য জানা যাবে? নিহতের পরিচয় কি? লাশের সাথে পাওয়া কোন বস্তু কি রহস্য সমাধান করতে সাহায্য করবে? এই মৃত্যুর পেছনে কি একাধিক লোক আছে? নাকি একক ব্যক্তির কাজ? গল্পের অন্য চরিত্রগুলো কি ঘটনার সাথে জড়িত বলে মনে হয়? তাদের ভূমিকা কি হতে পারে?
.....................................................................................................................................................