অনন্যার বয়স ৪০, কিন্তু তার জীবন থমকে গেছে অনেক আগেই। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল পরিবারের ছায়া, নির্ভরতার প্রতীক। বাবা-মায়ের বড় মেয়ে, তাই সংসারের সব দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়েছিল।
ছোটবেলা থেকেই সে শিখেছিল, মেয়েরা ত্যাগ করতেই জন্মায়। বাবা-মা তাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন, কিন্তু সেই ভালোবাসার ভেতর একটা চাপা দায়িত্বের বোঝা ছিল।
বাবা বলতেন,
— "তুই আমাদের বড় মেয়ে, সংসারের ভরসা। তোকে নিয়েই আমাদের সব স্বপ্ন।"
সে মাথা নিচু করে শুনে নিতো, বুঝে নিতো—তার নিজের জন্য আলাদা কোনো স্বপ্ন রাখা যাবে না।
যখন তার বয়স কুড়ি, তখন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ভাই তখনো পড়ছে, ছোট বোন তখন স্কুলে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায়। সংসারের খরচ চালাতে অনন্যা নিজের পড়াশোনা ছেড়ে চাকরিতে ঢুকে গেলো।
বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু মা বলেছিলেন,
— "তুই কি আমাদের ছেড়ে চলে যাবি? এই সংসারটা তোরও তো একটা দায়িত্ব!"
অনন্যা চুপচাপ হাসিমুখে মাথা নেড়েছিল।
তারপর বছর কেটে গেছে। ভাই বড় হয়ে ডাক্তার হয়েছে, বোন বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে সুখে সংসার করছে। বাবা-মাও নিশ্চিন্ত। শুধু অনন্যা রয়ে গেছে একা।
কিন্তু এই একাকীত্বের কথা কেউ বুঝতে চায়নি।
বছরের পর বছর সে শুধু পরিবারের জন্য ত্যাগ করেছে। কিন্তু কেউ কি একবারও তাকে জিজ্ঞেস করেছে,
"তুই কেমন আছিস, অনন্যা?"
সেদিন ছোট ভাইয়ের জন্মদিন ছিল।
অনন্যা সকাল থেকেই ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল, যদি কেউ তাকে দাওয়াত দেয়।
কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো, কেউ কিছু বললো না।
অবশেষে নিজেই ফোন করলো ভাইকে।
— "তুই কিছু বললি না তো, আমি কি আসবো?"
ওপাশ থেকে কেমন যেন অস্বস্তিকর গলা শোনা গেলো,
— "উফ দিদি, এখন বলছো? সবাই এসে গেছে, জায়গাও নেই ঠিকমতো। তাছাড়া, তোর তো এখানে এসে কি করবি? তোর না এমনিই একা থাকতে ভালো লাগে?"
অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।
গলার ভেতর দলা পাকিয়ে উঠল, কিন্তু স্বর একটুও কাঁপলো না।
— "হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস। একা থাকতেই অভ্যাস হয়ে গেছে।"
ফোনটা রেখে দেয়।
ঘরের কোণ থেকে অন্ধকার যেন তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আজীবন সে শুধু তাদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করলো, আর আজ তারা তাকে একটা রাতের দাওয়াতও দিতে ভুলে যায়?
চোখ বেয়ে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়ে।
অনেকদিন পর দরজায় বেল বাজলো।
দরজা খুলতেই অনন্যা থমকে গেলো।
আরিফ!
তার কলেজ জীবনের বন্ধু, তার জীবনের একমাত্র মানুষ, যে সত্যিকারের তাকে বুঝত। কিন্তু সেই সময়ে, যখন আরিফ ওকে বলেছিল,
— "অনন্যা, তুমি কবে নিজের জন্য ভাববে?"
সে কিছুই বলতে পারেনি।
আজ এত বছর পর সেই মানুষটাই আবার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের কোণায় একটু বয়সের ছাপ, কিন্তু দৃষ্টি ঠিক আগের মতোই গভীর।
— "এতদিন পরে এলেও কি দেরি হয়ে গেছে?"
কথাটা শুনেই বুকের মধ্যে কেমন একটা মোচড় দিলো।
অনন্যা হাসলো, কিন্তু সেই হাসিতে কষ্ট লুকিয়ে ছিল।
— "আমার জীবনে সবকিছুই দেরিতে আসে, আরিফ।"
— "কিন্তু আমি এখনো অপেক্ষা করছি, অনন্যা। তুমি কি আরেকবার বাঁচতে চাও?"
পরেরদিন ছোট বোন ফোন করেছিল।
— "দিদি, শোনো, তুমি যদি একা থাকতে না পারো, একটা বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাও। সবারই তো জীবন আছে, আমরা কি তোমার জন্য সব ছেড়ে দিতে পারবো?"
বুকটা ধক করে উঠলো।
এই সেই ছোট বোন, যার বিয়েতে সে নিজের সব সঞ্চয় খরচ করেছিল! যে রাতে ভয় পেত, তখন গায়ে গরম চাদর জড়িয়ে তাকে বুকে নিয়েছিল!
আজ সেই বোনই বলছে, "তুমি একা থাকলে সমস্যা হলে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাও!"
একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা বুকের ভেতর চেপে বসলো।
বুকের মধ্যে যেন হাজারটা ছুরির আঘাত পড়লো।
কিন্তু এবার সে কাঁদলো না।
তারপর ধীরে ধীরে ফোনটা রেখে দিলো।
অনন্যা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সন্ধ্যার বাতাসে তার চুল উড়ছিল।
পাশে এসে দাঁড়ালো আরিফ।
— "তারা তোকে বুঝতে পারেনি, অনন্যা। কিন্তু আমি জানি, তুই কত কষ্ট পেয়ে বেঁচে আছিস। এখনো সময় আছে, নিজের জন্য ভাব।"
অনন্যা চোখ বন্ধ করলো।
সারাজীবন সে শুধু পরিবারের জন্য ছিল। তারা তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।
কিন্তু এখন?
সে কি নিজেকে ভালোবাসতে পারবে?
আরিফ ধীরে ধীরে তার হাতটা ধরলো।
অনন্যা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো।
অনেকটা দেরিতে হলেও, এবার সে নিজের জন্য বাঁচবে।
চাঁদের আলোয় একলা মেয়েটা এবার আর একা রইলো না।
শেষ।