শূন্য হাট
অধ্যায় ১: সকাল যখন বোঝা হয়ে ওঠে
রাত পেরিয়ে ভোর হলো। সূর্যের আলোয় আলোকিত হলো পশ্চিমবঙ্গের ছোট্ট গ্রাম কল্যাণপুর। কিন্তু এই আলো যেন কোনো নতুন আশা বয়ে আনল না অরিন্দম-এর জীবনে।
৩০ বছর বয়স হয়ে গেল, কিন্তু এখনো কোনো স্থায়ী চাকরি নেই। প্রতিদিন সকালে উঠে খবরের কাগজের "জব সেকশন" দেখা তার এক অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, অথচ মাসের পর মাস কেটে গেলেও কোথাও কোনো সুযোগ নেই।
তার মা রমলা দেবী জানে, ছেলেটা ভেতরে ভেতরে কত কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু মা তো সবসময় সন্তানকে সাহসই দেয়।
— "বাবা, চেষ্টা করে যা, একদিন না একদিন ঠিক হবে!"
অরিন্দম হেসে বলে, "হ্যাঁ মা, একদিন ঠিক হবে। কিন্তু কবে?"
মায়ের চোখে জল আসে। সে জানে, এই কথা শুধু নিজেকে প্রবোধ দেওয়া।
---
অধ্যায় ২: চাকরি! চাকরি! চাকরি!
অরিন্দমের মতো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রতিদিন শহরের অফিসগুলোর সামনে ভিড় জমায়। কেউ কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে, কেউ ইন্টারভিউ দিয়ে বেরিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটছে।
একদিন অরিন্দম এক বড় কোম্পানির চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেল। তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল রবি।
রবি বলল, "ভাই, কত বছর ধরে চাকরির চেষ্টা করছো?"
অরিন্দম একটু হেসে বলল, "প্রায় ৭ বছর ধরে!"
রবি একরকম হতাশ হয়ে বলল, "আমার ৫ বছর। আমাদের দেশে ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও আমরা শুধু লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি।"
ভেতরে ডাক পড়ল। প্রায় ৩০ মিনিট ধরে ইন্টারভিউ হলো। কিন্তু বেরিয়ে আসার সময় দু’জনের চোখেই ছিল একরকম হতাশা। কোম্পানির প্রতিনিধি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে— "এক্সপেরিয়েন্স লাগবে!"
কিন্তু অভিজ্ঞতা আসবে কীভাবে, যদি কাজই না দেওয়া হয়?
---
অধ্যায় ৩: শেষ সম্বল
অরিন্দমের পরিবার একসময় স্বচ্ছল ছিল। তার বাবা ছোট্ট একটা দোকান চালাতেন, কিন্তু লকডাউনের পর দোকান বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের একমাত্র রোজগারের পথও বন্ধ হয়ে গেল। এখন তাদের যা কিছু জমা টাকা ছিল, ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে।
তার বন্ধুরা কেউ কেউ জোমাটো-সুইগি ডেলিভারি বয়, কেউ অ্যাপ বেসড কাজ করছে। অরিন্দমও ভেবেছিল অটো চালাবে, কিন্তু তার নিজের কোনো গাড়ি নেই।
একদিন সে তার মাকে বলল, "মা, টিউশন পড়াবো। বাচ্চাদের পড়িয়ে কিছু টাকা আয় করবো।"
মা রাজি হলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, তার গ্রামে বেশিরভাগ গরিব পরিবার, যারা নিজেদের বাচ্চাদের জন্য কোনো বাড়তি খরচ করতে পারে না।
অরিন্দম বুঝতে পারল, সে যেন এক অদৃশ্য দেয়ালে আটকে গেছে।
---
অধ্যায় ৪: শহরের বিভ্রম
একদিন সে সিদ্ধান্ত নিল দিল্লি যাবে, বড় শহরে কাজ খুঁজবে। কিছু ধারদেনা করে ট্রেনে উঠে বসল।
দিল্লিতে নামার পর সে বুঝতে পারল, এখানে তার মতো লাখ লাখ মানুষ আছে, যারা এক চাকরির আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একদিন এক হোটেলে বসে চা খাচ্ছিল, পাশের টেবিলে এক বৃদ্ধ বসে ছিলেন। তিনি বললেন,
— "বাবু, তুমি তো শিক্ষিত, চাকরি না পেলে ব্যবসা করো!"
অরিন্দম ম্লান হেসে বলল, "ব্যবসার জন্য পুঁজি লাগে, যা আমার নেই।"
বৃদ্ধ একগাল হেসে বললেন, "আমাদের দেশে বেকারত্ব কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো সুযোগের অভাব।"
এই কথা শুনে অরিন্দম ভাবতে লাগল, তাহলে কি আমরা কেবল এক নিষ্ফল প্রতিযোগিতার দৌড়ে ছুটছি?
---
অধ্যায় ৫: ফিরে আসা এবং নতুন শুরু
দুই মাস শহরে ঘুরে কাজ না পেয়ে অরিন্দম আবার গ্রামে ফিরে এলো। তবে এবার সে হাল ছাড়েনি।
সে দেখল, তার গ্রামে অনেকেই এখনও কৃষি নির্ভর, কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি নেই। তাই সে ঠিক করল, এগ্রো-টেক নিয়ে কাজ করবে।
একটি পুরনো লোন স্কিমের কথা মনে পড়ল তার, যেটা স্টার্টআপ ব্যবসার জন্য সরকার দেয়। অনেক চেষ্টা করে সে লোন পেল এবং জৈব সার ও আধুনিক চাষাবাদের কাজ শুরু করল।
প্রথমে ছোট আকারে, তারপর ধীরে ধীরে গ্রামের আরো বেকার যুবকদের নিয়ে সে তার কাজ বাড়াল। তার স্টার্টআপ সফল হলো, এবং একসময় সরকারি সংস্থাও তার প্রজেক্টে সাহায্য করল।
---
অধ্যায় ৬: বদলে যাওয়া গল্প
অরিন্দম আজ সফল উদ্যোক্তা। একসময় যে নিজে কাজ খুঁজতে ঘুরে বেড়িয়েছে, সে এখন অন্যদের চাকরি দিচ্ছে।
একদিন সে সেই বৃদ্ধের কথা মনে করল—
"আমাদের দেশে বেকারত্ব কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো সুযোগের অভাব।"
সত্যিই তো! চাকরির পেছনে না ছুটে যদি নতুন কিছু করার চেষ্টা করি, তাহলে হয়তো বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
আজ তার কোম্পানির নাম "শূন্য হাট", যার লক্ষ্য— গ্রামের কৃষকদের উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে আত্মনির্ভরশীল করা।
আর সে নিজে? এখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখে, তবে এবার স্বপ্নগুলো সত্যি করার জন্য কাজও করে।
---
শেষ কথা
ভারতের কোটি কোটি বেকার যুবকের জীবনের প্রতিচ্ছবি এই গল্প। অরিন্দম একজন প্রতীক, যে দেখিয়ে দেয়—হাল ছাড়লে কিছুই সম্ভব নয়, কিন্তু লড়াই করলে সাফল্য আসবেই।
"তোমার সামনে দুটি রাস্তা—একটা হলো অভিযোগ করা, আরেকটা হলো নিজেই সমাধান বের করা। তুমি কোনটা বেছে নেবে?"
"শূন্য হাট"—একটি বাস্তবতাকে তুলে ধরা গল্প, যা প্রতিটি ভারতীয় যুবকের মন ছুঁয়ে যাবে।
---
(শেষ)