চীনের এক ছোট্ট গ্রাম, পাহাড় আর কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক রহস্যময় স্থান। সেই গ্রামের মানুষরা এক পুরনো কাহিনি বিশ্বাস করত—প্রতি একশ বছর পর চাঁদের রাজকুমারী পৃথিবীতে নেমে আসেন, তার হারিয়ে যাওয়া প্রেম খুঁজতে। কেউ একে নিছক গল্প বলে উড়িয়ে দিত, কেউ চোখের আড়ালে রাখা এক সত্য বলে মানত।
কিন্তু লিয়েন? সে এসব কাহিনি বিশ্বাস করত না। জীবন তার জন্য ছিল বাস্তব, আর বাস্তবতার মধ্যে কোনো রূপকথার জায়গা নেই। এভাবেই চলতে থাকলো।
হঠাৎ একদিন লিয়েন গ্রামবাসীর কানাঘুষা শুনছিল, যে কাল সেই দিন আসছে চাঁদের রাজকুমারী নামতে পারে। কেও কেও আবার বলছে এমএম যদি না আসে। তখন একজন বৃদ্ধ মা বলল বেশি কথা বলো না তোমরা ১০০ বছর হলেই এটা হয় আর সাথে বিশেষ একটা কারণ ও থাকে যদি চাঁদের রাজকুমারীর কাও কে পছন্দ হয় তাহলে আসে। দেখো এবার কাও কে পছন্দ হয় কিনা। তারপর বৃদ্ধ মা বলল শোনো যুবকরা তোমরা এই রাজকুমারীর কথায় আসবে না কিন্তু। না হলে তোমরা শেষ হয়ে যাবে, পাগল হয়ে যাবে বললাম।
এই সব কথা শুনে লিয়েন মনে মনে হাসতে লাগলো। এমন সময় লিয়েন ওর ছোট বেলার বন্ধুর সাথে দেখা। ও ফুজিটা,
কিরে লিয়েন এত হাসির কারণ......
ফুজিটা আর বলিস না, একটু আগে যা শুনল তাই ফুজিটা কে লিয়েন শুনালো....
কিন্তু ফুজিটা বলল কিন্তু আমি বিশ্বাস করি।
শোন লিয়েন তুই একটু দেখেশুনে থাকিস,,, এই বলতে বলতে ওরা ওদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল....
দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরল লিয়েন। রাত প্রায় গভীর হতেই , লিয়েন এর মা ডাক দিলো। বাবা শুনে যা.....
লিয়েন যেতেই বলল বাবা আমি গরু টা আজ আনতে একদম ভুলে গেছি তুই নিয়ে আসবি ? ওই ঝিলের জলের ধারে বেঁধে রেখেছিলাম। আচ্ছা আমি দেখছি, এই বলে বের হলো লিয়েন। খুব তাড়াতাড়ি যাচ্ছিল কারণ ওদের ঘর গরুর দুধ দিয়ে চলে। ঝিলের কাছে আসতেই দেখে যে গরু টা ওই খানেই আছে। তাতে মনে শান্তি হলো।তারপর...
সেই রাতটা ছিল এক অভিশপ্ত সুন্দর রাত। পূর্ণিমার আলোয় নদীর জল রুপোর মতো ঝলমল করছিল। লিয়েন নদীর ধারে বসে মাটি ছুঁয়ে অনুভব করছিল, হঠাৎ তার শরীর হিমশীতল হয়ে গেল—পেছন থেকে কে যেন তার নাম ধরে ডাকল।
সে ফিরে তাকিয়ে যা দেখল, তাতে তার নিঃশ্বাস আটকে গেল।
এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝিলের জলে। না, সে হাঁটছে না—সে সত্যি সত্যি ভাসছে!
তার গায়ে রূপার মতো উজ্জ্বল পোশাক, চুল যেন গভীর রাতের অন্ধকার, আর চোখ… ঠিক যেন চাঁদের টুকরো।
লিয়েন বিস্ময়ে ফিসফিস করল, "তুমি… মানুষ নও, তাই না?"
মেয়েটি হাসল, এক অসম্ভব মায়াময় হাসি, যেন সে স্বপ্নের জগত থেকে উঠে এসেছে।
"আমি চাং মেই। আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছি, লিয়েন।"
লিয়েন জানত না কেন, কিন্তু তার হৃদয় তখনই তীব্রভাবে ধুকপুক করে উঠল, যেন বহু যুগ ধরে সে এই কণ্ঠস্বরের অপেক্ষায় ছিল।
এক অলৌকিক ভালোবাসা, আর লিয়েন কেমন একটা অন্য মায়ায় জড়িয়ে পড়ল। লিয়েন বলল যে তুমি চাঁদের রাজকুমারী তাই না।
চাং মেই হেসে বলল তুমি ভুলে গেছো আগামী কাল আসার কথা তাই না, আজ কিভাবে হবে বলো। সব গ্রামবাসী বলছে এই কথা।
লিয়েন একটু জিভ এ কামড় দিয়ে বলল তাই তো!
তাহলে কি তোমার পরিচয় আর এত রাতে এখানে?
চাং মেই বলল আসলে আমি পাশের গ্রামে থাকি, আজ আমাকে দেখতে আসছিল কিন্তু.....
লিয়েন বলল কিন্তু....
চাং মেই বলল কিন্তু আমাকে ওরা পছন্দ করে নি , তাই মন খারাপ আমার
এই বলতেই লিয়েন হাসি দিয়ে বলল,,, মিথ্যা বলছ, এত সুন্দর তুমি তোমাকে কে মানা করবে।
চাং মেই বলল এই নিয়ে ২১ জন মানা করলো। আমি বেশি সুন্দর তাই। এটা কি আমার অপরাধ?
লিয়েন আর চাং মেই অনেক কথা বলল। এর পর দুই জন যার যার বাসায় চলে গেলো।
পরদিন রাতে লিয়েন ঘুমাতে পারছে না, কারণ দিনের বেলায় কয়েক বার ঝিলের ধারে যেয়ে ফিরে আসছে
চাং মেই কে দেখে নি...
তাই ভাবছে কি করবে, কিন্তু মনের সাথে পারল না। চলে গেলো ঝিলের কাছে, ঠিক যেয়ে দেখলো চাং মেই বসে আছে। লিয়েন বলল তুমি
চাং মেই হ্যাঁ তোমার কথা মনে পড়লো, তাই চলে আসলাম। দিনের বেলায় আসতে পারি নি কারণ অনেক লোকজন থাকে, কে কি ভাবে তাই।
এইভাবে দুই জনের মধ্যে অনেক প্রেম হয়ে গেলো।
চাং মেই দিনের আলোতে হারিয়ে যেত, কেবল রাতের আঁধারে সে দেখা দিত। তারা দুজন চুপিচুপি ঝিলের ধারে বসে থাকত, চাং মেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত, আর লিয়েন তার দিকে।
এক রাতে লিয়েন তার জন্য কাদামাটি দিয়ে একটা ছোট্ট চাঁদের মূর্তি বানিয়ে বলল, "তুমি যদি চলে যাও, তাহলে আমি এই চাঁদের দিকে তাকিয়ে তোমায় মনে করব। কিন্তু আমি চাই না তুমি যাও…"
চাং মেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। "আমিও চাই না। কিন্তু আমার জন্য সময় কম। পূর্ণিমার রাতে দেবতারা আমাকে নিয়ে যাবে।"
লিয়েন হতবাক হয়ে গেল। "না! তুমি আমার… আমার সঙ্গেই থাকবে!"
চাং মেই হেসে বলল, "ভালোবাসা কি ধরে রাখা যায়, লিয়েন?"
কেনো আমি তোমাকে বিয়ে করব এই বলতে বলতে লিয়েন একটু থেমে গেল..... এরপর ...... তুমি কি বললে চাং মেই পূর্ণিমার রাতে দেবতারা তোমাকে নিয়ে যাবে।" মানে কি
তুমি আমাকে এত দিন সব মিথ্যা বলেছ??? লিয়েন যেনো একটা গভীর শোকের ছায়ায় ডুবে যেতে লাগলো।
চাং মেই লিয়েন কে একটা গভীর আদর দিলো ঠোঁটে। আর বলল আমি সত্যিই তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি লিয়েন। এমন হবে আমি বুঝিনি....
তুমি আমাকে মাফ করে দাও
লিয়েন খুব ভেঙে পড়ল।
কিন্তু কি আর করবে যা হবার তাই হলো।
এভাবে চলতে থাকলো। একদিন লিয়েন বললো চাং মেই তুমি তো চলে যাবে? আমি তোমার সাথে এই মুহূর্ত নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে চাই।
চাং মেই বললো আমি জানি....
লিয়েন আবার বললো,,,, আমি তোমার সাথে আরও অনেক অনেক কাছে আসতে চাই আর এই অনুভূতি নিয়ে সারাজীবন থাকতে আমার একটু সহজ হতো। যদি তুমি চাও ।জোর করতে চাই না তোমাকে
এই বলা লিয়েন এর শেষ হতেই না হতেই চাং মেই
লিয়েন কে জড়িয়ে ধরে শরীরের সব জায়গায় চুমো খেতে লাগলো অনেক আবেগ নিয়ে , যেনো এই কথার অপেক্ষায় ছিল.....
দুই জন এক হয়ে গেলো, এত উত্তেজনা ছিল দুইজনের মধ্যে ,দুই জনের চোখের থেকে পানি পড়ে গেলো।
এরপর লিয়েন বলল ধন্যবাদ চাং মেই। এই মুহূর্ত নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে চাই এই বলে দুইজন আবার নিজেদের আটকাতে পারল না আবার মিলনে আগ্রহী হয়ে গেলো।
অপেক্ষার শেষ রাত
দিনগুলো উড়ে গেল বাতাসে ভেসে যাওয়া পাপড়ির মতো। শেষ রাত এসে পড়ল।
লিয়েন চাং মেইর হাত শক্ত করে ধরে বলল, "যদি তোমায় হারাই, তবে আমার পৃথিবী ফাঁকা হয়ে যাবে।"
চাং মেই চোখ বন্ধ করল, তার ঠোঁট কাঁপছিল। "আমি যদি মানুষের মতো জন্মাতাম… তবে তোমার সঙ্গে থেকে যেতে পারতাম।"
ঠিক তখনই, আকাশ ঝলমল করে উঠল, যেন স্বর্গের দরজা খুলে গেছে। বাতাস থমকে গেল, ঝিলের জল নড়াচড়া বন্ধ করে দিল।
চাং মেইর শরীর আলোর কণায় ভেঙে যেতে লাগল।
লিয়েন চিৎকার করে উঠল, "না! আমি তোমায় যেতে দেব না!"
সে শক্ত করে চাং মেইর হাত ধরল, কিন্তু তার আঙুলগুলো হাওয়ার মতো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। চাং মেই চোখের কোণে একফোঁটা জল এনে ফিসফিস করে বলল,
"আমার যদি দ্বিতীয় জীবন থাকে, আমি তোমার কাছেই ফিরে আসব…"
এবং ঠিক সেই মুহূর্তে, সে চাঁদের আলোয় মিশে গেল, একরাশ নরম আলোর কণা হয়ে। আর লিয়েন এর হাতের মুঠোয় এক টুকরো পাথর রয়ে গেলো। যা এখনও লিয়েন এর কাছে থাকে।
অমর অপেক্ষা
সেই রাতের পর, লিয়েন আর কখনো হাসেনি। সে শুধু পূর্ণিমার রাতে ঝিলের ধারে বসে থাকত, তার হাতে সেই ছোট্ট মাটির চাঁদের মূর্তি।
লোকেরা বলে, আজও যদি কেউ গভীর রাতে ঝিলের ধারে আসে, তবে সে দেখতে পাবে দুটি ছায়া, একটা লিয়েন এর যে একা বসে আছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে। আর একটা ছায়া কার সেটা কেও জানে না, কিন্তু লিয়েন এর পাশে সবসময় থাকে........
"ভালোবাসা কি সত্যিই কখনো মরে যায়? নাকি তা চাঁদের আলো হয়ে ফিরে আসে, অপেক্ষার রূপ নিয়ে?"