◾অনেকের ধারণা বাংলাদেশে সুশাসন দেয়া সম্ভব নয়। এই কথার বাস্তবতা কতটুকু?
বাংলাদেশে সুশাসন দেওয়া সম্ভব নয়—এমন সিদ্ধান্তে আসার আগে এটা বোঝা জরুরি যে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কী কী বাধা রয়েছে। বাংলাদেশে সুশাসন নিশ্চিত করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তবে কিছু প্রধান কারণ সুশাসনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়:
১. প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা:
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন—এসব সংস্থার কার্যকারিতা অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে সুশাসন ব্যাহত হয়।
২. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি:
প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বিদ্যমান। রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যক্তিগত স্বার্থ অনেক সময় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, যা সুশাসনের পথে বড় বাধা।
৩. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি:
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতার অভাব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে সহিংসতা প্রায়ই দেখা যায়। দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ও নীতিগত ধারাবাহিকতা নিশ্চিত না হওয়ায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ে।
৪. আইনের শাসনের দুর্বলতা:
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অপরাধীদের বিচার না হওয়া, রাজনৈতিক বিচারহীনতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিশেষ সুবিধা পাওয়ার প্রবণতা—এসব কারণে জনগণের আইনের প্রতি আস্থা কমে যায়।
৫. প্রশাসনিক জটিলতা ও অদক্ষতা:
প্রশাসনের স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও দায়বদ্ধতার অভাব থাকায় সরকারি সেবা কার্যকরভাবে জনগণের কাছে পৌঁছায় না। আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা জনগণের আস্থা নষ্ট করে।
৬. সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা:
একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ সুশাসনের জন্য অপরিহার্য। তবে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিছু ক্ষেত্রে সংকুচিত হয় এবং নাগরিক সমাজের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হয় না।
৭. জনগণের সচেতনতার অভাব ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুর্বলতা:
জনগণ যদি তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হয়, তাহলে তারা সঠিকভাবে তাদের নেতা নির্বাচন করতে পারে না। ফলে অযোগ্য বা স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা ক্ষমতায় আসে।
সমাধানের উপায়:
সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে—
✅ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও শক্তিশালী ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।
✅ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
✅ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
✅ স্বাধীন বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
✅ নাগরিকদের সচেতন ও শিক্ষিত করতে হবে, যাতে তারা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে।
সুশাসন সম্ভব নয় নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জনগণের সচেতনতা ও কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার—এসব নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশেও সুশাসন বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
◾কিন্তু এখানকার মানুষের প্রধানতম সংস্কৃতি হলো অপরাধপ্রবণতা। কেউ কেউ বলতে চান, আমরা জাতিগতভাবে হয়ত পূর্বপুরুষদের দূষিত রক্ত পেয়েছি। এটা দূরীভূত করবার উপায় কি?
এই পর্যবেক্ষণ অনেকটা হতাশাবাদী এবং অত্যন্ত সাধারণীকৃত। একটি সমাজ বা জাতিকে অপরাধপ্রবণ বলে এককভাবে দোষারোপ করা বাস্তবসম্মত নয়। অপরাধপ্রবণতা মানুষের সহজাত নয়, বরং এটি নির্ভর করে সমাজের শিক্ষা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও শাসনব্যবস্থার ওপর।
সমস্যার গভীরে যাওয়া দরকার
১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশের ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসন, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় প্রভাব ফেলেছে। এসব কারণে দুর্নীতি ও অপরাধ অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিকীকৃত হয়ে গেছে।
২. সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য:
অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব, অশিক্ষা ও সামাজিক অবিচারের কারণে মানুষ অনেক সময় অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
৩. শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব:
যদি শিক্ষা ব্যবস্থা কেবল সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য হয়, কিন্তু নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়, তাহলে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে পারে।
সমাধান কী?
✅ শিক্ষা ও নৈতিকতা:
শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সহনশীলতা শেখানো জরুরি।শুধু প্রথাগত শিক্ষা নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
✅ সুশাসন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ:
অপরাধ দমন করতে হলে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
✅ সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন:
মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে হবে, যাতে তারা অপরাধে না জড়ায়। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সাম্য নিশ্চিত করা গেলে অপরাধপ্রবণতা কমতে পারে।
✅ সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ:
নৈতিকতা, সততা ও দেশপ্রেমের চর্চা করতে হবে।
পরিবার ও সমাজকে ইতিবাচক মূল্যবোধ প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
একটি জাতির রক্ত বা জিনগত গঠন অপরাধের জন্য দায়ী নয়; বরং এটি নির্ভর করে তাদের সমাজব্যবস্থা ও পরিবেশের ওপর। যদি আমরা সংস্কার চাই, তবে সেটা শুরু করতে হবে শিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে।
উপসংহার:
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স তথা AI খুব ভালোভাবে বুঝে নিয়েছে শিক্ষা সংস্কার ছাড়া জাতিগতভাবে আমাদের মুক্তি নেই। অথচ গুরুতর ও অতীব জরুরি ব্যাপারটি বুঝলেন না আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি শিক্ষা কমিশন বলে কিছুই নিজের এজেন্ডায় রাখেননি।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫