
নিজ জমির ওপরে বেড়ে ওঠা একটি গাছ কেটে ফেলার অপরাধে নিজামকে ছাড়তে হবে তার ভিটাবাড়ি, তার জন্মস্থান। পূবের প্রতিবেশী, এককালের জমিদার মুসাবীর খাঁর পরিবারের লাগানো কড়ই গাছ কেটে ফেলাটা ছিল তার অপরাধ। গাছ কাটা নাকি জমিদার-পরিবারের অসম্মান। কোনটা যে তার অপরাধ সে বিষয়ে অবশ্য নিশ্চিত হতে পারেনি নিজাম। এমনকি আদতে তারা জমিদার ছিল কি না তা নিয়েও কিছু সন্দেহ আছে তার মনে। ব্রিটিশ আমলের জমিদার বা তার নায়েব কিংবা জোতদারও জমিদারির ঠাঁট বজায় রাখতো আর ঋষিপুর গ্রামের মানুষ তাদেরকে সেভাবেই মাথায় তুলে রাখতো।
নিজামের বাড়ি আর মুসাবীর খাঁর বাড়ির জমি পাশাপাশি। কোনটা কার জমি সেটা বোঝার জন্য কোনো আইল পর্যন্ত নেই। নেই কোনো খুটি বা চিহ্ন। ছোটবেলায় নিজাম তার বাবার কাছ থেকে শুনেছে যে তার দাদা রহমত আলী নাকি খাঁ সাহেবের চাকর ছিল। প্রতিদিন দুপুর বেলা মুসাবীরের পুরো শরীরে সরিষার তেল ডলে দেওয়া ছিল রহমত আলীর মূল কাজ। জমিদারির অবসান হলে মুসাবীরের ছেলে শমসের পশ্চিমের বেশ কিছু জমি বিক্রি করে দেয়। রহমতও স্বল্পমূল্যে কয়েক শতাংশ জমি পায়। সেখানেই ভিটাবাড়ি করে বসবাস করতে শুরু করে নিজামের পূর্বপুরুষ। নিজামের দাদা কিনে নিলেও জমিদার পরিবার জমিটির এমন অবাধ ব্যবহার করে যে, এটা যে কাদের জমি তা বুঝে ওঠা কষ্টকর।
নিজামের বাবা মাতবর আলীকে মেট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছিলেন রহমত আলী। মাতবর আলী সরকারি অফিসে কেরানির চাকরি করে যতটুকু টাকা জমাতে পেরেছিলেন, তা দিয়েই তাদের এই ভিটাবাড়ি মেরামত করিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে বাড়ির চারপাশে লাগিয়েছিলেন অনেক পেঁপে, কাঁঠাল ও লেবুর গাছ। ঝড় থেকে রক্ষা পেতে দক্ষিণে লাগিয়েছিলেন বাঁশ। এই বাড়িতেই নিজামের জন্ম, এখানেই বড় হয়ে ওঠা। তাই এই পেঁপে, কাঁঠাল, লেবু এবং বাঁশঝাড়, গ্রীষ্মের আলো-ছায়া, বর্ষার বৃষ্টিতে গাছের পাতায় ও টিনের চালে ছন্দময় শব্দ, শীতের কুয়াশার লুকোচুরি ও বসন্তের শো শো হাওয়ার খেলা নিজামের কাছে প্রিয় স্মৃতির মতো আদুরে। এগুলো বাদে যে দৃশ্যটি নিজামের বাড়ির স্বাভাবিক ও নিয়মিত বিষয়, তা হলো শমসেরের দুই ছেলের এই জমির অধিকাংশে ফসল চাষ। সঙ্গে তাদের লেবু, পেঁপে কিংবা কাঁঠালের ভোগের ক্ষেত্রে অবাধ অধিকার তো আছেই।
এই যেমন, পশ্চিমের দিকে নিজামের বাবার লাগানো লেবু গাছে যেবার লেবু দিয়ে ভরে গেলো, সেবার মুসাবীরের নাতি ওসমান এসে সেই গাছ কেটে ফেললো কোনো কারণ ছাড়াই। আরেকবারের কাহিনী, নিজামের শখ করে লাগানো ফুলের চারাগুলো উপড়ে ফেলে লাউ চাষের জন্য জাংলা করলো তারা। যদিও শমসেরের জমিতে জাংলা দেওয়ার অনেক জায়গা আছে। এই চর্চা নিজামের পরিবার স্বাভাবিকভাবে নিলেও, নিজাম খুব সহজে মেনে নিতে পারেনি। জমিদারি না থাকলেও জমিদারি করেই বেড়াচ্ছে তারা। নিজামের দাদা কি বিনা পয়সায় মুসাবীরের বংশধরের জমিতে বাড়ি তুলেছে? টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া সত্ত্বেও কেন নিজামের পরিবার তাদের সম্পত্তি পুরোপুরি ভোগ করতে পারবে না? এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই নিজামের মা বাধা দেয়। বলে, ‘দাস হইয়া প্রভুর বেইজ্জত করতে নাই, খোদায় গোস্যা করবো’।
নিজাম এই যুক্তি কখনোই বুঝে উঠতে পারে না। নিজামের দাদা হয়তবা মুসাবীরের চাকর ছিল। কিন্তু নিজামের বাবাও করেনি সেই দাসত্ব, করছে না সেও। উল্টো জমিদারের উত্তরসূরীদের তুলনায় তার সামাজিক অবস্থান আরো ভালো। সে একজন কলেজ শিক্ষার্থী। সামনে আরো পড়াশোনা করার ইচ্ছা আছে তার। পড়ালেখা শেষ করে শ্রম দিয়ে কাজ করে ভালো কামাই করবে, করবে শ্রম দিয়ে কেনা সম্মানীয় কোনো চাকরি। অন্যদিকে, মুসাবীরের উত্তরসূরীরা গ্রামের মানুষদের সঙ্গে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ছাড়া আর কীই বা করে? পড়াশোনা করেনি, কর্মজীবী না কেউ। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি বর্গায় দিয়ে যা পায়, তাতেই চালায় সংসার। পরজীবীর দল।
পরজীবীদের অপছন্দ করে নিজাম, আর শ্রমজীবীদের প্রতি তার আছে গভীর অনুরাগ। তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই সে কখনো ঘরে বসে থাকে না। পড়ালেখার পাশাপাশি উপার্জনের বহু উপায় খুঁজে বের করে সে। কখনো ফুলের চারা লাগিয়ে ফুল উৎপাদন করে। কখনো আবার ভাঙা কাঠ পেলে ছোট আকারের বেঞ্চি বানায়। সুলভ দামে বিক্রি করলে চায়ের দোকানদাররা কিনে নিয়ে যায়। বিক্রি করে যা টাকা পায় তা তুলে দেয় মার হাতে।
এবার তাই শীত শুরু হওয়ার আগেই নিজাম উঠোনের এক কোণে ২৫-৩০ টার মত ফুলকপি চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সে তো আর ফুলকপি চাষিদের মত অভিজ্ঞ আর দক্ষ না। তাই সে কপি চাষাবাদে অভিজ্ঞ কয়েকজন গ্রামবাসীর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিল। যদিও নিজাম ৩০টা ফুলকপির চারা লাগিয়েছিল, শেষপর্যন্ত কষ্ট করে টিকাতে পেরেছিল বিশেরও কম।
তবুও তার শ্রমের ফসল যেদিন পর্দা খুলে তার দিকে উঁকি দিয়েছিল, সেদিন নিজামের উল্লাস-উচ্ছাসে বাড়িটি হয়ে উঠেছিল উৎসবমুখর। উৎসবের দিনে তাদের বাড়ির বিশেষ রান্না হবে এই ফুলকপির তরকারি কিংবা ভাজি। তাই মার হাতে একটা ফুলকপি তুলে দিয়ে বাকিগুলো বাজারে বিক্রি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। কিন্তু এই উৎসব কতক্ষণ সে রক্ষা করতে পারবে তা নিয়ে নিজাম চিন্তিত ছিল। শকুন কখন না উড়ে এসে দখল করে নেয় তার শ্রমের ফসল।
হুকুম আসতে আর দেরি কই? প্রভুর হুকুম এলো দাসের কাছে- সব ফুলকপি তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। তবে, বিনামূল্যে। কিন্তু এই ফুলকপিগুলোর ওপর বিনামূল্যে দখল করতে দেওয়া মানে তো নিজামের শ্রমের ওপর দখলদারিত্ব। দিনশেষে, নিজামের ওপরেই দখলদারিত্ব। তা কী আর নিজাম হতে দেবে? তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়লো সে। বললো, ‘টাকা দিলে নেন, নাহলে আমারে বাজারে যাইতে দেন।’
কিন্তু প্রভুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? এ তো মহাপাপ! এই অন্যায়ের দণ্ড কেবল নিজাম পায়নি, পেয়েছিল তার মাও। শমসেরের এক ছেলে বলে উঠলো, ‘তোগো এখনের যেই ভালো দশা, তা শুধু আগামো জন্য। তোগোরে জমি না দিলে তোর মায়ে বেশ্যা হইয়াও টাকা কামাইতে পারতো না।’
যেখানে নিজাম নিজের বিরুদ্ধেই কোনো অন্যায় সহ্য করে না, সেখানে মায়ের বিরুদ্ধে এই কথা সে সহ্য করবে কী করে? নিজামের মাথায় তখন রক্ত চড়ে গিয়েছিল। এমনকী সে তখন খুনও করতেও প্রস্তুত। গালি শোনার পর থেকে মার কাঁদো কাঁদো চোখ সে সইতে পারছিল না। কিন্তু খুন করে যদি তাকে জেলে যেতে হয়, তাহলে মার কী হবে? মার তো আছেই এই একটা সন্তান। এই ভেবে সে নীরব দাঁড়িয়ে থাকে।
অনেক ভেবেও রক্ত ঠান্ডা করার উপায় না পেয়ে কুয়াশায় ভরা মধ্যরাতে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। ছোটবেলায় সে তার বাবার কাছে শুনেছিল তাদের জমির পূর্ব দিকে যেই কড়ই গাছটা, তার ৮০ ভাগই তাদের জমিতে আর বাকি ২০ ভাগ শমসেরের জমিতে। কিন্তু এই গাছ বুনেছিল শমসের নিজেই। উদ্দেশ্য ছিল, বড় হলে বেশি টাকায় বিক্রি করবে এই গাছ।
সেই স্বপ্ন পূরণ করতেই বিপুল বিস্তৃত কড়ই গাছটি নিজাম কাটতে শুরু করে। গাছ কাটার তীব্র আওয়াজ যতক্ষণে মুসাবীরের বাড়ি গিয়ে পৌঁছেছিল, আর শমসেরের দুই ছেলে টর্চলাইট নিয়ে দৌড়ে বের হয়েছিল, ততক্ষণে গাছটি বেশ অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। শমসেরের দুই ছেলেকে সাক্ষী রেখেই নিজাম তার শেষ প্রতিবাদটি করে। গাছটি ঝন ঝন শব্দ করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নিজেকে রক্ষা করতে নিজাম দৌড়ে নিজের বাড়ির দিকে যায়, শমসেরের দুই ছেলে দৌড়ায় তাদের বাড়ির দিকে।
পরের দিন সালিশ বসেছিল হাজী খন্দকার সাহেবের বাড়িতে। শমসেরের দুই ছেলে ইসমাইল খাঁ ও ওসমান খাঁ সাক্ষী দিলো তারা দুইজনই নিজ চোখে দেখেছে নিজামকে তাদের গাছ কাটতে। নিজামকে জিজ্ঞেস করলে নিজামও তা স্বীকার করে বলে উঠলো, ‘ওই গাছ আমাগো জমির উপরে ছিল।’
খন্দকার সাহেবের ধমকের সুরে বলে উঠে, ‘চুপ, বেয়াদব। শমসের সাহেবের দুই পোলা এই এলাকার সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ। তারা আমার বাড়িতে গাছ লাগাইলে তো আমিও মানা করুম না। আর তুই কাইটেই ফালাইছোস।’
ইসমাইল ও ওসমানের দিকে ফিরে খন্দকার বলে, ‘বুঝেন না, ভাইজান? এরা তো নিচু জাত। এসবের বালাই নাই এগো মধ্যে।’
নিচু জাতের তকমা দিয়ে খন্দকার সাহেব দণ্ড ঘোষণা করলো। বিরাট এই গাছের দাম হবে ৩০-৩৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে দিতে হবে একদিনের মধ্যে। রায় শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লো নিজামের মা। মার কান্নার সঙ্গে কোথা থেকে বয়ে এলো এলোমেলো বাতাস। মেঘলা হয়ে উঠলো আকাশ। এর মধ্যেই নিজামের মা বলে উঠলো, ‘আমাগো কাছে এত টাকা আইবো কই থেকে? আমার পোলারে আপনারা মাফ কইরে দেন। ওই নিজাম, মাফ চা। পা ধইরা মাফ চা।’
কিন্তু সেসব কথায় মন গললো না খন্দকারের। নিজামের চোখে-মুখেও নেই কোনো অনুতাপ, তা দৃশ্যমান সবার কাছেই। খন্দকার সাহেব বললো, ‘টাকা না থাকলে ভাইজান তোগো জমি থেকে মনমতো গাছ কাইটে লইয়ে যাইবো।’
নিজামের মা সেই দণ্ডই মেনে নিলো। নীরব থেকে মেনে নিলো গ্রামবাসীও। সমাজ, কী নিষ্ঠুর! সালিশের সমাপ্তি ঘটলো। সালিশ শেষে খন্দকার সাহেব ইসমাইল ও ওসমানের সঙ্গে আলাপে বসলো। সামনের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে সে এই মহল্লার প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়াবে। জমিদারের বিশাল পরিবার যেনো তাকে মেম্বার হওয়ার জন্য ভোট দেয়।
বোঝা গেল নিজামদের দুই সদস্যের পরিবার তাকে ভোট না দিলেও খন্দকার সাহেবের কিছু যায়ে আসে না, যদি জমিদার বাড়ির ভোটগুলো পাওয়া যায়। ক্ষমতার সার্কাস, কী নির্মম!
সেদিনই বিকেলে শুরু হলো দণ্ডিত আসামির দণ্ড কার্যকর। একে একে কেটে ফেলা হচ্ছে নিজামের বাবার স্মৃতিগুলো। বাড়ির পেছনের বাঁশঝাড় পর্যন্ত ছাড়লো না তারা। এদিকে দক্ষিণের বাতাস তীব্র হচ্ছে। বাড়ি রক্ষা করবে কারা?
রাত হতেই ঝড় উঠলো। নিজামের ঘরের ২৫ বছর পুরনো দুর্বল টিনের চাল জোড়ে জোড়ে কাঁপতে শুরু করলো। ঝড়ের ঝাপটা সামলাতে না পেরে এক কাৎ হয়ে পড়ে গেলো তাদের টিনের চাল। বৃষ্টির পানি জমতে শুরু করলো তাদের মেঝেতে। শীতের রাতে ঝড় হওয়াতে শীত আরো তীব্র হতে থাকলো।
নিজামের মা বলে উঠলো, ‘তোরে কইসিলাম না খোদায় গোস্যা করবো?’
ঈশ্বর কী নির্দয়! সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টির প্রতিই কেনো করে এত অবিচার? উত্তর জানা হলো না নিজামের।