Posts

ফিকশন

সাকুরার ছায়ায় (একটি ভালোবাসার গল্প যা সময়ের সীমানা অতিক্রম করে...)

February 23, 2025

Boros Marika

153
View

অধ্যায় ১: সাকুরার ছায়ার নিচে

শিজুকা কিয়োতোর ছোট্ট এক গ্রামে পা রাখতেই অনুভব করল এক অদ্ভুত শূন্যতা। বাতাসে এক ধরনের শীতলতা, যেন সে কোনো অদৃশ্য হাত তাকে ছুঁয়ে দেখছে। সে জানত না কেন, কিন্তু এই জায়গাটি তার কাছে অচেনা হয়েও অদ্ভুতভাবে চেনা লাগছিল।

গ্রামটি যেন ঠিক বর্তমানের জাপানের মতো নয়—এখানে প্রাচীন কাঠের ঘর, সরু পাথরের পথ, আর চারদিকে ছড়িয়ে থাকা সাকুরা গাছগুলোর সৌন্দর্য। কিন্তু শিজুকার দৃষ্টি আটকে গেল গ্রামের কেন্দ্রস্থলে থাকা সেই প্রাচীন সাকুরা গাছের দিকে।

গাছটি অন্য যেকোনো সাকুরার চেয়ে আলাদা। ফুলগুলো যেন নরম গোলাপি আলো ছড়াচ্ছে, আর তার ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে কেউ একজন...

একজন যুবক।

সে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এল। বাতাস তার সাদা কিমোনোর কাপড়ে হালকা ঢেউ তুলল, কিন্তু তার চোখ দুটো ছিল যেন এক গভীর রহস্যের দরজা।

"তুমি আবার ফিরে এলে…"

শিজুকা চমকে উঠল।

"আবার?"

সে কি আগে কখনো এখানে এসেছিল? এই যুবক কে?

তবে কিছু বলার আগেই বাতাস একবার ঝড়ের মতো উঠল, আর মুহূর্তের মধ্যে যুবকটি মিলিয়ে গেল…

শিজুকা স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। শুধু বাতাসে থেকে গেল সেই শীতল কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি—

"তুমি আমার কাছে ফিরে এসেছ, কিন্তু এবারও কি আমাকে ভুলে যাবে?

অধ্যায় ২: হারিয়ে যাওয়া প্রতিচ্ছবি

শিজুকা রাতের বেলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। কিয়োতোর এই গ্রাম যেন এক অদ্ভুত রহস্যে মোড়া, যেখানে বাতাসের মাঝেও অতীতের কোনো দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে।

সে আজ বিকেলে যা দেখেছে, তা কি সত্যি ছিল? নাকি কেবল তার কল্পনা?

কিন্তু তার হৃদয় বারবার বলছিল—সেই যুবক বাস্তব ছিল।

বাতাসে সাকুরার পাপড়ি উড়ে এসে তার জানালায় লাগল। সে হাত বাড়িয়ে একটি ধরল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেটি ধুলোয় পরিণত হলো।

“শিজুকা…!”

একটা কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসে এল।

সে চমকে উঠল। কে ডাকছে তাকে?

সে দ্রুত জানালা দিয়ে তাকাল। বাইরে, অন্ধকারের মাঝে, সেই সাকুরা গাছের নিচে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

সাদা কিমোনো, গভীর দৃষ্টির সেই ছেলেটি—ইউজিনো।

কিন্তু আজ সে কেবল দাঁড়িয়ে নেই।

সে ধীরে ধীরে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

শিজুকা জানত না কেন, কিন্তু তার ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। সে যেন ইউজিনোর দিকে না গেলে কিছু একটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

সে ধীরে ধীরে জানালা খুলে দিল, ঠান্ডা বাতাস তার চুল এলোমেলো করে দিল। আর ঠিক তখনই…

তার সামনে মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বদলে গেল।

রাতের কিয়োতোর বদলে সে নিজেকে এক অচেনা সময়ে দেখতে পেল—

চাঁদের আলোয় এক প্রাসাদ, সাদা রঙের বিলাসবহুল কিমোনো পরা সে নিজে, আর ইউজিনো… যে তখনও তার হাত বাড়িয়ে রেখেছে।

“তুমি আমাকে আবার ভুলে যাবে না, তাই তো?”

শিজুকা হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকল।

কী হচ্ছে এটা?

সে কি আসলেই সময়ের দেয়াল পেরিয়ে গেছে? নাকি এই ভালোবাসা কোনো জন্মের নয়, বরং শত শত বছরের?

অধ্যায় ৩: স্মৃতির দরজা খুলে গেল

শিজুকা চোখ বন্ধ করল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করল।

সে এখন আর আধুনিক কিয়োতোর সেই ছোট্ট গ্রামে নেই।

সে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল প্রাসাদের সামনে, যেখানে রাতের চাঁদের আলো সাদা মার্বেলের মেঝেতে প্রতিফলিত হচ্ছে। বাতাসে সাকুরার গন্ধ, আর সামনে… সেই যুবক, ইউজিনো।

কিন্তু এবার সে কেবল একজন আত্মা নয়। সে এক সম্ভ্রান্ত সামুরাই, যার তলোয়ার কোমরে বাঁধা, যার চোখে ভয়ংকর এক আকাঙ্ক্ষা।

“শিজুকা… তুমি ফিরে এসেছ।”

শিজুকা হতভম্ব হয়ে তার চারপাশে তাকাল। সবকিছু এত স্পষ্ট, এত বাস্তব!

কিন্তু পরক্ষণেই তার হৃদয় ধক করে উঠল, কারণ তাদের সামনে আরেকজন দাঁড়িয়ে ছিল।

একজন যুবরাজ।

তাঁর পোশাকে জাঁকজমক, চোখে একধরনের ঠান্ডা অথচ দাবিদার দৃষ্টি।

“তুমি কি আবার আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, শিজুকা?” যুবরাজ কাঁপা কণ্ঠে বলল।

শিজুকা কিছু বলার আগেই দৃশ্যপট ঝাপসা হয়ে গেল, আর মুহূর্তের মধ্যে সে আবার বাস্তবে ফিরে এল।

সে কাঁপতে কাঁপতে শ্বাস নিল।

এই স্মৃতি সত্যি ছিল? সে কি পূর্বজন্মের কিছু দেখেছে?

কিন্তু তার ভয়টা তখনই আরও বাড়ল, যখন সে জানালার বাইরে তাকিয়ে ইউজিনোকে দেখতে পেল।

সেই একই দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আজ তার চোখের ভাষা অন্যরকম।

এক অদ্ভুত দখলদারিত্ব, এক গভীর দাবি—

যেন শিজুকা কেবল তারই ছিল, অন্য কারও নয়

অধ্যায় ৪: ভালোবাসা, কিন্তু কার জন্য?

শিজুকা গভীর রাতে ঘুমোতে পারেনি।

ইউজিনোর দৃষ্টি এখনো তার মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে।

সেই দৃষ্টি, যেখানে ছিল এক অবর্ণনীয় আবেগ, এক দাবি, যেন সে শিজুকাকে কোনোদিনও হারাতে চায় না।

কিন্তু সে কি সত্যিই ইউজিনোকে চেনে?

অথচ তার হৃদয়ের এক কোণে ভয়ঙ্কর এক টান অনুভব হচ্ছিল।

সে সাকুরা গাছের নিচে গেল। বাতাসে ফুলের পাপড়ি উড়ছিল, রাতের শীতলতা তার ত্বক ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

ঠিক তখনই, পিছন থেকে কেউ ধীরে ধীরে তার হাত ধরল।

গরম, শক্ত, কিন্তু কাঁপতে থাকা হাত।

"তুমি কি এবারও আমাকে ছেড়ে যাবে?"

শিজুকা থমকে গেল।

ইউজিনো তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখে এক অদ্ভুত উন্মাদ আকাঙ্ক্ষা।

শিজুকা কিছু বলার আগেই সে ধীরে ধীরে তার হাত শক্ত করে ধরল, যেন আরেকবার হারানোর ভয়ে কাঁপছে।

"তুমি কি সত্যিই জানো না আমি কে?"

শিজুকা বিভ্রান্ত।

তখনই বাতাসে ভেসে এল আরেকটি কণ্ঠস্বর—ঠান্ডা, কিন্তু বিষাদময়।

"ইউজিনো, তুমি কি ভুলে গেছ, সে শুধু তোমার ছিল না?"

শিজুকা চমকে পেছন ফিরে তাকাল।

একজন অন্য যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে, তার চোখ গভীর, দুঃখে ভরা।

সে যেন কোথাও হারিয়ে গেছে, আর কিছু একটা ফিরে পেতে এসেছে।

"তুমি ভুলে গেছ, শিজুকা... আমি তোমার প্রথম ভালোবাসা ছিলাম।"

বাতাস থমকে গেল।

শিজুকা কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তার মাথার ভেতর অতীতের এক ভয়ঙ্কর স্মৃতি জ্বলে উঠল—

কোনো এক জন্মে, সে সত্যিই একই সঙ্গে দু’জনের ছিল।

অধ্যায় ৫: হারিয়ে যাওয়া প্রতিজ্ঞা

শিজুকা পেছন ফিরে তাকাল।

নতুন যুবকটির চোখ গভীর, তীব্র, এবং এক অপার দুঃখে ভরা।

কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ছিল দৃঢ়—

"তুমি ভুলে গেছ, শিজুকা... আমি তোমার প্রথম ভালোবাসা ছিলাম।"

শিজুকার মাথার ভেতর বিদ্যুৎ চমকের মতো কিছু স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

এক প্রাসাদ, এক অন্ধকার রাত, আর সে... কারো দিকে তাকিয়ে আছে কান্নাভেজা চোখে।

তাকে কেউ কথা দিয়েছিল।

"আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব, যতদিন প্রয়োজন... যতদিন প্রয়োজন।"

কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর কার?

শিজুকা মাথা ঝাঁকিয়ে স্মৃতিগুলো সরিয়ে ফেলতে চাইল।

কিন্তু ইউজিনো স্থির দাঁড়িয়ে ছিল, তার ঠোঁট শক্তভাবে চেপে রাখা।

তার চোখের ভাষা বদলে গেছে—স্নেহের বদলে সেখানে ভয়ংকর এক দাবি।

"তুমি ভুল বলছ," ইউজিনোর কণ্ঠ কঠোর হয়ে উঠল। "ও কখনোই তোমার প্রথম ভালোবাসা ছিল না। তোমার হৃদয় শুধু আমার ছিল। শুধু আমার!"

শিজুকা থমকে গেল।

"তুমি নিশ্চিত তো, ইউজিনো?" নতুন যুবকটি শান্ত গলায় বলল, কিন্তু তার চোখে গভীর দহন ছিল।

"কারণ, যদি আমার কথা ভুল হয়ে থাকে, তাহলে বলো—আমার জন্য তোমার চোখে এই কান্না কেন?"

শিজুকা হতভম্ব হয়ে অনুভব করল, সত্যিই তার চোখে জল চলে এসেছে।

কিন্তু কেন?

বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল।

তিনজনের মাঝে এক অসমাপ্ত প্রতিজ্ঞার ছায়া নেমে এল।

কিন্তু কে সত্যি?

কে তার প্রকৃত ভালোবাসা?

আর কে সেই ব্যক্তি, যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার অপেক্ষায় ছিল?

অধ্যায় ৬: তুমি কি আমাকে ভালোবেসেছিলে?

রাত গভীর হয়ে আসছে, কিন্তু শিজুকার মনে যেন এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

ইউজিনো আর সেই অপরিচিত যুবক—দু’জনের দৃষ্টির মাঝে আটকে আছে সে।

কিন্তু কে সত্যি?

"আমি কি সত্যিই তোমার প্রথম ভালোবাসা ছিলাম?" শিজুকা ফিসফিস করে বলল, কিন্তু কাকে উদ্দেশ্য করে বলল, সে নিজেও জানে না।

ইউজিনো তার দিকে এগিয়ে এল।

"তুমি কাকে বিশ্বাস করবে, শিজুকা?" তার কণ্ঠে চাপা আগুন ছিল। "আমাকে, যে শত শত বছর ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছে? নাকি ওকে, যে তোমাকে শুধু বিভ্রান্ত করছে?"

শিজুকা কিছু বলার আগেই নতুন যুবকটি এগিয়ে এল।

"তুমি কি জানো না, শিজুকা?" তার গলা কাঁপছিল। "তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে। তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে!"

তার চোখে ব্যথার ছাপ। যেন এক অভিশপ্ত প্রেম, যা কখনো পূর্ণতা পায়নি।

শিজুকা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল।

তার বুকের ভেতর কোথাও যেন কিছু ভেঙে পড়ছে।

"তাহলে কেন… আমার কিছুই মনে নেই?"

বাতাস থমকে গেল।

ইউজিনোর চোখ কঠিন হয়ে উঠল। সে ধীরে ধীরে শিজুকার হাত ধরল।

"কারণ ও মিথ্যা বলছে, শিজুকা।"

কিন্তু নতুন যুবকটি তার হাত সরিয়ে দিল, আর চোখের গভীর দাহ নিয়ে বলল—

"তুমি জানো কেন তোমার কিছু মনে নেই?"

"কারণ, তোমার অতীত তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।"

অধ্যায় ৭: এক অভিশপ্ত রাত

শিজুকা বাতাসে সাকুরার পাপড়ি উড়তে দেখে, কিন্তু তার মনে যেন একটি অজানা শূন্যতা ভর করেছে।

ইউজিনো আর সেই অপরিচিত যুবক—যে দু’জনকেই সে ভালোবাসতো, তা এখন যেন পুরোপুরি এক বিভ্রম।

তার হৃদয়ে এমন এক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, যেখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই।

এমন সময়, ইউজিনো তার সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি—যেখানে ভালোবাসা আর অভিশাপ একে অপরকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

"শিজুকা," তার কণ্ঠ কঠিন হয়ে উঠল। "তুমি জানো না, কিন্তু তুমি আমার।"

শিজুকা চমকে উঠল।

"তুমি কি বুঝতে পারছো, শিজুকা? আমি তোমার জীবনে ফিরে এসেছি। শুধু তোমার জন্য।"

শিজুকা তার চোখে তাকাল, কিন্তু সেখানে ভয়ের কিছু ছিল।

"এটা কি তোমার দখল?" তার কণ্ঠ জ্বলছিল। "আমার ভালোবাসা তোমার মালিকানা নয়।"

ইউজিনো ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল।

"তোমার হৃদয়ে যেটি ছিল, সেটি কেবল আমার।" তার গলা ঘন হয়ে উঠল। "কিন্তু কেন তুমি ফিরে গেলেছিলে? কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে?"

শিজুকার শরীর কাঁপছিল। সে পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করল।

কিন্তু ঠিক তখনই, ওই যুবক—যে তার অতীতের প্রেম ছিল—তার সামনে এসে দাঁড়াল।

"ও কখনো তোমার হয়ে থাকতে পারবে না, শিজুকা। তুমি আমাকে ভুলে গেছ? আমি কখনো তোমার থেকে দূরে যাইনি।"

তিনজনের মধ্যে এক অদৃশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।

"তুমি বুঝতে পারছো না," ইউজিনো বলল, "তোমার অতীত যদি ফিরে আসে, শিজুকা, তবে আমার দখলেই আসবে।"

শিজুকার মাথার ভেতর যেন এক সুনामी আছড়ে পড়ছিল।

তার হৃদয়ে যে ভয় ছিল, তা এখন পুরোপুরি বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়েছে।

"তুমি কি জানো না, শিজুকা?" যুবকটি তার দিকে তাকিয়ে বলল। "আমি তোমার সত্ত্বা, তোমার ইতিহাস। আমার থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই।"

চলবে।।।।।

Comments

    Please login to post comment. Login