পথের শেষে আলো
সকালের রোদ মাঠের উপর পড়ে সোনালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামের পথে পথে শিশুদের কলরব, মাঠে কৃষকদের হাসি, আর গরুর গাড়ির চাকার শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারপাশ। কিন্তু এই সুন্দর সকালেও রহিমের মনে কোনো আনন্দ নেই। সে তার ভাঙা ঘরের চালার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। রহিমের বয়স মাত্র ত্রিশ, কিন্তু জীবনের বোঝা তাকে পঞ্চাশের মতো দেখাচ্ছে।
রহিমের জীবন কখনোই সহজ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাকে। বাবা মারা গেছেন যখন রহিমের বয়স মাত্র দশ বছর। মা কঠোর পরিশ্রম করে তাকে এবং তার ছোট বোনকে মানুষ করেছেন। কিন্তু মায়ের অসুস্থতা রহিমের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছে। ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন মা, আর রহিমের পক্ষে তার চিকিৎসার খরচ জোগানো প্রায় অসম্ভব।
রহিম দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালানোই দায়। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে কাজের অভাব তাকে আরও বিপদে ফেলেছে। গ্রামে নতুন রাস্তা তৈরি হওয়ায় অনেক দিনমজুর কাজ পাচ্ছে না। রহিমের মতো যারা পুরনো রাস্তার কাজ করত, তাদের এখন কোনো কাজ নেই।
একদিন সকালে রহিম মাকে বলল, "মা, আমি শহরে যাব। এখানে আর কাজ নেই। শহরে গেলে হয়তো কিছু কাজ পাব।"
মা চোখের জল চেপে বললেন, "বাবা, তুই চলে গেলে আমি একলা কী করে থাকব? তোর বোন তো এখন স্কুলে যায়।"
রহিম মায়ের হাত ধরে বলল, "মা, আমি চেষ্টা করব শীঘ্রই ফিরে আসতে। কিন্তু এখানে থেকে যদি কিছু না করি, তাহলে আমরা সবাই মারা যাব।"
মা আর কিছু বললেন না। রহিমের চোখেও জল আসল, কিন্তু সে তা মুছে ফেলল। পরের দিন ভোরবেলা রহিম একটি ছোট ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তার সঙ্গে মাত্র কয়েকটি টাকা এবং আশা।
শহরে পৌঁছে রহিম দেখল, এখানে জীবন আরও কঠিন। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ভিড়, গাড়ির শব্দ, আর ধোঁয়ায় আকাশ কালো। রহিম কোনো পরিচিত লোক না থাকায় সে রাতটি রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কাটাল। পরের দিন সে কাজের সন্ধানে বের হলো। কিন্তু শহরে কাজ পাওয়া এত সহজ নয়। রহিম দিনের পর দিন চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো কাজ পেল না।
একদিন সে একটি নির্মাণস্থলে গেল। সেখানে একজন ঠিকাদার তাকে কাজ দিল। রহিম খুব খুশি হলো। সে দিনরাত পরিশ্রম করতে লাগল। কিন্তু এক মাস পর যখন মজুরি নেওয়ার সময় এল, ঠিকাদার তাকে টাকা দিল না। রহিমের মতো অনেক দিনমজুরই ঠকেছিল। রহিম হতাশ হয়ে পড়ল। সে ভাবল, জীবন কি এতই নিষ্ঠুর?
কিন্তু রহিম হাল ছাড়ল না। সে আবার কাজের সন্ধানে বের হলো। একদিন সে একটি এনজিওর অফিসে গেল। সেখানে একজন কর্মকর্তা তার কথা শুনলেন এবং তাকে একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হতে বললেন। রহিম প্রথমে ভেবেছিল, তার পক্ষে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপর সে সিদ্ধান্ত নিল, সে চেষ্টা করবে।
প্রশিক্ষণ কোর্সে রহিম অনেক কিছু শিখল। সে কম্পিউটার চালানো, ইংরেজি বলার মৌলিক দক্ষতা এবং ছোট ব্যবসা পরিচালনার কৌশল শিখল। কোর্স শেষে তাকে একটি ছোট ঋণ দেওয়া হলো। রহিম সেই টাকা দিয়ে গ্রামে ফিরে এল এবং একটি ছোট মুদি দোকান খুলল।
আস্তে আস্তে রহিমের দোকান চালু হলো। গ্রামের মানুষ তার দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনতে শুরু করল। রহিমের আয় বাড়ল, এবং সে তার মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারল। তার ছোট বোনও এখন নিয়মিত স্কুলে যায়।
রহিমের জীবন এখনও কঠিন, কিন্তু সে আশা হারায়নি। সে জানে, জীবনের পথে অনেক বাধা আসবে, কিন্তু সেই বাধা পার হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ পথের শেষে আলো আছে।