জ্যোৎস্না রাত। চতুর্দশীর চাঁদের আলোয় পুরো ধানক্ষেতের মাঠ রুপালী আভায় ভরে গেছে। বাতাসের শো শো আওয়াজ, দুএকটা ঝিঝির ডাক আর পাশে বয়ে চলা নদীর দুএকটা শান্ত ঢেউয়ের পাড়ে আছড়ে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। রাতের নির্জন এই পৃথিবীকে দিনের আলোয় দেখা পৃথিবীর সাথে মেলানো যায়না কোনোভাবেই। এই মাঠ যেন কোনো একটা মায়ালোকের অংশ, বাতাসে কোনো এক অচেনা প্রেমের ঘ্রাণ, নদী, চাঁদ, বাতাস, রাতের স্নিগ্ধতা সব যেন ব্রহ্মান্ডের কোনো এক রহস্যময় বন্ধনে একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে এক হয়ে জড়িয়ে আছে। আমি ধানক্ষেতের সরু আল ধরে হেটে চলেছি। ধানক্ষেতে ঢেউ জাগানো বাতাসে আমার খোলা চুল উড়ছে। এই জায়গাটায় আমি বহুবার এসেছি, ভীষণ পরিচিত আমার। কিন্তু এমন গভীর রাতে কখনো আসা হয়নি। বিকেলে এসেছি, সকালে এসেছি, দুপুরেও এসেছি কখনো সখনো, তখন আমার চুলের গোছা আমার কান ছাড়ায় নি, কত বয়স ছিল তখন আমার ছয়,সাত, আরেকটু কম, আরেকটু বেশি! ঠিক মনে নেই। তবে আট বছরের পর এই জায়গায় আমার আর কখনো পা পড়েনি, কারন এর পরপরই আমাদের দেশ ছেড়ে দেয়া। আমার পুরো পরিবার জার্মান চলে গিয়েছিলো, ওখানেই বেড়ে উঠা। বাবা যখন বাবার পুরোনো বন্ধুদের সাথে কথা বলত তাদের বর্নণা থেকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা মানুষজনদের ছবি দেখতে দেখতে এতটুকু জানা হয়েছে আমাদের পুরোনো সেই গ্রাম ভীষণ ভাবে পাল্টে গিয়েছে, শহর বা শহরতলী না হলেও ছোট ছোট টিনের ঘরের জায়গায় বেশিরভাগই ইটের পাকা ঘর, মাঠ ঘাট, ধানী জমি ভরাট হয়ে বাজার, রাস্তা, বসতবাড়ি হয়েছে, নদীতে ব্যস্ত লঞ্চঘাট, স্টিমার সব আছে। শ্যাওলা গাছ আর তেতুল গাছের ভিড়ের মাঝে গ্রামের এককোণে আড়াল হয়ে থাকা টিনের চালের ছোট মসজিদের পরিবর্তে এখন এসিওয়ালা দোতলা মসজিদ, মসজিদের পাশের বড় অশ্বত্থ গাছ আর জঙলা জায়গা সাফ করে সেখানে মুদিদোকান হয়েছে ডজন কয়েক। আমার শৈশবে দেখা শান্ত, ছোট গ্রাম এখন কোলাহলে ভরা মোটামুটি ব্যস্ত একটা জায়গা। কিন্তু আজকের রাতের এই মাঠ, নদী আমার শৈশবের দেখা সেই জায়গা যেখানে আমি বালি কাঁদা মেখে খেলতাম, ছুটে বেড়াতাম। বার্লিনের দিনের আলো থেকে হুট করে মাঝরাতের অতীতের ফেলে আসা একটা জায়গার মুখোমুখি হওয়ার অনুভূতি বিস্ময়, কৌতুহল আর ভয়ের হয়ার কথা। কোনো এক অদ্ভুত কারনে আমার তিন অনুভূতির কোনোটাই কাজ করছে না, যেন কেউ আপন হাতে আমার ভেতর থেকে ভয়, কৌতুহল আর বিস্ময় তিনই মুছে দিয়েছে, আমার শান্ত লাগছে, ভীষণরকম। আমার পোশাকের ধরনও পাল্টে গিয়েছে, সাদা কামিজ, সাদা সালোয়ার আর সাদা ওড়নায় আমার গা জড়ানো, সেই ওড়নাও আমার চুলের সাথে সমান তালে উড়ছে।
আমি খুব ধীরগতিতে হাঁটছি, ধানক্ষেত শেষ হয়ে গিয়েছে, আমার মনে পড়ার কথা নয় কিন্তু আমার মন পড়ছে একটু এগুলেই জঙলা একটা জায়গা আছে, ভেতরে পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ি, বাড়ির উঠোনে চন্দ্রপ্রভার একটা গাছ, এখন কোন ঋতু? এখন কি চন্দ্রপ্রভা ফোটার সময়? আমি ধীর পায়ে বাড়ির সীমানায় পা রাখলাম, আরেহ! ঐ তো চন্দ্রপ্রভার গাছ! গাছ ভর্তি করে ফুল ফোটে আছে, আমি একটা ফুল ছিড়ে আমার কানের পাশে গুজলাম।
এই বাড়ি সরু রাস্তার পাশে আম আর কাঠালের সারি করা গাছ, আমি সেই সরু রাস্তায় হাটছি। হঠাৎ পেছন থেকে আমার ওড়নায় একটা টান অনুভব করলাম, কোনো মড়া কাঠে আটকে গিয়েছে হয়তো, ছাড়াবার জন্য পেছন ফিরলাম। কোথায় মড়া কাঠ! একটা ছেলে! তার ঘড়ির বেল্টে আটকে গিয়েছে আমার ওড়নার সুতা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কোথায় যেন, কি গভীর সে দৃষ্টি, ভালো করে তাকালে মনে হয় গোটা একটা সমুদ্র লুকিয়ে আছে সে চাহনীতে।
প্রথমবারের মতো আমার ভয় লাগতে শুরু করলো, আমি বুঝতে পারলাম না আমার কি দৌড়ে পালানো উচিত কি না! আমি পালালাম না। আমি ঘাড় বাকিয়ে আস্তে করে বললাম, " হ্যালো!" কোনো প্রতিউত্তর নেই। আমি আবার বললাম হ্যালো, আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? সামনের লোক নির্বিকার। আমি এবার জোরে জোরে বললাম,, এই যে শুনছেন? কেউ তাকালো না, বুঝতে পারলাম আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না, শুনতেও না। আমার ভয় হতে লাগলো, এই জায়গায় একা হাটার ভয়। ছেলেটার ঘড়ির দিকে তাকালাম, রাত এগারোটা বেজে তেইশ মিনিট। আমি ঘাড় ঘুরালাম, হঠাৎ দেখি আমার হেটে আসা এই নির্জন জায়গাটাতে এখন অনেক মানুষ, আমার ছোটবেলার স্কুলের আহাদ স্যার, গ্রামের মুদিদোকানের চাচা, আমার বার্লিনের বন্ধু, কলেজের লাইব্রেরিয়ান, আরো অনেক মানুষ। সেখানে পরিচিত - অপরিচিত, আধা পরিচিত সবাই আছে। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আহাদ স্যার হাত ঘুরিয়ে কি কি যেন বলছেন, কাউকে পড়াচ্ছেন, মুদিদোকানের চাচা বলছেন, আরো পাঁচ টাকা দিন, আমার বার্লিনের বন্ধু কি নিয়ে যেন ঝুকে বসে আছে। আমি কাউকে কাউকে ডাকলাম। কেউ শুনলো না, ফিরে তাকালো না। আমার মনে হলো সেখানে শুধু আমিই অস্তিত্বের অধিকারী, বাকি সবাই একটা আলাদা আলাদা স্থান আর সময়ের একটা প্রতিচ্ছবি মাত্র। আমার কৌতুহল হতে শরু করলো, সবাই এখানে এভাবে কেন! এটা মহাবিশ্বের কোন অংশ? আর সবার হাতে, কারো পায়ে এমন রক্ত লেগে আছে কেন? সবাইকে খুজে খুজে দেখার চেষ্টা করলাম, সবার হাতে, পায়ে রক্ত। আমি ভয়ে ভয়ে আমার হাতের দিকে তাকালাম, আমার হাতেও রক্ত, পায়ে রক্ত, টকটকে লাল, এক প্রচন্ড ভয় আমাকে গ্রাস করতে লাগলো। যে জায়গা কিছুক্ষণ আগেও আমার ভীষণ পরিচিত মনে হচ্ছিলো, নিমিষেই তা অপরিচিত হয়ে গেল। ঘাড় ঘুড়িয়ে আমি পাশে বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালাম, সে এখনো বসে আছে সেখানে, ঠিক আগের মতোই। তার গভীর সমুদ্রের মতো চোখ কোথায় যেন নিবদ্ধ। আমি তার হাতের দিকে তাকালাম। কালো বেল্ট আর সাদা ডায়ালের ঘড়ি ছাড়া সেখানে আর কিচ্ছু নেই। তার সাদা শার্টের ফোল্ড করা ফুল স্লিভের পরে শিরা উপশিরায় জড়ানো ফর্সা হাতে এক ফোঁটা রক্তের দাগও নেই। আমি কিছু না ভেবেই আমার রক্ত মাখা হাত আমার ওড়নায় মোছার চেষ্টা করলাম, একটুও উঠলো না, ওড়নায়ও রক্ত লাগলো না। আমি আবার আমার সামনের লোকটাকে ডাকলাম। কে আপনি, আপনার হাতে রক্ত নেই কেন? উত্তর নেই, এই ভীষণ রকম একাকীত্বের গ্রাস থেকে উঠে আসার আপ্রাণ তৃষ্ণা উত্তর না পাওয়ার নিশ্চয়তা জেনেও আমাকে জোরগলায় বারবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য করলো,,কে আপনি! আপনার হাতে রক্ত নেই কেন? কে আপনি?
আমি খেয়াল করলাম আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে, পা অসাড় হয়ে আসছে, আমি বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর আমার সামনে বসা জন ঘাড় ঘুরালো,যেন মাত্রই আমাকে শুনতে পেয়েছে।
- কে আপনি? আর কাঁদছেন কেন?
- আপনি কে আর এই জায়গা কোথায়?
- আমি জানিনা
- এখানে সবার হাতে রক্ত, আমারও। আপনার হাতে কোনো রক্ত নেই কেন?
- সবাই বলতে?
- আমি হাত দিয়ে সামনের সবাইকে দেখাতে চাইলাম।
- কেউ নেই সেখানে।
সেই আগের মতোই আকাশে চাঁদ, শোশো হাওয়া, ধানক্ষেত, নদী আর ঝিঝির শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই সেখানে। আমার পাশে বসে থাকা লোকটিও উধাও। শুধু রয়ে গেছে আমার হাতের গাঢ় টকটকে লাল রঙের রক্ত। আমি ধীর পায়ে হাটতে শুরু করলাম। নদীর দিকে, আমার চোখে জল, টপটপ করে তা কপোল গড়িয়ে পড়ছে, আমি ভয়ে কাঁদছি না, আমি আমার সামনের নদীর মতোই শান্ত - স্থীর। তবুও আমার চোখে জল। অনুভূতির এমন রহস্যময় পরিবর্তনের মানেও আমি জানিনা। কিন্তু মনে হচ্ছে আমার ভেতরে কেউ একজন একটা অন্ধকার কূপ বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে আর সেই কূপে আরেকটু পরই আমি হারিয়ে যাব। আমি নদীর পানিতে আমার রক্তাক্ত হাত ধুতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। আমার হাতের রক্ত আমার হাতেই রয়ে গেল, আর সমস্ত নদীর পানি কালো হয়ে গেল। মাথার ভেতর কেউ বলে উঠলো ' আর কত! আর কত পাপ ধুবে আমার পানিতে?' আমি কাঁদতে লাগলাম আর খেয়াল করলাম আমার সাদা জামা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।
27
View