১.
শান্তির দেশ, অশান্তির রাত
রাত তখন দুটো। সমস্ত শহর ঘুমিয়ে। হঠাৎ টেলিভিশনের স্ক্রলে ভেসে উঠলো বড় বড় লাল অক্ষরে: “স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মধ্যরাতের সংবাদ সম্মেলন!”
বাড়িঘরের দরজার ছিটকিনি ঠিক মতো লাগানো হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে গিয়ে হন্তদন্ত হয়ে টিভির সামনে বসলো রফিক সাহেব। বিশাল কোট আর গম্ভীর চেহারা নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এলেন মাইক্রোফোনের সামনে।
“দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম নিয়ন্ত্রণে! জনগণ সম্পূর্ণ নিরাপদ! তবে কিছু দুষ্কৃতকারী অরাজকতা সৃষ্টি করছে। তাদের দেখে নেওয়া হবে!”
রফিক সাহেব এই বক্তব্য শুনে আশ্বস্ত হলেন। ‘বাহ, সরকার কত দায়িত্ববান!’ ভাবতে না ভাবতেই তার জানালার পাশ থেকে শোনা গেল চাপা গুঞ্জন। পলকের মধ্যে তিনজন অজ্ঞাত লোক তার ঘরে ঢুকে বললো, “চাচা, চাঁদা দেন। সরকার তো দেখে নিচ্ছে, কিন্তু আমরা তো একটু আগে দেখে ফেললাম!”
রফিক সাহেব কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “বাবা, আমি তো মধ্যবিত্ত মানুষ, সরকারি দপ্তরে ছোটখাটো চাকরি করি!”
দুষ্কৃতকারীরা হেসে উঠলো, “চাচা, আমরা কি খারাপ কিছু বললাম? একটু চাঁদা দিলেই তো শান্তিতে থাকতে পারবেন! শোনেন, সরকারের নির্দেশই তো – সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে!”
এদিকে, শহরের অন্য প্রান্তে এক দুধ বিক্রেতার গরু চুরি হয়ে গেছে। থানায় গিয়ে রিপোর্ট করতে চাইলে দারোগা বললেন, “আপনার গরু নিখোঁজ? দুঃখিত, স্যার! এখন মানবাধিকার সংস্থাগুলো গরুর অধিকার নিয়ে কাজ করছে। গরু যদি স্বেচ্ছায় চোরের সাথে যায়, তাহলে আমরা কিছু করতে পারবো না!”
অন্যদিকে, রাস্তার ধারে বসে থাকা একজন সংবাদকর্মী হঠাৎ দেখলেন, একদল তরুণ এক তরুণীকে রিকশা থেকে নামিয়ে টানাহেঁচড়া করছে। তিনি ভিডিও করতে গিয়ে ধরা পড়লেন। এক দুর্বৃত্ত বললো, “ওস্তাদ, এইটা কিন্তু সরকারবিরোধী কার্যকলাপ হয়ে যাবে! সাবধান থাকেন!”
রাত তিনটায় টিভিতে আবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখ দেখা গেল। তিনি বললেন, “যারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে! আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। জনগণ নির্ভয়ে ঘুমান!”
রফিক সাহেব তখন পকেট থেকে শেষ টাকা বের করে দুষ্কৃতকারীদের দিয়ে বললেন, “ভাই, নিয়ন্ত্রণটা একটু আলগা করেন, আমি বাঁচতে চাই!”
................
২.
গাধার পিঠে সম্রাট
নগরবাসী যখন দৈনন্দিন দুর্ভোগে জর্জরিত, তখন এক প্রাক্তন সম্রাটের মনে এক নতুন স্বপ্ন জেগে উঠল। একসময়কার লৌহমানব, যিনি গণতন্ত্রকে ‘কাগুজে বাঘ’ বলে বিদ্রূপ করতেন, তিনিই এখন নিজের পতনের গল্পকে নতুন করে লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন।
সম্রাট একদিন তার পুরনো চ্যালাদের ডেকে বললেন, “এই যে, দেশটাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছি বলে মানুষ আমাকে ভুলে যাবে ভেবেছ? না! আমি আবার ফিরে আসব। জনগণ যখন বিপদে পড়ে, তখন পুরনো শাসকদের স্মরণ করে—এটাই ইতিহাস!”
চ্যালারা মাথা নাড়ল। তাদের নেতা যা বলে, তাই সত্য। কিন্তু সমস্যা একটাই—কীভাবে? গণতন্ত্রের খেলায় ভোট লাগে, ভোটের জন্য জনগণের বিশ্বাস লাগে, জনগণের বিশ্বাস পেতে লাগে উন্নয়ন। অথচ সম্রাটের আমলে উন্নয়ন বলতে ছিল ‘নিজের উন্নয়ন’!
তবে সম্রাট বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি জানতেন, জনগণের স্মৃতি মাছির থেকেও দুর্বল। তাই তিনি পরিকল্পনা করলেন, “দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমনই নড়বড়ে যে, আমি যদি ‘দেশের ত্রাতা’ হিসেবে ফিরে আসি, তাহলে সবাই আমাকে বরণ করে নেবে!”
পরিকল্পনা অনুযায়ী, তার চ্যালারা ছদ্মবেশে নগরীর আনাচে-কানাচে ‘নৈরাজ্য’ সৃষ্টি করতে লাগল। পত্রিকায় হেডলাইন হতে লাগল: ‘শৃঙ্খলার অভাবে দেশ ধ্বংসের পথে!’, ‘নাগরিকদের নিরাপত্তা কোথায়?’, ‘স্বৈরশাসকই কি ছিল ভালো?’
জনগণের মনে ভয় জন্মাতে দেরি হলো না। তারা ভাবতে লাগল, “নাহ! তখন অন্তত ভয় ছিল, কিন্তু শৃঙ্খলা ছিল! এখন তো ভয়ও আছে, শৃঙ্খলাও নেই!”
ঠিক এই সময় সম্রাট জনতার সামনে এলেন। বুকে হাত রেখে বললেন, “তোমাদের আমি ফেলে দিতে পারি না। আমি ফিরে এলাম—তোমাদের রক্ষা করতে, তোমাদের ভালোবাসতে!”
জনতা কি বুঝল যে, যে আগুনে তারা পোড়াচ্ছে হাত, সে আগুন আসলে সম্রাটেরই জ্বালানো? বুঝলেও মুখ খুলল না। কারণ তারা জানত, মুখ খুললে রাতের আঁধারে নিখোঁজ হয়ে যেতে হবে। তাই একদিন সকালে দেখা গেল, নগরীর রাজপথে এক মহাযাত্রা। পতাকা উড়ছে, ব্যানারে লেখা—“বাঁচাও! সম্রাট আবার এসো!”
সিংহাসনের দিকে যাত্রা করলেন সম্রাট। তবে এবার আর তিনি রথে চড়েননি। গণতন্ত্রের তামাশায় তিনি এবার উঠলেন এক গাধার পিঠে।
আর গাধাটিও তার ভার বইতে বইতে মনে মনে হাসছিল। কারণ সে জানত, ইতিহাসের পরিহাসের চেয়ে বড় কোনো কৌতুক নেই!