কলকাতার বুকে, শীতের কুয়াশায় ঢাকা একটি রাত। শহরের পুরোনো অংশে, হাওড়া ব্রিজের কাছে একটি ছোট গলিতে, একটি চিৎকার ভেসে এল। সকাল হতেই খবর ছড়িয়ে পড়ল—বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী হরেন্দ্রনাথ বসুর মৃতদেহ পাওয়া গেছে তার নিজের বাড়ির লাইব্রেরিতে। তার গলায় ছিল একটি গভীর ক্ষত, আর হাতে একটি ছোট কাগজের টুকরো—তাতে লেখা, "তুমি পরবর্তী।"
গোয়েন্দা অর্জুন মিত্রকে ডাকা হলো। অর্জুন ছিলেন একজন অদ্ভুত মানুষ—লম্বা, রোগা, চোখে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। তিনি পুলিশের সঙ্গে কাজ করতেন না, কিন্তু তার খ্যাতি ছিল এমন যে কেউ তাকে না বলতে পারত না। অর্জুন বসুদের বাড়িতে পৌঁছালেন। লাইব্রেরিটা ছিল বিশাল—দেয়ালজুড়ে বই, আর মাঝে একটা পুরোনো ওক কাঠের টেবিল। হরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ তখনও সেখানে, চোখ খোলা, যেন কিছু বলতে চাইছিল।
অর্জুন লক্ষ করলেন, ঘরে একটা জানালা খোলা ছিল। কিন্তু বাইরে কোনো পায়ের ছাপ নেই। মেঝেতে একটা ছোট সোনার লকেট পড়ে ছিল, যেটা হরেন্দ্রনাথের নয় বলে তার স্ত্রী মীরা জানালেন। মীরা ছিলেন শান্ত, কিন্তু তার চোখে একটা অদ্ভুত ভয়। অর্জুনের মনে প্রশ্ন জাগল—কে এটা ফেলে গেছে?
পরের দিন অর্জুন হরেন্দ্রনাথের ব্যবসায়িক পার্টনার শ্যামল দত্তের সঙ্গে দেখা করলেন। শ্যামল ছিলেন মোটা, গম্ভীর মানুষ। তিনি বললেন, "হরেন্দ্রর অনেক শত্রু ছিল। ওর ব্যবসার ধরনই এমন—অনেককে ঠকিয়েছে।" কিন্তু শ্যামলের কথায় একটা অস্বস্তি ছিল, যেন কিছু লুকোচ্ছেন।
অর্জুন লকেটটা নিয়ে একজন জুয়েলারের কাছে গেলেন। জুয়েলার বললেন, "এটা পঞ্চাশ বছরের পুরোনো ডিজাইন। এর ভেতরে একটা ছোট ছবি থাকার কথা।" লকেটটা খুলতেই একটা কালো-সাদা ছবি বেরোল—একজন যুবতী মহিলা, চোখে অদ্ভুত হাসি। কে এই মহিলা?
রাতে অর্জুন বসুদের বাড়ির পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগলেন। একটা পুরোনো ডায়েরি পেলেন, ১৯৭৫ সালের। তাতে লেখা ছিল: "সে ফিরে আসবে। আমরা তাকে থামাতে পারিনি।" লেখাটা হরেন্দ্রনাথের বাবা প্রতাপ বসুর। অর্জুনের মনে হলো, এই খুনের সঙ্গে অতীতের কিছু জড়িত।
অর্জুন জানতে পারলেন, হরেন্দ্রনাথের একটি গোপন ব্যবসা ছিল—পুরোনো জমি কিনে সেখান থেকে লোকজনকে উচ্ছেদ করা। একটি জমির কথা বারবার উঠে এল—মালদার একটি পুরোনো হavelি। অর্জুন সেখানে গেলেন।
হavelিটা ছিল ভাঙাচোরা, কিন্তু তার দেয়ালে একটা পুরোনো ছবি ঝুলছিল—লকেটের সেই মহিলা। পাশের গ্রামের এক বুড়ো বলল, "ওর নাম ছিল রুক্মিণী। ওকে হরেন্দ্রর বাবা আর তার দলবল মেরে ফেলেছিল। ওই জমির জন্য।" রুক্মিণীর গল্প ছিল করুণ—তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, আর তার শেষ কথা ছিল, "আমি ফিরব।"
অর্জুনের মনে প্রশ্ন জাগল—তবে কি এটা প্রতিশোধ? কিন্তু কে এই প্রতিশোধ নিচ্ছে?
ফিরে এসে অর্জুন মীরার সঙ্গে আবার কথা বললেন। মীরা ভেঙে পড়লেন। বললেন, "আমার একটা মেয়ে ছিল, রিয়া। হরেন্দ্র তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ওর মনে ক্ষোভ ছিল।" অর্জুন জানতে পারলেন, রিয়া ছিল রুক্মিণীর নাতনি। তার কাছে পুরোনো লকেটটা ছিল।
অর্জুন রিয়াকে খুঁজতে লাগলেন। এক রাতে, হাওড়া ব্রিজের নিচে একটা পরিত্যক্ত গুদামে রিয়াকে পাওয়া গেল। তার হাতে ছিল একটা ছুরি, আর চোখে প্রতিশোধের আগুন। রিয়া বলল, "ওরা আমার দিদিমাকে মেরেছিল। আমি শুধু ন্যায় চেয়েছি।"
কিন্তু অর্জুন লক্ষ করলেন, রিয়ার গল্পে কিছু মিলছে না। হরেন্দ্রর গলার ক্ষতটা ছিল বড় ছুরির, কিন্তু রিয়ার হাতে ছোট ছুরি। তবে কি আরেকজন আছে?
অর্জুন আবার শ্যামলের কাছে গেলেন। শ্যামলকে চাপ দিতেই তিনি ভেঙে পড়লেন। বললেন, "আমি খুন করেছি। হরেন্দ্র আমাকে ব্ল্যাকমেল করছিল। আমি ওর ব্যবসার গোপন কথা জানতাম।" শ্যামল রিয়ার প্রতিশোধের গল্প শুনে সুযোগ নিয়েছিলেন। তিনি রিয়ার লকেটটা ঘটনাস্থলে ফেলে দিয়েছিলেন, যাতে সন্দেহ রিয়ার ওপর যায়।
অর্জুন শ্যামলকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন। রিয়াকে গ্রেপ্তার করা হলো না, কারণ তার অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু অর্জুনের মনে একটা প্রশ্ন রয়ে গেল—রুক্মিণীর আত্মা কি সত্যিই শান্তি পেয়েছে?
শেষ রাতে, অর্জুন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে একটা ছায়া দেখলেন। একটা মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সেটা রুক্মিণী। তারপর কুয়াশায় মিলিয়ে গেল।