Posts

ফিকশন

কালো পর্দার আড়ালে

February 25, 2025

Rashid Shahriar

49
View

প্রথম অধ্যায়: রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙল
শীতের এক কনকনে রাত। কলকাতার উত্তরে, শ্যামবাজারের কাছে একটি পুরোনো বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেছে। পুলিশের লাল-নীল আলো রাস্তায় ঝলকাচ্ছে। বাড়ির ভেতরে, দোতলার একটি ঘরে, বিছানায় পড়ে আছে একটি মৃতদেহ—সুদীপ্ত রায়, শহরের প্রভাবশালী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী। তার বুকে একটি ছুরি গাঁথা, আর দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা: "এটা শুরু মাত্র।"

গোয়েন্দা প্রিয়ম সেনকে ডাকা হলো। প্রিয়ম ছিলেন মাঝবয়সি, ধূসর চুলে ঢাকা মাথা, চোখে একটা শান্ত কিন্তু গভীর দৃষ্টি। তিনি পুলিশের সঙ্গে কাজ করতেন না, কিন্তু তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর অদ্ভুত সমাধান খুঁজে বের করার ক্ষমতার জন্য সবাই তাকে চিনত। প্রিয়ম ঘরে ঢুকলেন। ঘরটি ছিল সাধারণ—একটা বিছানা, একটা আলমারি, আর একটা জানালা। কিন্তু জানালাটা বন্ধ, আর বাইরে কোনো পায়ের ছাপ নেই।

প্রিয়ম লক্ষ করলেন, সুদীপ্তর হাতে একটা ছোট চাবি আঁকড়ে ধরা। চাবিটার গায়ে একটা ছোট "K" অক্ষর খোদাই করা। তিনি চারপাশে তাকালেন—ঘরে কোনো তালা বা বাক্স নেই যেটার সঙ্গে এই চাবি মিলতে পারে। সুদীপ্তর স্ত্রী অনুরাধা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, "ওর কোনো শত্রু ছিল না। কে এমন করল?" কিন্তু প্রিয়মের চোখে পড়ল, অনুরাধার কান্নায় একটা অদ্ভুত শীতলতা।

দ্বিতীয় অধ্যায়: প্রথম পদক্ষেপ
পরের দিন সকালে প্রিয়ম সুদীপ্তর অফিসে গেলেন। সেখানে তার সেক্রেটারি রীতা জানাল, "স্যার গত কয়েকদিন ধরে খুব চিন্তিত ছিলেন। কার সঙ্গে যেন ফোনে ঝগড়া করছিলেন।" প্রিয়ম রীতার কথায় একটা আড়ষ্টতা লক্ষ করলেন। তিনি সুদীপ্তর ফোন রেকর্ড চেক করতে বললেন পুলিশকে।

এদিকে, চাবিটা নিয়ে প্রিয়ম একজন তালাওয়ালার কাছে গেলেন। তালাওয়ালা বলল, "এটা কোনো সাধারণ চাবি নয়। এটা একটা সেফের—পুরোনো ধরনের, যেগুলো ব্যাঙ্কে বা বড় বাড়িতে থাকে।" প্রিয়ম ভাবলেন, সুদীপ্ত কি কিছু গোপন করছিল?

সন্ধ্যায় ফোন রেকর্ড এল। একটা নাম বারবার উঠে এসেছে—কিরণ মজুমদার, সুদীপ্তর ব্যবসায়িক পার্টনার। প্রিয়ম কিরণের বাড়িতে গেলেন। কিরণ ছিলেন সুদর্শন, কিন্তু তার কথায় একটা অস্থিরতা। তিনি বললেন, "সুদীপ্তর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল, কিন্তু খুনের কথা ভাবতেও পারি না।" প্রিয়ম লক্ষ করলেন, কিরণের টেবিলে একটা পুরোনো ফটো—তাতে সুদীপ্ত আর কিরণের সঙ্গে আরেকজন মহিলা। কিরণ বললেন, "ও আমার বোন কল্পনা। অনেকদিন আগে মারা গেছে।"

তৃতীয় অধ্যায়: অতীতের দরজা
প্রিয়ম সুদীপ্তর বাড়ির পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটতে শুরু করলেন। একটা পুরোনো ডায়েরি পেলেন, ১৯৯৮ সালের। সুদীপ্তর হাতের লেখা। তাতে লেখা: "কল্পনা জানতে পেরেছে। ওকে থামাতে হবে। K আমার সব শেষ করে দেবে।" প্রিয়ম ভাবলেন, "K" কে? কিরণ? না অন্য কেউ?

তিনি কল্পনার মৃত্যুর খোঁজ নিলেন। পুলিশের রেকর্ডে দেখা গেল, কল্পনা ২০০০ সালে একটা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় একজন সাংবাদিক প্রিয়মকে বলল, "ওটা দুর্ঘটনা ছিল না। কেউ ইচ্ছে করে ওকে মেরেছিল।" প্রিয়মের মনে হলো, এই খুনের সঙ্গে অতীতের একটা গোপন রহস্য জড়িত।

তিনি সুদীপ্তর ব্যাঙ্কে গেলেন। সেখানে একটা সেফ ছিল, যেটার চাবি মিলে গেল। সেফের ভেতরে একটা ফাইল—তাতে একটা জমির দলিল আর কিছু ছবি। ছবিতে কল্পনা আর সুদীপ্ত একটা পুরোনো বাড়ির সামনে। দলিলে দেখা গেল, জমিটা ছিল বাগুইআটির কাছে, আর সেটা কল্পনার নামে ছিল।

চতুর্থ অধ্যায়: জট খুলতে শুরু
প্রিয়ম বাগুইআটির সেই বাড়িতে গেলেন। বাড়িটা ছিল ভাঙাচোরা, পড়ে থাকা দেয়ালে শ্যাওলা। ভেতরে একটা পুরোনো আলমারি পেলেন। তাতে একটা চিঠি—কল্পনার লেখা: "সুদীপ্ত আমাকে ব্ল্যাকমেল করছে। ও জমিটা নিতে চায়। আমি ওকে ঠেকাব।" চিঠির শেষে একটা নাম—কৌশিক।

প্রিয়ম কৌশিক নামটা খুঁজতে লাগলেন। জানতে পারলেন, কৌশিক ছিল কল্পনার প্রেমিক। সে ছিল একজন সাধারণ মানুষ, কিন্তু কল্পনার মৃত্যুর পর থেকে কেউ তাকে দেখেনি। প্রিয়মের মনে হলো, কৌশিক কি ফিরে এসেছে প্রতিশোধ নিতে?

এদিকে, অনুরাধার আচরণে প্রিয়মের সন্দেহ বাড়ছিল। তিনি দেখলেন, অনুরাধা রাতে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছেন। প্রিয়ম গোপনে তার ফোন ট্র্যাক করলেন। দেখা গেল, সে কিরণের সঙ্গে কথা বলছে। কথার মাঝে একটা নাম উঠল—"কৌশিক।"

পঞ্চম অধ্যায়: ছায়ার পিছনে ছায়া
প্রিয়ম কৌশিককে খুঁজে বের করলেন। সে শহরের একটা পুরোনো মেসে থাকত। কৌশিকের সঙ্গে দেখা হতেই সে বলল, "আমি সুদীপ্তকে মারিনি। কিন্তু ওর জন্য কল্পনা মরেছিল। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম কেন।" কৌশিক জানাল, সে কিরণের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, কারণ কিরণও সুদীপ্তর ওপর রাগী ছিল।

প্রিয়ম বুঝলেন, এখানে একাধিক খেলা চলছে। তিনি অনুরাধাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। অনুরাধা ভেঙে পড়লেন। বললেন, "আমি জানতাম সুদীপ্ত কল্পনাকে মেরেছিল। কিন্তু আমার হাতে কিছু ছিল না। কিরণ আমাকে বলেছিল, ও সুদীপ্তকে শায়েস্তা করবে।"

প্রিয়ম কিরণের বাড়িতে গেলেন। কিরণকে চাপ দিতেই তিনি স্বীকার করলেন, "আমি ওকে মেরেছি। ও আমার বোনের জীবন নষ্ট করেছিল। আমি আর সহ্য করতে পারিনি।" কিন্তু প্রিয়ম লক্ষ করলেন, কিরণের হাতে ছুরি ধরার কোনো দাগ নেই। তবে কি আরেকজন আছে?

ষষ্ঠ অধ্যায়: শেষ সত্য
প্রিয়ম আবার ঘটনাস্থলে ফিরলেন। ঘরের মেঝেতে একটা ছোট রক্তের দাগ পড়ে ছিল, যেটা আগে কেউ লক্ষ করেনি। তিনি বুঝলেন, খুনি ঘরের ভেতর থেকেই এসেছে। তিনি অনুরাধার দিকে তাকালেন। অনুরাধার হাতে একটা পুরোনো দাগ ছিল—ছুরির।

অনুরাধা শেষে স্বীকার করলেন, "আমি মেরেছি। সুদীপ্ত আমাকে বছরের পর বছর অত্যাচার করেছে। কল্পনার মৃত্যুর পর থেকে ও আমাকে ব্ল্যাকমেল করত। আমি আর সহ্য করতে পারিনি।" কিরণ আর কৌশিককে সে ফাঁসিয়ে দিতে চেয়েছিল।

প্রিয়ম অনুরাধাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু তার মনে একটা প্রশ্ন রয়ে গেল—কল্পনার আত্মা কি শান্তি পেয়েছে? শেষ রাতে, শ্যামবাজারের সেই গলিতে দাঁড়িয়ে প্রিয়ম একটা হালকা হাওয়া অনুভব করলেন। মনে হলো, কেউ যেন চলে গেল।

Comments

    Please login to post comment. Login