শেকলের বাইরে
রাজীবের জীবনটা কেমন যেন শেকলে বাঁধা। সকাল আটটায় অফিস, বিকেল পাঁচটায় ফেরার সময়। তারপর বাসায় এসে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হয় না, পরিবার থেকেও একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ তার চোখে পড়ল ফুটপাতের এক কোণে বসে থাকা এক বৃদ্ধ। লোকটার পরনে ময়লা চাদর, কাঁচাপাকা চুল এলোমেলো, চোখে একটা অদ্ভুত দীপ্তি। রাজীব জানে, শহরে এমন দৃশ্য নতুন কিছু নয়, কিন্তু লোকটার চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন একটা আকর্ষণ ছিল।
লোকটা হেসে বলল, "বাবা, প্রতিদিন একই পথে হাঁটছ, কিছুই কি বদলাচ্ছে?"
রাজীব একটু চমকে গেল। "মানে?"
"তোমার জীবন তো একটা ঘড়ির কাঁটার মতো চলছে। কখনো কি ভাবো, তুমি যা করছো, তা সত্যিই তোমার ইচ্ছা?"
রাজীব অবাক হয়ে বলল, "নিশ্চয়ই! আমার কাজ, দায়িত্ব—এসব তো আমি নিজেই বেছে নিয়েছি।"
বৃদ্ধ মৃদু হেসে বলল, "যদি বলি, তুমি আসলে শেকলে বাঁধা?"
পরদিন অফিসে বসে রাজীব বারবার সেই কথাগুলো ভাবছিল। সত্যিই কি সে শেকলে বাঁধা? তার ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল দুনিয়া ঘুরে দেখার, লেখালেখি করার। কিন্তু বাস্তবতা তাকে আটকে রেখেছে কর্পোরেট চাকরির জালে।
সেদিন সন্ধ্যায় সে ফুটপাতের সেই কোণে গেল, কিন্তু বৃদ্ধ আর নেই। মনে হলো, সে যেন একটা প্রশ্ন রেখে গেছে, যার উত্তর খুঁজতে হবে।
সেই রাতেই রাজীব সিদ্ধান্ত নিল, সে এক সপ্তাহের জন্য সবকিছু ছেড়ে নিজের মতো করে সময় কাটাবে। পরদিন সে চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে একটা ছোট ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল পাহাড়ের দিকে।
প্রথম কয়েকটা দিন তার অদ্ভুত লাগল। মোবাইলের নোটিফিকেশন নেই, অফিসের চাপ নেই, কিন্তু মনের ভেতর একটা অস্বস্তি ছিল। সত্যিই কি সে ঠিক কাজ করেছে?
কিন্তু ধীরে ধীরে সে অনুভব করল, প্রকৃতির কাছে থাকলে, নিজের সাথে সময় কাটালে কতটা শান্তি পাওয়া যায়। একদিন সে নদীর ধারে বসে একটা কবিতা লিখল—বহু বছর পর। মনে হলো, সে যেন সত্যিকারের মুক্ত হলো।
সাত দিন পর যখন সে শহরে ফিরল, তার চোখে ছিল এক নতুন দৃষ্টি। অফিসে গিয়ে সে প্রথমেই বসকে জানাল, চাকরি ছাড়তে চায়। বস অবাক হয়ে বললেন, "তুমি নিশ্চিত?"
রাজীব হেসে বলল, "হ্যাঁ, এবার আমি নিজের জীবনের গল্প নিজেই লিখতে চাই।"
সেইদিনই সে একটা ব্লগ খুলে নিজের অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তার লেখা জনপ্রিয় হতে লাগল, মানুষ তার গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হতে লাগল।
সেই ফুটপাতের কোণায় আর কখনো সেই বৃদ্ধকে দেখেনি রাজীব। কিন্তু সে জানে, ওই মানুষটিই তাকে নতুন জীবনের পথে হাঁটতে সাহায্য করেছিলেন।
শেষ