Posts

ভ্রমণ

শেষ ভ্রমণ (শেষ পর্ব)

February 26, 2025

Sunjida Islam

163
View

অন্ধকারের মধ্যে অস্বস্তি

প্রথমে সাইয়ারার চোখ খোলো, যেন ধীরে ধীরে এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার ঘর তার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। সেখানে, চারপাশে ভর করে এক অদ্ভুত নীরবতা। সে কোনো শব্দ করতে পারছে না, যেন তার গলা আটকে গেছে। তার মনে হাজারো প্রশ্ন ছুটে চলছিল—কীভাবে তারা এখানে এসেছে? তাদের বন্ধুরা কোথায়? এই অদ্ভুত জায়গাটা কী?

সাইয়ারা একে একে তার হাত-পা নাড়াতে লাগল, কিন্তু তার শরীর অবশ হয়ে গেছে। অসহায়ভাবে সে লক্ষ্য করল, দূরের একটি ছোট জানালা থেকে কিছুটা ম্লান আলো ঢুকছে। জানালার আলোয় সে দেখতে পেল—তার বন্ধুরা মাটিতে নিথর পড়ে রয়েছে।

ওরা কি অজ্ঞান, নাকি কিছু আরো ভয়ঙ্কর ঘটছে?

সাইয়ারার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। তাকে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে কি তার বন্ধুদের ডাকবে, কেও কি আওয়াজ শুনে ভিতরে আসবে??

সাইয়ারা ঘাবড়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকতে লাগল,

"শিরোপা... এশা... নাশিতা... ফারিহা..."

কিন্তু কোনো সাড়া নেই। বন্ধুরা নিথর পড়ে আছে, যেন তাদের দেহ থেকে সমস্ত প্রাণশক্তি শুষে নেওয়া হয়েছে। আতঙ্কে তার নিশ্বাস দ্রুত হয়ে আসছিল। চারপাশের অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠছে, আর সেই নীরবতার মধ্যে তার ফিসফিসানো ডাকগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে।

সে কি এগিয়ে গিয়ে তাদের নাড়া দেবে? নাকি অপেক্ষা করবে, যদি কেউ নিজের থেকে জেগে ওঠে? মাথার ভেতর হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু ভয় তাকে স্থির হয়ে থাকতে বাধ্য করছে।

তখনই...

একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে এলো। যেন দূরে কোথাও কেউ ধীরে ধীরে হাঁটছে, পায়ের আওয়াজ মৃদু ধুলোর আস্তরণে মিলিয়ে যাচ্ছে। সাইয়ারার রক্ত হিম হয়ে গেল।


 

সাইয়ারার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। সে বুঝতে পারছিল, কেউ ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। আতঙ্কে মাথা ঝিমঝিম করছিল, কিন্তু সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিল।

সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অজ্ঞান হওয়ার ভান করল।

গভীর নীরবতার মধ্যে কেবল কয়েকটি ভারী পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে তারা ঘরের ভেতরে ঢুকল।

"হেহেহে... দেখে মনে হচ্ছে, ওরা এখনো কিচ্ছু বুঝতে পারেনি!"

শয়তানি হাসি ভেসে এলো তিনজন মানুষের মুখ থেকে। তাদের কণ্ঠস্বর ঠান্ডা, কিন্তু তার মাঝেই ছিল অদ্ভুত এক বিকৃত উন্মাদনা।

"আর কতোক্ষণ এভাবে রাখবো ওদের?"

একজন ফিসফিস করে বলল।

"যতক্ষণ না ওরা নিজেরা বলার মতো অবস্থায় আসে!"

আরেকজনের কণ্ঠে স্পষ্ট ধৈর্যহীনতা।

সাইয়ারা নিজের নিঃশ্বাস আটকে রাখল, যেন কোনোভাবেই ওরা বুঝতে না পারে সে সচেতন।


 

সাইয়ারা শ্বাস আটকে শুনছিল লোকগুলোর কথা।

"বস বলেছে, ওদের পাচার করলে মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যাবে!" একজন ফিসফিস করে বলল।

"কিন্তু বস কি আমাদেরও ভালো কিছু দেবে? নাকি সব টাকা নিজেই হাতিয়ে নেবে?" আরেকজন সন্দেহের স্বরে বলল।

"চুপ কর!" তৃতীয়জন ধমক দিলো। "বস শুনে ফেললে বিপদে পড়ে যাবি! আমাদের কাজ শুধু ওদের ওপর নজর রাখা, যাতে কেউ পালাতে না পারে!"

এই বলে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সাইয়ারা নিঃশব্দে শ্বাস ছাড়ল, কিন্তু আতঙ্কে তার শরীর অবশ হয়ে আসছিল। ওদের পাচার করা হবে? তাহলে এখান থেকে বের হতে না পারলে শেষ হয়ে যাবে সবাই...


 

সাইয়ারা দেখল, ধীরে ধীরে সবার জ্ঞান ফিরছে।

সে আস্তে করে বলল, "সবাই চুপ, ধীরে কথা বল। আমাদের অপহরণ করা হয়েছে... ওরা আমাদের পাচার করবে!"

ফারিহা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, "এখন কী হবে?"

এশা হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল, "তুই এটা কীভাবে জানলি?"

সাইয়ারা তখন শুনে আসা কথাগুলো খুলে বলল।

শিরোপা ধীরে বলে উঠল, "এ কী সর্বনাশী কান্ড! মায়ের কথা শোনা উচিত ছিলো , কেন যে এসেছিলাম!"

নাশিতা কাঁপা কণ্ঠে বলল, "হে আল্লাহ, আমাদের রক্ষা করো!"


 

এশা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, "এভাবে পড়ে থাকলে কোনোভাবেই হবে না! আমাদের কিছু একটা করতেই হবে!"

তার কথাই যেন অভিশাপ হয়ে এলো। ঠিক তখনই দরজা খুলে গেল।

একজন কালো কাপড় পরা লোক দাঁড়িয়ে বলল, "এত সাহস! তোদের মনে হচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবি?"

এশা চোখ বড় করে বলল, "আমি থাকতে আমার বন্ধুদের তুই কিছু করতে পারবি না!"

লোকটা বিকট হাসি হাসল।

"তুই জানিস আমি কী কী করতে পারি?"—বলেই সে আবার অমানুষিক হাসিতে ফেটে পড়ল।

ফারিহা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, "দয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন! আমার তো এখনো বিয়ে হয়নি, কত স্বপ্ন আছে আমার!"

তার কথা শুনে বাকিরা হতাশ হয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।

লোকটা হেসে বলল, "তোদের জন্য আমাদের বস অপেক্ষা করছে।"

এরপর সে কয়েকজন লোককে ডেকে বলল, "ওদের সবাইকে ২০৫ নম্বর রুমে নিয়ে যাও। সাবধান! কেউ যেন পালাতে না পারে!"

চারপাশে নিস্তব্ধতা। আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রাস করছে সবাইকে...


 

লোকগুলো ওদের সবার চোখ বেঁধে একটা রুমে নিয়ে গেল। কেউ কিছু দেখতে পারছিল না, শুধু অজানা ভয় ঘিরে ধরছিল সবাইকে।

"চোখ খুল!"—একজন গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

ধীরে ধীরে আলো ফুটে উঠল চোখের সামনে। কিন্তু সামনে যা দেখল, তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না!

"এ কি... নাফিজ স্যার?"—শিরোপার গলা কেঁপে উঠল।

লোকটা ঠোঁটের কোণে বিকৃত হাসি নিয়ে বলল, "হ্যাঁ, আমি!"

সাইয়ারা ক্ষোভে বলল, "ছি! ছি! ঘৃণা হচ্ছে আপনার মতো একজন শিক্ষকের প্রতি!"

নাফিজ স্যার কটমট করে তাকিয়ে বলল, "চুপ কর, বেয়াদবের দল! স্কুলে তো খুব বড় বড় কথা বলতি, এখন কী হবে? তোদের দিন শেষ!"

নাশিতা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, "আমাদের আল্লাহ আছেন, আপনি আমাদের কিছু করতে পারবেন না!"

এদিকে ফারিহা যেন পুরো পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে বলল, "কিন্তু স্যার, আপনাকে এমন ভিলেনের মতো দেখে আমার তো হাসি আসছে! লাল টুপি, লাল কোর্ট—অস্থির জোকার লাগছে!"

তার কথা শুনে সবাই একটু থমকে গেল, তারপর অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠল।

কিন্তু নাফিজ স্যারের চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলছিল...


 

নাফিজ স্যার বিকৃতভাবে হেসে বলল, "হাসো, যত ইচ্ছা হাসো! কিন্তু তোদের পরিণতি হবে ভয়ংকর!"

হঠাৎ একটা ফোন এল। এক ছেলে দ্রুত এসে বলল, "স্যার, বড়ো বস ফোন দিয়েছেন!"

সবাই তখনই বুঝে গেল—নাফিজ স্যার আসলে কারও নির্দেশে কাজ করছে।

নাফিজ স্যার ফোন কানে দিয়ে বলল, "জি স্যার, ওরা আছে, চিন্তা করবেন না! পরশুদিন পার্সেল হয়ে যাবে!"

তারপর একটু থেমে বলল, "কিন্তু স্যার... আমার কমিশনটা..."

ওপাশ থেকে গর্জে উঠল এক ভয়ংকর কণ্ঠ, "শুধু টাকা টাকা করিস না! ফোন রাখ!"

ওরা সবাই বোঝার পরও না বোঝার ভান করল।

নাফিজ স্যার লজ্জা পেয়ে রাগে ফেটে পড়ল, "যা যা, ওদের নিয়ে যা! একফোঁটা পানিও দিবি না

আর আমায় হালকা ভাবিস না, বুঝলি? বেশি চালাকি করলে, প্রথম অত্যাচারটা তোদের উপরেই চালাবো!"

তারপর আবার সেই শয়তানি হাসি—"হাহাহাহা!"


 

এইবার ওদের চোখ আর বাঁধল না।

ওরা দেখল, এক অজানা জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়েছে। চারদিকে শুধুই গাছপালা—কোথাও একফোঁটা আলো নেই। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনো বসতির চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছে, ঘরবাড়ি থাকতে পারে, কিন্তু কোনো মানুষের আনাগোনা নেই।

তারপর হঠাৎই ওদের সেই অন্ধকার ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো।

একজন গম্ভীর কণ্ঠে হুঁশিয়ার করল, "চুপচাপ থাকবি, বুঝলি?"

ওরা কিছু বলার আগেই লোকগুলো দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে গেল।

পাঁচজন শুধু পড়ে রইল। ঘন কালো অন্ধকারে একে অপরের অস্তিত্বই যেন হারিয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু অন্ধকারের থেকেও ভয়ঙ্কর ছিল ওদের মনে জমে থাকা আতঙ্ক।


 

ফারিহা বলল , পড়শু আমাদের পাচার করে দেবে। মা, বাবা, ভাই-বোন সবাই আমার আদোও খবর জানবে।"

নাশিতা বলল, "মা, মনে হচ্ছে কান্না কাটি করছে রে।"

সাইয়ারা বলল, "আমাদের তো খুঁজে পাগল হয়ে যাচ্ছে।"

এশা বলল, "কিছু হবে না আমাদের, আমি জানি।"

শিরোপা বলল, "সেটা তো সামনে কী হবে, তার উপর নির্ভর করছে।"

এখন দৃশ্যটি পাল্টে গেল।

স্কুলে মা-বাবারা কান্না করছে। পুলিশ এসে গেছে।

এশার দাদি বললেন, "আমার নাতি কোথায়?"

পুলিশ বলল, "আমরা খুঁজে দেখছি।"

পাশে দাঁড়িয়ে প্রিন্সিপাল বললেন, "চিন্তা করবেন না, ওদের ঠিকই পাবো।"

শিরোপার মা বললেন, "আপনারা কেমন, পাঁচটা বাচ্চা গায়েব হয়ে গেছে, কিছু জানেন না?"

উত্তরে পুলিশ বলল, "এ মানে আসলে কী?"

সাইয়ারা’র বাবা বললেন, "চুপ কর, তুই কি কিছু করছিস?"

ফারিহার মা বললেন, "নাফিজ স্যার কোথায়? উনি তো ওদের সাথে ছিল।"

জবাবে পুলিশ বলল, "উনি অর্ধেক রাস্তায় তার বাড়িতে চলে গেছেন, শরীর খারাপ।"

নাশিতার বাবা বললেন, "আমার মেয়ে চাই, খুঁজে বের করুন।"

এখন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে, এবং সবাই উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে।


 

অমানবিক নিষ্ঠুরতা

গরমে সবার অবস্থা খারাপ, গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘামে ভেজা দেহ, ক্লান্ত চোখ, আর বুকের মধ্যে জমে থাকা আতঙ্ক—এ যেন এক অদৃশ্য ফাঁস, ধীরে ধীরে টেনে ধরা হচ্ছে।

ফারিহা কাঁপা কণ্ঠে বলল, "কেউ আছে? একটু পানি দিতে পারবেন? খুব পিপাসা পেয়েছি..."

দূর থেকে এক লোক এগিয়ে এলো। ঠোঁটে এক বিকৃত হাসি। হাতে একটা পানির বোতল।

সে ফারিহার সামনে এসে দাঁড়াল, বোতল খুলল, আর ঠান্ডা পানিটা চোখের সামনে গড় গড় করে মাটিতে ঢেলে দিল।

"নে, এখন মাটি থেকে চেটে খা," লোকটা নিষ্ঠুরভাবে বলল।

এশা ক্ষোভে ফেটে পড়ল, "পশুর চেয়েও অধম তুই!"

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই তীব্র একটা থাপ্পড় এশার গালে পড়ল। ধাক্কা সামলাতে না পেরে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। গালে আগুনের মতো জ্বলুনি, চোখে পানি এসে গেল, কিন্তু সে চুপ করে থাকল।

লোকটা এবার ভয়ানক কণ্ঠে বলল, "আর কেউ কিছু বলতে আসবি? হলে এমন অবস্থা করব যে চিনতেই পারবি না নিজেকে!"

তারপর দরজা বন্ধ করে চলে গেল, আর চারজন বন্ধুর সামনে পড়ে রইল এশা—আঘাত, অপমান আর অসহায়তার বোঝা নিয়ে।


 

নির্যাতনের চূড়ান্ত রূপ

সকাল হলো, কিন্তু সেই রাতের দুঃস্বপ্ন এখনও শেষ হয়নি। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই কারও। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, আর ব্যথায় অবশ হয়ে আছে সবাই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি পোড়াচ্ছে গত রাতের ঘটনাগুলো।

এশা এখনও চুপচাপ। ভেতরে ভেতরে গ্লানি, ঘৃণা, আর রাগে ফুঁসছে, কিন্তু কিছু বলার ক্ষমতা নেই আর।

দরজা খুলল। পাঁচজন লোক ঢুকল ভেতরে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই বোঝা যায়, এরা শয়তানের চেয়ে কম কিছু নয়।

একজন এগিয়ে এসে এশাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল। বাকিরা আতঙ্কে জমে গেল। একে একে সবাইকে টেনে বের করা হলো।

ওরা দৌড়াতে পারল না, পালানোর চিন্তাও করতে পারল না। পা যেন অবশ হয়ে গেছে।

সামনে বসে আছে নাফিজ স্যার। এক হাতে পরোটা, অন্য হাতে ডিম। আয়েশ করে খাচ্ছে, আর পাশে ধোঁয়া উঠতে থাকা একটা কিছু...

ধোঁয়ার উৎসের দিকে তাকাতেই বুক কেঁপে উঠল।

একটা বিশাল লোহার শিক গনগনে আগুনে লাল হয়ে আছে। যেন দানবের গরম নিঃশ্বাস।

নাফিজ স্যার একপাশে বসে শিকটার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর বলল, "এখন একে একে তোদের হাতে আমার ব্র্যান্ডের দাগ লাগাবো। কাল অনেক হাসাহাসি করেছিলি, না? এবার বোঝ, কেমন লাগে!"

এই কথা শুনেই সবার গা শিউরে উঠল। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না, যা ঘটতে চলেছে!

প্রথমে এশাকে ধরা হলো। ও হাত ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণে ছটফট করতে লাগল, কিন্তু শক্ত হাতগুলো তাকে শক্ত করে চেপে ধরল।

গনগনে লোহার শিকটা ওর হাতে ঠেকানো মাত্রই...

"আআআআআআআআ!!"

এশার আর্তনাদ কানে এসে বাজল, শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল সবার।

মা... মা... বলে চিৎকার করছিল সে।

এক এক করে সবাইকে টেনে নিয়ে গেল, আর তাদের শরীরেও সেই পুড়ে যাওয়া লোহার ছাপ লাগানো হলো।

প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তারা। কারও আর্তনাদ এতটাই হৃদয়বিদারক ছিল যে সাধারণ কেউ হলে সহ্য করতে পারত না।

কিন্তু ওই শয়তানেরা?

ওরা একপাশে বসে হাসছিল।

এই নির্মম আনন্দের পর, আবার ওদের সেই ঘরে ফেলে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো।

তার যাওয়ার আগে এক লোক বলল, "কোথাও পালানোর চেষ্টা করবি না। তোরা শেষ।"

অন্ধকার ঘর, শরীরে অসহ্য ব্যথা, চোখে অনিশ্চয়তার জল—আর মনে একটাই প্রশ্ন... এখন কী হবে?


 

একটা শেষ চেষ্টা—পালানোর পরিকল্পনা

সাইয়ারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, "দেখ, আমাদের সঙ্গে কী হচ্ছে!"

এশা গভীরভাবে শ্বাস নিল, তারপর বলল, "শোন, মানুষের একটা ভুলের জন্যই সব কিছু বদলে যায়।"

শিরোপা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাল, "মানে?"

এশা ধীরে ধীরে বলল, "দেখ, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ওরা আমার হাতের বাঁধন ঠিকমতো লাগাতে পারেনি!"

ফারিহা কিছু বলছে না। হাসিখুশি মেয়েটা এখন একেবারে চুপ। যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।

নাশিতা কষ্টে কঁকিয়ে উঠল, "আল্লাহ, আমাদের রক্ষা করো..."

এশা দৃঢ় গলায় বলল, "যা করার, আজ রাতেই করতে হবে!"

শিরোপা মাথা নাড়ল, "হ্যাঁ, এটাই আমাদের একমাত্র সুযোগ।"

সাইয়ারা চিন্তিত মুখে বলল, "যতটা বুঝলাম, গভীর রাতে ওদের পাহারা খুব একটা কড়া থাকে না। তখন ওরা গুটিয়ে যায়, 

 যখন সজাগ থাকে তখন চুপচাপ ফিসফিস করে কথা বলে।"

এশা বলল, "ঠিক আছে, তাহলে পরিকল্পনাটা শোনো!"

ফারিহা এবার যেন একটু আগ্রহ দেখাল।

এশা ধীরে ধীরে বলল, "রাত গভীর হলে আমি আর শিরোপা যেভাবেই হোক এখান থেকে বের হবো। তারপর যতদূর সম্ভব ছুটে গিয়ে কাউকে ডাকবো। যদি আমরা লোকজন নিয়ে ভোরের আগেই ফিরে আসতে পারি, তাহলে হয়তো বাঁচতে পারবো!"

ওর কণ্ঠে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস।

"আমি থাকতে তোমাদের কিছু হতে দেব না!"—এশার কণ্ঠ দৃঢ়।

শিরোপা চোখ বন্ধ করে নিজের ভগবানকে স্মরণ করল, নাশিতা আবার ফিসফিস করে দোয়া পড়তে লাগল।

এখন শুধু রাত নামার অপেক্ষা..


 

পালানোর মধ্যে এক ভয়ানক মুহূর্ত

বিকালে একবার বাইরে এসে ঘুরে গিয়েছিল, আর রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে তারা সবাই চুপচাপ রয়ে গেল। এখন রাতের অন্ধকারে তারা একে অপরকে ঠিক মতো প্রস্তুত করছিল। এশা নিজের হাত ও পা খুলে ফেলল, তারপর শিরোপা ও বাকিদেরও একইভাবে বাধন খুলে দিল।

যাওয়ার আগে ওদের দুইজন কে সবাই জড়িয়ে ধরল

যাত্রার আগে, এশা বলল, "শুনো, যদি দেরি হয়, তোমরা বের হওয়ার চেষ্টা করো। বিশ্বাস রাখো, আমি তোমাদের নিতে আসবো।"

নাশিতা শান্তভাবে বলল, "আল্লাহ, আমাদের রক্ষা করো।"

এশা আবার বলল, "ফারিহা চিন্তা করো না, তোর বিয়ে হবে!" এরপর শিরোপা হেসে বলল, "ডিম এর বিয়ে ডিম এর বিয়ে সবকিছু হাস্যকর!"

সবার মধ্যে একটু হাসির পর, শিরোপা আর এশা বের হলো গেল। তাদের পা নিঃশব্দে চলছিল, যেন তারা কোনো শব্দ না করে বাইরে চলে যেতে পারে। তবে হঠাৎ কিছু শব্দ শোনা গেল। তারা ঝপ করে লুকিয়ে পড়ল।

এটা কি? অদ্ভুত একটি আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, এটা কি তাদের প্রধান শিক্ষক স্যারের আওয়াজ? শিরোপা উকি দিয়ে দেখল, "হ্যাঁ, এটা তো আমাদের প্রধান শিক্ষক এর আওয়াজ!" তাদের পেছনে পদক্ষেপ শুনে তারা বুঝতে পারল, কেউ তাদের পেছনে আছে।

এশা ও শিরোপা একসাথে পালানোর প্রস্তুতি নিলো,

আর দুইজন প্রাণ ও পণে ছুটতে লাগলো

কারণ ওদের উপর সব ভরসা করে আছে

তবে হঠাৎ পেছন থেকে একটি গুলি এসে এশার পায়ে লাগল, আর সে তৎক্ষণাত পড়ে গেল।

শিরোপা তৎক্ষণাত এশার হাত ধরে তাকে তুলে, এক নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রাখল।


 

একটি অন্ধকার স্মৃতি

নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর পর, এশা তার মুখে হাত চেপে কান্না করছিল। শিরোপা তার পাশেই বসে তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছিল।

"তোর কিছু হবেনা, আমি তোকে কিছু হতেই দেবোনা," শিরোপা বলল, সান্ত্বনার সাথে।

এশা নীরবে তার কান্না থামাতে চেষ্টা করছিল, এবং একটু পরে বলল, "তোর কি মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা?"

শিরোপার চোখে জল চলে এল। "শুনো, এখন এসব কেন বলছিস?"

এশা আবার বলল, "মনে আছে ৫৭ আর ৫৮ নম্বর রোল, আমরা কতবার ঝগড়া করেছিলাম?"

শিরোপা হেসে বলল, "তুই তো একটা গোবেট ছিলি, শুধু আমারটা দেখে লিখতিস!"

এশা একটু হেসে বলল, "সেই সিদ্দিকা আপা..."

আমরা বেয়াম করতে গিয়ে কিভাবে হাসলাম

বন্ধুক্তের শুরুটা এইভাবেই

তাদের হাসি কিছুটা থামানোর পর, শিরোপা তার দিকে তাকিয়ে বলল, "আমরা একসাথে হেসে-কাঁদে ছিলাম, আর এখন এমন দিন আসবে ভাবিনি।"

এশা তার দিকে তাকিয়ে কান্না শুরু করল, "তুই জানিস, শিরোপা, তুই আমি, আর আমাদের বন্ধুত্ব—এটাই আমাদের সব।"

এশা বলল, শিরোপা বসে থাকলে চলবেনা

আরও ৩জন বন্ধু আমাদের অপেক্ষা করছে

শিরোপা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, "তোর কিছু হবে না, আমি আসব, বন্ধুত্বের কসম।"

এশা শান্তভাবে মাথা ঝাকিয়ে বলল, "তুই সবসময় আমার পাশেই ছিলি আমি জানি রেহ


 

অগ্নিঝরা রাত: বন্ধুদের অন্ধকার যাত্রা ও শেষ বিদায়"


 

শিরোপা উঠে দারালো, এশা বলল, "এটাই আমার বাঘের বাচ্চা

শিরোপা যেই যেতে যাবে, শয়তান লোকগুলো ওকে দেখে ফেলল । এশা বলল, "শিরোপা , তুই পলা,

আমি দেখছি ।" এশা বলল, "কী পুরুষের দল, কোথায় এদিকে আসো ?"

এদিকে, নাশিতা, সাইয়ারা, আর ফারিহা আল্লাহর কাছে দুআ করছিল। এর মধ্যে নাফিজ স্যার বললেন, "তোমরা এত সাহসী, তোরা মরবি আগুনে, জ্বালিয়ে দেবো।

" দরজা আটকে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। চারপাশে অদ্ভুত আগুনের ঝলকানি। সাইয়ারা বলল, "নাশিতা, সব শেষ, আমরা আর বাঁচবো না।" এর মধ্যে জানালা দিয়ে এশার আওয়াজ, "তরা এখানে আয়, আমি আসছি।

"ভয়ংকর আগুন দেখে তারা নড়তে পারছে না। এশা বলল, "সাইয়ারা, আমরা সাহসী, বের হও, আমি আসছি, হাত ধর, আমার সাইয়ারা।"

এশার হাত ধরল, ধরে বের হল। এরপর ফারিহা আর নাশিতা। এশা বলল, "বললাম না, আমি আসবো।" তারা সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল। তারা জিজ্ঞাসা করল, শিরোপা

কোথায়? এশা বলল, "ও লোক ডাকতে গেছে,

চল, আমার সাথে।" তারা খেয়াল করল

এশা কীভাবে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। হঠাৎ ফজরের আজান শোনা গেল। ওদিকে শিরোপা পুলিশ নিয়ে এসেছে।

সবাই দৌড়ে গেল শিরোপার কাছে।

শিরোপা কাঁদছে,

সাইয়ারা সবাই যেন আনন্দের মধ্যে।

সব অপরাধীদের ধরতে পুলিশ এসে গেল। হঠাৎ ফারিহা বলল, "এশা কোথায়?"

শিরোপা বলল, "এশা, এশা," বলে চিৎকার করছে। সাইয়ারা বলল, "কেনো আমাদের এখানে নিয়ে আসলে?" শিরোপা বলল, "অসম্ভব!"

এরপর শিরোপা পুরো কাহিনী খুলে বলল।

সবার চোখ কপালে, সবাই মিলেই এশা খুঁজতে লাগল। একজন চিৎকার করে বলল, "এটা কি তোমাদের বন্ধু?" দেখলো, এশার মাথায় গুলি লাগা।

তার মরদেহটা নিথর হয়ে পড়ে আছে। এই দৃশ্য যেন তাদের সবাইকে শেষ করে দিলো। সাইয়ারা বলল, "ও কথা রেখেছে শিরোপা ,

ও আমাদের কিছু হতে দেয়নি," বলে সবাই কান্না করতে লাগল।

ফারিহা যেন তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে,

নাশিতা আর্তনাথ করে আল্লাহ কে বিচার দিচ্ছে

সাইয়ারা এশার হাতটা ধরে অঝস্রে কান্না করছে

শিরোপা হঠাৎ তার হাতের দিকে তাকালো, এশার সেই তাবিজটা। ও বলেছিল, "এটা পর, তোর কিছু হবে না।" ওই কথাটা শিরোপার মনে পড়লো,

এশার নিথর দেহ ধরে বলল, "কেনো, তুই আমাদের রেখে চলে গিয়েছিস?"

এশা... এশা...।

নাফিজ স্যার আর প্রিন্সিপাল স্যারকে ধরে নিয়ে গেছে, তার দলবল সহ

এর আগে তারা এমন কাজ করেছে। তারা সবাই গাড়িতে বসে এখন এই জায়গা ছেড়ে চলে যাবে।

ওরা সবাই ওদের আগের মুহূর্ত মনে করছিল

কতনা খুশি ছিলো কি ভেবেছিল কি হলো

এসেছিল ৫জন আর যাচ্ছে ৪ জন

চারোপাশে একটা ঠান্ডা বাতাস এক বুক ভরা কষ্ট নিয়ে

আর ভয়ঙ্কর এক ভ্রমণ এর কাহিনী নিয়ে ওরা ফিরছে,

গাড়ি ছাড়তেই শিরোপা দেখলো, এশা দূর থেকে তার দিকে তাকিয়ে একটি হাসি দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

শিরোপা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো……

Comments