শাশুড়ি মা মাধবীলতা দেবী একসময় ছিলেন এই পরিবারের গর্ব। স্বামী বেঁচে থাকতে তিনি ছিলেন রাজরানির মতো। কিন্তু স্বামী চলে যাওয়ার পরই তার জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকার অধ্যায়। একমাত্র ছেলে অরূপ বউ আনার পর যেন তিনি এই বাড়ির অযাচিত বোঝা হয়ে গেলেন।
বউ মধুরিমা শিক্ষিতা, স্মার্ট, কিন্তু হৃদয়ে ছিল এক অদ্ভুত কঠোরতা। তার ধারণা, মাধবীলতা দেবীর সময় ফুরিয়েছে, এখন তিনিই বাড়ির মালিক। শাশুড়ির পুরোনো অভ্যাস, স্নেহময় ব্যবহার, ধীর কণ্ঠ তাকে রাগিয়ে তুলত।
— “মা, এত পুরনো ধাঁচের কথা বলবেন না তো! এখন আর ওসব চলে না,” মধুরিমা বিরক্ত মুখে বলত।
— “কিন্তু মা তো অভ্যাসবশত বললেন, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন?” অরূপ মাঝে মাঝে বুঝাতে চাইত।
— “তুমি বোঝো না, মা আমাকে ইচ্ছা করে ছোট করেন! আমি জানি।”
ধীরে ধীরে মধুরিমা শাশুড়িকে পুরো বাড়ি থেকে আলাদা করে দিল। খাওয়ার সময় দেরি হলে খাবার থাকত না, শাশুড়ির জন্য আলাদা কোনো কিছু করা হত না। তার শরীর খারাপ হলেও কেউ খোঁজ নিত না। অরূপ হয়তো মাঝে মাঝে কিছু বলার চেষ্টা করত, কিন্তু মধুরিমার ভালোবাসায় সে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিল যে মায়ের কষ্টগুলো উপেক্ষা করত।
এভাবে খুব খারাপ সময় পার করতে থাকে মাধবীলতা দেবী। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার। প্রায় সময় বসে ভাবতো যে ছেলেকে জন্ম দিলাম, বিয়ের পর কিভাবে এত বদলে গেলো।আমার জন্য কি একটুও খারাপ লাগে না। ছেলে বউ তো পরের মেয়ে কিন্তু ছেলে তো আমার সে কিভাবে এমন করে।
এরপর একদিন অরূপ তার সব সীমা অতিক্রম করলো।এক রাতে মার কাছে এসে বলল, মা তুমি কি এখনো ছোট নাকি এই সব কি করো। মাধবীলতা দেবী বলল কেনো বাবা কি হয়েছে? তুমি মধুরিমা কে কি বলেছ?
মাধবীলতা দেবী না তো বাবা আমি কিছু বলি নি। থাক থাক আর বলতে হবে না, আমি খুব জানি মধুরিমা তো তোমার বউ মেয়ের মতো ওর সাথে এমন করার দরকার ছিলনা। এই সব বলতে বলতে মধুরিমা চলে আসে। মাধবীলতা দেবী সব খুলে বলতে যাবে তখনই মধুরিমা বলতে শুরু করে থাক আমি কিছুই মনে করি নি অরূপ বাদ দাও মা তো। নাহ কেনো বাদ দিবো তুমি অনেক ভালো চিন্তা করো ভালো মনের মানুষ। মা দেখছো দেখো তোমার বউ তোমার কত চিন্তা করে। এই বলে অরূপ চলে গেলো আর মধুরিমা তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। মাধবীলতা দেবী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
এরপর ভাবতে লাগলো কি হয়েছিল মাধবীলতা দেবী ফ্রিজ খুলে আইস ক্রিম বের করে খেতে যাবে তখনই মধুরিমা এসে আইস ক্রিম নিয়ে নিলো মুখ থেকে। আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকলো। কিন্তু অরুপকে মধুরিমা উল্টোটা বলেছিল। সে বলেছিল মার ঠান্ডা লাগবে তাই মানা করেছি তাই মা আমাকে যা ইচ্ছা তাই বলল....
এই ভাবে কখনও মাধবীলতা দেবীর। জন্য খাবার থাকতো না, আবার ছেলে বউ মিলে বাইরে বেড়াতে চলে যেতো মাধবীলতা দেবী একা একা বাসায় বসে থাকে না খেয়ে। ছেলে কখন আসে আর কখন যায় কিছুই জানে না মাধবীলতা দেবী। খুব অসহায় দিন পার করছিল মাধবীলতা দেবী।
একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। মাধবীলতা দেবী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, কাঁপছিলেন ঠান্ডায়। হঠাৎ মধুরিমা এসে বলল—
— “মা, আপনি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন? বিছানায় যান।”
— “বউমা, আমার খুব ঠান্ডা লাগছে, একটু গরম পানি করে দেবে?”
মধুরিমা এক ঝলক তাকিয়ে বলল, “আমার অনেক কাজ আছে মা, আপনি নিজে করে নিন।”
দ্রুত সরে গেল মধুরিমা, আর মাধবীলতা ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে এগোলেন। সেদিন রাতে প্রবল জ্বর এলো তার। পরদিন কেউ খোঁজও নিল না। তিনি বিছানায় পড়ে রইলেন একা।
সময় গড়াতে লাগল। শাশুড়ির কষ্ট যেন মধুরিমার কাছে তুচ্ছ ছিল। একদিন হঠাৎ করেই মাধবীলতা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, একেবারে শয্যাশায়ী। ডাক্তারের পরামর্শে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল।
অরূপ তখন ব্যস্ত অফিসের কাজে, আর মধুরিমা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হাসপাতাল থেকে মাধবীলতা আর ফিরলেন না। একদিন ভোরে নিঃশব্দে চলে গেলেন তিনি, কারও প্রতি কোনো অভিযোগ না রেখে।
তার মৃত্যুর পর অরূপ শোকে ভেঙে পড়ল। কিন্তু মধুরিমা এতটুকু দুঃখ পায়নি। তার জীবন তো স্বাভাবিকভাবে চলছিল। কিন্তু বিধাতা তার জন্য অন্য কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন।
কয়েক বছর পর, মধুরিমার নিজের ছেলেও বড় হল, বিয়ে করল। তখন মধুরিমা নিজেই হলেন একজন শাশুড়ি। প্রথম কয়েক বছর সব ঠিকঠাক চলল, কিন্তু ধীরে ধীরে বউয়ের মনোভাব পাল্টাতে লাগল।
একদিন রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। মধুরিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, কাঁপছিলেন ঠান্ডায়। তখন বউ এসে বলল—
— “মা, এত রাতে দাঁড়িয়ে কেন? বিছানায় যান।”
— “বউমা, একটু গরম পানি করে দেবে?”
বউ মুখ ফিরিয়ে বলল, “আমার অনেক কাজ আছে মা, আপনি নিজে করে নিন।”
মধুরিমা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ঠিক একইভাবে, বহু বছর আগে, তিনিও এক বৃদ্ধাকে এমনই অপমান করেছিলেন। নিজের মনের ভেতর কোথাও একটা দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু এবার কেউ ছিল না তাকে ক্ষমা করে দিতে।
অপমানের আগুনে পুড়তে পুড়তে তিনি বুঝলেন, যে অন্যায় তিনি করেছিলেন, তার শাস্তি তিনি আজ নিজেই পাচ্ছেন…
তার এই কথা শুনার কেও নেই......