Posts

চিন্তা

সেকেন্ড রিপাবলিক ও নতুন দলের প্রতিজ্ঞা

February 28, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

139
View

মধ্যপন্থী জাতীয় নাগরিক পার্টি নিখাদ বাংলা ভাষাকে পাশ কাটিয়ে তাদের দলীয় স্লোগান নির্ধারণ করেছে ইনকিলাব জিন্দাবাদ। এছাড়াও তারা দলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আপোষ না সংগ্রাম, ক্ষমতা না জনতা, দালালি না‌ রাজপথ স্লোগান দিয়েছে। ভাবাদর্শ হিসেবে তারা ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা, বহুত্ববাদ ও বিপ্লববাদের কথা বলেছে। দল গঠনের অনুষ্ঠানে বিএনপি ছাড়া দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ যোগ দিয়েছেন। গোড়া থেকেই ক্ষমতায় বসে দল গঠনের বিরোধিতা করেছে বিএনপি। কারণ এই দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের কেবিনেট থেকে পদত্যাগ করলেও অন্যতম থিংক ট্যাংক মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া এখনো সরকারে রয়ে গেছেন। এমনকি খোদ প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসেরও আনকোরা এই দলটির প্রতি বলিষ্ঠ আশীর্বাদ রয়েছে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।

দলটির প্রধানতম ন্যারেটিভ তথা বয়ান হলো জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর তারা বাংলাদেশকে সেকেন্ড রিপাবলিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এবং গণপরিষদের ভোটে জিতে নতুন সংবিধান লিখতে চায়। তাদের এই চাওয়াটা যদি বাস্তবায়ন হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে পাওয়া বাংলাদেশ আপনাআপনিই বাতিল হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের আপামর জনগণ, অন্যান্য রাজনৈতিক দল 'জাতীয় নাগরিক পার্টি'কে কি এই ম্যান্ডেট দেবে?

এনসিপি তাদের উদ্বোধনী ভাষণে নতুন বাংলাদেশ গড়ায় সবাইকে প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে শপথ করা, ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দৃঢ় চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে।

নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সামনে রেখে রাষ্ট্রকে বিনির্মাণ করব।’
রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নাহিদ ইসলাম এসব কথা বলেন।

প্রশ্ন হলো, ভারত ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি মানে কী? ভারতপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি মূলত দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত দুটি শব্দ, যা বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাস, কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

ভারতপন্থী রাজনীতি বলতে এমন রাজনৈতিক অবস্থান বোঝায়, যেখানে ভারতকে কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখা হয়। এই ধারা সাধারণত ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্ক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার পক্ষে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত ছিল বাংলাদেশের প্রধান মিত্র। তাই মুক্তিযুদ্ধপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলো সাধারণত ভারতপন্থী বলে বিবেচিত হয়।

অপরদিকে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি বলতে বোঝায় এমন রাজনৈতিক আদর্শ, যা পাকিস্তানের প্রতি নরম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে বা তার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি সাধারণত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরোধিতা না করা বা পাকিস্তানের সমর্থক থাকা রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও কিছু ডানপন্থী দল ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানপন্থী বলে পরিচিত।

এনসিপি বলছে, 'আমরা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চাই, যেখানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান হবে না।' এগুলো শুনতে খুবই ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবতা কি আসলে তাই? বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের প্রধানতম এজেন্ডাই হলো ক্ষমতার বাইরে থাকাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রতিশোধস্পৃহা জাগিয়ে রাখা। সেখান থেকে এনসিপি বের হয়ে আসতে পারবে এমন নমুনা বা নজির গেল ৬ মাসে তারা কি রাখতে পেরেছে?

নাহিদ ইসলাম তাঁর ভাষণে বলেছেন, 'জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান কেবল একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধেই বিজয় নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণেরও শপথ। চলুন, আমরা একসঙ্গে হাতে হাত রেখে, এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হবে, যেখানে  ন্যায় প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকারের সংগ্রামই হবে রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য। যেখানে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। এখনই সময়—নতুন স্বপ্ন দেখার, নতুন পথচলার, এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার!

মিস্টার ইসলাম আরও বলেন, আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে মূলধারায় তুলে আনা হবে। আমাদের রিপাবলিকে সাধারণ মানুষ, একমাত্র সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস। তাদের সকল ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের রিপাবলিক সকল নাগরিককে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকেই অপরায়ণ করা হবে না; বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব প্রদান ও সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।'

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাদের প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্রে বলেছে, 'এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।'

এসব খুবই ভালো কথা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ব্যাপক ও বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করেছে জামায়াত ও বিএনপি অ্যাক্টিভিস্টরা। শহীদ হয়েছেন এবং আহতও হয়েছেন অনেকেই। আন্দোলনে অংশ নেয়া বা প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেয়া সদস্যরা এনসিপিকে ঠিক কীভাবে সমর্থন জোগাবে? বস্তুত এটা অসম্ভব। বিএনপি, জামায়াত বা হেফাজতের ভাবাদর্শের সাথে এনসিপির কোনোধরনের মিল নাই। এমনকি নির্দিষ্ট ধর্মীয় ভাবাদর্শকে নিজেদের দলে আত্মীকৃত না করে এনসিপি মধ্যপন্থাকে তাদের মটো বা আদর্শ মানছে। এমন এক বাস্তবতায় দেশের আপামর জনতা যারা বিভিন্ন মতাদর্শে বিভক্ত তারা ঠিক কীভাবে এনসিপির ভাবাদর্শে অবগাহন করবে সে ব্যাপারে সর্বজনবিদিত কোনো রূপরেখা এখনো আমরা পাইনি। বরং এটা বলতে পারি গণ-আন্দোলনে পরাজিত আওয়ামী লীগের কতিপয় হাইব্রিড সদস্যদের সমর্থন পেতে পারে এনসিপি। যারা আদর্শবাদিতার বাইরে গিয়ে দলবদলকে নিজেদের আখের গোছানোর ফিকির হিসেবে দেখে।

এনসিপি বলছে, 'জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারব।'

তাহলে আমরা ধরে নিচ্ছি, এনসিপির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অভিলাষ হলো ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় গিয়েই নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করা। এই মুহূর্তে আমরা মনে করছি এই ভাবনাটি একেবারেই অলীক কল্পনা। এনসিপি এখনই কী করে ভেবে নিয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ নাই হয়ে গেছে অথবা থার্ড ওয়ান হয়ে গেছে? ধরে নিচ্ছি আওয়ামী লীগকে সহসাই রাজনীতিতে ফিরতে দেয়া হবে না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম বড় দাবিদার বিএনপি কি হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবে? তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা বীর উত্তম জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লেজেন্ডারি পার্সন। সেই দলটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পাওয়া ৫৪ বছরের বাংলাদেশ ভেঙে দিয়ে সেকেন্ড‌ রিপাবলিক কেন মানবে? এটা মানলে একাত্তরে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা খাটো হয়ে যাবে না?

এমনকি আমরা এটাও বিশ্বাস করি দেশের অন্যতম বড় দল জামায়াতে ইসলামীও এনসিপির সেকেন্ড রিপাবলিক বিষয়টি মানতে পারবে না। কারণ তাদের দলীয় মেনোফেস্টো মোতাবেক আল্লাহ্'র আইন ও সৎলোকের শাসনের অনুবর্তী এনসিপির মধ্যপন্থা মিশতে পারবে এমটাও বোধ করি না।

সুতরাং নতুন দল গঠন করে সবাইকে যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেয়া হলো সেটি প্রথমেই বড় ধাক্কা খেল। বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। এরমধ্যে কেবল একটি দল সেকেন্ড রিপাবলিক চাইলে তো হবে না। অন্তত ওয়ান থার্ড মেজরিটিকে ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে। দেখা যাক সেই কঠিন কাজটি এনসিপি আদৌও কতটা গুছিয়ে নিতে‌ পারে।

আমরা বরাবর নতুনত্বের পক্ষে। নতুন আত্মপ্রকাশ করা কোনো রাজনৈতিক দল যদি সত্যিকারের আদর্শবোধ, নৈতিকতা, সততা ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে জনতার ক্ষমতার মুখপাত্র হয়ে উঠতে পারে আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাবো।

দেখার ব্যাপার এটিই যে, আসলে কতক্ষণ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বিতর্ক ও বিভাজনের উর্ধ্বে উঠে দেশ ও গণমানুষের পক্ষ হয়ে কথা বলতে পারে। আমরা চাই সব কথা কেবলই কথার কথা না হয়ে থাক। সেকেন্ড রিপাবলিক যদি সর্বমানুষের জন্য মঙ্গলজনক প্রমাণিত হয় কেবল তখনই আমরা এর প্রশংসা করব। এর আগ পর্যন্ত আমাদের সমন্বিত সংশয়বাদ আমরা জিইয়ে রাখব।

লেখক: সাংবাদিক 
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login