Posts

গল্প

একজন কবি একজন গল্পকার

March 1, 2025

আসেফ আব্দুল্লাহ

151
View

অন্ধকার বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি চোখ বন্ধ হয় ঘুম আসে না তাই চশমাটাও চোখ থেকে খুলিনা। চশমা পরেই শুয়ে থাকি অন্ধকার রুমে তাও সবকিছু যেন চোখে দেখতে পাই।‌ আলনায় অগোছালো ঝুলন্ত কাপড় দেখে মনে হয় , আচ্ছা এইটা কি ভূত? জানি ভূত না। আমার ঘরে চার দেয়ালের মধ্যে আমি একা।‌ এতো একা কেন আমি? বিছানায় আমার পাশে তো একজন কেউ থাকতে পারতো? প্রেমিক প্রেমিকার কথা বলছি না।‌একটা সময় ছিল আমার একা ঘুম আসতো না, ভয় পেতাম ভূত দেখতাম মায়ের ওমে ঘুমাতাম। এখন থাকি একা , ঘুমটা এখন আমার একাকীত্বের সঙ্গী হিসেবে শুয়ে থাকে। ঘুমকে নিয়ে এক বিছানায় শুই, কখনো ৩-৪ আবার কখনো ৫-৬ ঘন্টার জন্য ঘুম আমার একাকীত্বের অনুভূতিটা দূর করে দেয়। মাঝে মাঝে মনে হয় মামুনের বলা ওষুধ গিলে শুই, যদি এতে ঘুমকে ধরে রাখা যায়।

আমার ওষুধের পলিতে হাতড়ে ফিলফ্রেশ এর ফাঁকা মোড়ক পাই সাথে কিছু নাপা। মাথাব্যাথা  করছে কি? বুঝতে পারিনা। ভাল্লাগে না কিছু। এর থেকে মনে পড়ে এক কবির ভাষ্যমতে 'ভাল্লাগে না' একটা রোগ আমি যেন ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার দেখিয়েছিলাম 'ভাল্লাগে না'র প্রতিকার হয়নি। ওকে বলি ডাক্তার বলেছে আমি তোমার সঙ্গ পেলে আমার ভালো লাগবে। ভাল্লাগেনা রোগ সেরে যাবে। ও বিশ্বাস করে না। এমনকি আমি যে 'ভাল্লাগে না'র জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট এর  কাছে গেছি বড় আশ্চর্য হয় ও। ওর মতে আমি বাজে খরচা করেছি। করেছি তো করেছি। কিছুদিন, কিছুমাস অন্তত আমি ভালো ছিলাম। ঘুমকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে থাকতে পারতাম। তখন আমার মনে ওর অস্তিত্ব ছিল কিন্তু আমার অবচেতনে, আমার ব্যাক্তিগত ভাবনায় জীবনে প্রভাব ফেলেনি। ওর অস্তিত্ব ওর মতো থেকেছে, একই শহরে হলেও আমার থেকে ছশো মিটার দূরে থেকেছে।

কটা বাজে এখন? মাত্র সাড়ে তিনটা। আচ্ছা ও তো এখন রাজশাহীতে। ও নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে আমার থেকে ছশো মিটার দূরে, আর আমার থেকে ২০ ফুট উপরে ।এক তলা ১০ ফুট উচ্চতার হলে তো তাই হয় তাইনা? আচ্ছা এক মিটার সমান কত ফুট? ওকে জিগ্গেস করতে হবে কিন্তু ও তো এখন ঘুমে। ওর ঐ ছোট্ট রুমে তো আমিও ঘুমিয়ে গেছিলাম । সিঙ্গেল বেড , সিঙ্গেল চাদর তার নিচে একজন কবি , একজন গল্পকার। আমিও যদি কবি হতাম তাহলে লেখতে পারতাম দুজন কবি, কিংবা খুব রোমান্টিকভাবে এই ক্রিঞ্জ সিনম্যাটিক বিষয়টা যদি সত্য হতো যে আমরা দুই দেহ এক প্রাণ তাহলে লেখতাম একজন কবি এবং গল্পকার। দুই দেহ এক প্রাণ। 
এবার আমাদের দুজনেরই বই বের হচ্ছে। একই বইমেলায় ওর কবিতা, আমার গল্প। এবার আমি দ্বিতীয়বারের মতো বইমেলা যাবো। ও তো যাবেই। এটা দিয়ে ওর কত নম্বর বই? তিন নম্বর মনে হয়। আমার প্রথম বই, ও কি আমার বই কিনবে? পড়বে? জানিনা ‌।

গতবছর তো আমি কিনে লাইন দিয়েছিলাম ওর অটোগ্রাফ নিতে এই ভার্সিটির বই মেলায়। ঈশ! ভুল বললাম। দুবছর হয়ে গেছে। ও সুন্দর করে কালো কালিতে 'বেয়াদব' লিখে দিয়েছিল বইটার প্রথম ধবধবে সাদা পেজে। আমার জন্মদিনে ২৪শে ফেব্রুয়ারিতে।

এবার কি ওর সাথে আমার দেখা হবে বইমেলায়? আচ্ছা বইমেলায় কাদের প্রেম হয়েছিল? মনে পড়ছে না, মগজে মরিচা ধরে গেছে।  তসলিমা আর রুদ্র তো বইমেলায় প্রেম করেছিল। আমরা কি পারবো? ও তো জানে ও আমার ফেভারিট। মেসেঞ্জারে ওর ছবির পাশে নিকনেমটা তো জ্বলজ্বল করে। ফেভারিট , আমার দেয়া নিকনেম।ও কি জানে কেন ফেভারিট?

ওর সাথে ঘুমোতে পারলে শান্তি লাগতো, নাকি লাগতো না? এত্ত কনফিউশন! নাপা যেন মাথাব্যাথা আরো বাড়িয়ে দিলো। শরীরে কি প্রেম ভর করেছে? নাকি বিরক্তি? কবিকে ডাকবো! ও কী আসবে? আগে এসেছে অনেকবার ‌। এই বিছানাতেই আমরা শুয়েছি শান্তিতে শুয়েছি বলা যায় না কারণ শোবার পর না ও শান্ত থাকত আর না আমি। আদিম চঞ্চলতায় মেতে উঠতাম আমরা যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে একবার অবশ্য শান্ত ছিল। হঠাৎ করে ওর আদিম চঞ্চলতা সেবার বন্ধ হয়ে যায়। ও মিথ্যা মিশিয়ে বলেছিল যে সবার জন্যই ও এখন নিষ্কাম, নিষ্ক্রিয়। 
"একজন নিরাশ্রয় পূর্ণ যুবতীকে ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে সাধারণত্বও নেই অসাধারণত্বও নেই। লোকে তাকে নপুংশক বলে।" ঋতুপর্ণের চোখের বালির বিনোদিনীকে যখন বিহারী ফিরিয়ে দিলো এরকমই কিছু একটা বলেছিল বোধ হয় বিনোদিনী। আমিও কি বলিনি? সরাসরি নপুংশক হয়তো বলা হয়নি।‌উচিত ছিলো বলা। আমি তো বিনোদিনীর মতোই ভিক্ষা করেছিলাম। আদিম চঞ্চল প্রাণী থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল ও ,আমি একটু সঙ্গ ভিক্ষা চাইলাম। একবার ওর বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে চেয়েছিলাম। ও সেবার রাজি হয়েছিল। যেই বিছানায় শুয়ে আজ আমি ঘুমকে কাছে ডাকছি সেই বিছানাতেই ওর চেককাপড়ে ঢাকা বুকে আমি মাথা রেখে ওম নিচ্ছিলাম, একটু পরেই আমার চোখ বুজে আসে । তখন হয়তো ও মোবাইলে চোখ আর হাত দুটোই বুলোচ্ছিল। নাকি একটা হাত আমার মাথায় বিলি কাটছিল? আমার মনে নেই। তবে আমার পাশ বালিশ সেদিন আমাকে ওভাবে দেখে হিংসায় জ্বলেছে এটা আমি নিশ্চিত।সেই একটা দিনই ও আমার বিছানায় শান্ত ছিল।

কিন্তু ও যে সবার জন্যই নিষ্ক্রিয় এসব মিথ্যা বলেছিল । এক কোঁকড়া চুলের আবৃত্তিকার অনেক সত্যই তুলে ধরে আমার সামনে। সবকিছু শুনে ফেভারিট এর উপর থেকে মনটা উঠে যায়। ফেভারিট তো আমাকেও কবিতা দিতে পারতো। আমাকেও বলতে পারতো "এই কবিতাটা তোমার কন্ঠে খুব সুন্দর লাগবে" নিবেদন করতে পারত একটি কবিতা। কোঁকড়া চুলের আবৃত্তিকারকে কবিতা দিলো, আবৃত্তিকার আবৃত্তি করল। কিন্তু আমাকে কি এক আধটা কবিতা দেয়া যেতো না? আমার জন্য কি এক আধটা প্রেমের কবিতা লেখা যেত না? এজন্যই কি কবিতায় আমার এতো বিতৃষ্ণা। আমি তো কতবার ওকে বলেছি আমাকে নিয়ে কবিতা লেখা যায় না? আমার মধ্যে কী কাব্যিক কিছুই নেই? আমাকে নিয়ে লেখলো না, আমার বাগানে যে টুকটাক ঘুরে বেড়াতো, ছবি তুলতো কানে নয়নতারা গুঁজে, সেটা নিয়েও কী লেখা যেতো না? কবিতা লেখা কী এতই কঠিন!

ওর ওসব আচরণে , অবহেলায় কবিতা এক দুর্গম পাহাড়ের মতো লাগতে লাগে।মনে হতে থাকে আমার মতো অথর্ব কে দিয়ে এই দুর্গম পাহাড়ে ওঠা অসম্ভব। কেন যেন তখন থেকেই গদ্য গল্প উপন্যাসে না নেই কিন্তু কবিতা হলেই মন এমন বিরক্ত? আমি জানিনা। আগে তো অল্প কিছু হলেও পড়তাম কবিতা । কিছু জীবনানন্দ, কিছু রুদ্র তো আমিও পড়েছি। ওর দ্বিতীয় বই তো লাইনে দাঁড়িয়ে 'বেয়দব' অটোগ্রাফ নিয়ে সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু কটা কবিতা পড়েছি ওটার? দু একটা বোধহয় আবার বেশিও হতে পারে। মনে নেই কিছু।

ফেভারিটের উপর থেকে যে মন উঠে গেছিল ওর এক ডাকেই এই মন যেন প্রাণ ফিরে পেল। ওর এক ডাকে মনের সাথে সাথে শরীরটাও চলে গেল।এইতো সেদিনই ২৪শে অক্টোবর ওর ডাকে ওর ঘরে আমি হাজির। উঠে যাওয়া মন ফের জোড়া লেগে যায় ।
তারপর ১৮ ই নভেম্বর। এরপর ৭ই ডিসেম্বর। তারপর কয়েকদিন বাইরে দেখা। নতুন বছরে বাতিঘর এ কয়েকবার দেখা । বার্গার প্যালেসে একসাথে বার্গার চিবানো, ইয়াম সো জুসি। ওকে বার্গার খেতে দেখে খুব সুন্দর লাগছিল ওর ঠোঁটে গর্লিক সস লেগেছিল। চিকেন ফ্রাই এর সাথে গার্লিক সস অনেক ভালো লাগে, বাইরের ক্রিসপিনেসের সাথে রসুনের টেস্ট আর ভেতরে জুসি চিকেন। ওর ঠোঁটের সাথে গার্লিক সসের কম্বো কী ইয়াম্মি হবে? ও তো সিগারেটও ফুঁকে না। নির্মল ঠোঁট, ঠোঁটের উপরে গোঁফ ‌। ভালই লাগে দেখতে, চুমু খেতে, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ভালোবাসার অতল গহ্বরে ডুব দিতে। ইয়াম সো জুসি এন্ড লাভলি।

আচ্ছা কবে ওর কাছ থেকে বই নিলাম? ১৮ নাকি ৭ ? 
সাত ডিসেম্বরই হবে হয়তো ‌। ওর টেবিলে তাক তাক করে সারি দেয়া বই‌ । খুব যে বেশি তা না ‌।৩৫-৪০ টা হবে বোধহয়,গুনিনি আমি‌ । পছন্দের তেমন বই দেখলাম না। কিছু সমকালীন কবিতা, আর কিছু আমার আশেপাশের কবিদের কবিতার বই। দেখলাম পুর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন ‌, আমি চাইলাম যেন ওর বইয়ে আমার হক আছে ‌‌আর ওর উপর আছে আমার অধিকার ‌‌। ভেবেছিলাম দিবে না, আমাকে আশ্চর্য করে বইটা ও দিয়ে দিলো ‌। আমি চাহিবা মাত্রই সে আমাকে বইটা দান করিল , প্রদান করিল। নিলাম তো ঠিকই। তারপর যখন বেস্টিকে যেয়ে বলি এই বইডা নিছি ওর কাছ থেকে। গবেটের মতো বলি পূর্ণেন্দু পাত্রীর কথোপকথন দিছে আমাকে। বেস্টি শুধরিয়ে দেয়। সত্যিই এরকম বিখ্যাত একজনের নাম বদলাবার আস্পর্ধা কোত্থেকে এলো আমার। কীরকম গবেট আমি পত্রিকে বলি পাত্রী। আচ্ছা আমি কি ভালো পাত্রী হতে পারবো? ফেভারিট কি ভালো পাত্র হবে? উমমম আমার জানা নাই। ও তো বলে ওর কচি লাগবে বিয়ের জন্য। টিপিকাল ব্রাউন গাই। ভালো কবিতা লেখলেই কি কেউ অসাধারণ হয়ে যায়? যায় হয়তো কবি হিসেবে। মানুষ হিসেবে তো কাছ থেকে আমি অন্য কিছুই দেখি, নাকি আমার দেখায় সমস্যা? আমারই দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো অত্যাধুনিক? এটাও জানিনা। জানিনা আমি কিছুই জানিনা। আমি জানি ও আমাকে ভালোবাসে না। নাকি বাসে? সবাই বলে ভালোবাসলে অনেক কিছু বোঝা যায়। ওর ভালোবাসা বুঝতে যেয়ে তো আমি প্রতিবার ছেছড়া হয়ে যাই। ওর আশেপাশে ওর শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও আমি দেখতে পারিনা, বিরক্ত লাগে। কবি মানুষ তার শুভাকাঙ্ক্ষী থাকবে খুবই স্বাভাবিক; কিন্তু ওর শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও আমার শুভাখানকী মনে হয়। ছি কী বাজে লাগছে শুনতে! কিন্তু এটাই আমার মনের আনফিল্টার্ড কথা যেটা সবসময় চেপে চেপে রেখেছি, ভেতরে পুষেছি,বড় করেছি। এটা কী জেলাসি? নাকি ওকে হারিয়ে ফেলার চাপা ক্রোধ? কবির জন্য এক গল্পকারের কী এতো প্রেম? দুটো ডাইমেনশন কিন্তু একটা জায়গায় বারবার মিলিত হতে হয়। আমাদেরও মিল হয়ে যায় কখনো পরিকল্পনামাফিক কখনো কাকতালীয়ভাবে। কবি কি গল্পকারের প্রেমে পড়তে পারেনা? আমি এটারও উত্তর দিতে পারছি না। 

আমি কেন এখনো ঘুমে ঢলে পড়ছি না!

জানালার পর্দা সরাই, বাইরে অন্ধকার কিন্তু কিছু আলো তীব্রভাবে তরঙ্গ বিকিরণ করে আমাকে জানাচ্ছে ,"তুই শহরে থাকিস। গ্রামের নির্মল অপরূপ আকাশ তুই দেখবি না।" আকাশে আলোর তরঙ্গ আছে তবুও চারদিক অন্ধকার। আমি এখন খুব করে চাইছি একটা বড় ঝড় উঠুক। বৃষ্টি না হোক, একটা প্রলয়ংকরী ঝড়ে যেন চারিদিক ধূলোয় ধূসরিত হয়ে যায়। মানুষগুলো সব বিষাক্ত!  শহরটা সে তুলনায় অনেক পরিষ্কার। ঝড়ের বাতাসে যেন সব মানুষের বিষ আকাশে উড়ে যায়, উড়ে গিয়ে ডানা মেলে, বাষ্পের মতো মেঘ হয়ে যায়। চারিদিক আলোকিত করে যেন বজ্রপাত হয়। আমার মতো যারা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে তারা যেন বজ্রআলোয় সবকিছু দেখতে পায়। বৃষ্টি নামুক। মানুষের কাছ থেকে উড়ে যাওয়া বিষ যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। কতদিন বৃষ্টির শব্দ শুনিনা। কতদিন হয়ে গেলো বৃষ্টি দেখি না, বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ কতদিন হলো পাইনা। এই বিষবৃষ্টিতে ভিজতে চাই আমি। আমি জানি বিষবৃষ্টিতে আমার কিছু‌ই হবেনা। প্রচুর বিষ জমেছে আমার মধ্যে, দংশানোর মানুষ কই!

এবার আমার চোখ বুজে আসছে,ঘুম ঘুম পাচ্ছে। শরীরের বিষ হার মেনে নিয়েছে ওষুধের কাছে। এক কবির স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিদ্রায় যাচ্ছে এক গল্পকার।

Comments

    Please login to post comment. Login