বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল, কিন্তু শহরের রাস্তাগুলো এখনও ভিজে ছিল। ধীরে ধীরে গাছের পাতা থেকে পানি ঝরতে থাকল, আর আকাশেরমেঘ যেন টুকরো টুকরো হয়ে সরে যেতে শুরু করেছিল। শহরের এক কোণে, একটি পুরনো ক্যাফে, সিমা নামের একটি মেয়ে একা বসেছিল। তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শূন্যতার মধ্যে ডুবে গেছে সে। ক্যাফে থেকে কফির ঘ্রাণ ছড়িয়েপড়ছিল, কিন্তু সিমার মনে কোনো আনন্দ ছিল না।
তার জীবন ছিল এক রকম সাদামাটা। তার দিনের শুরুটা, শেষটা—সবই ছিল এক রকম। অথচ, এক অজানা কিছু তাকে ক্ষিপ্রভাবেনিয়ে যাচ্ছিল। এমন কোনো কিছু যা সে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু অনুভব করছিল। তার মনের গভীরে যেন এক অদৃশ্য রং আঁকা ছিল, কিন্তু সে রঙের মানে কিছুই জানত না।
একদিন, সিমার সেই ক্যাফেতে ঢুকল একটি ছেলেটি। তার নাম ছিল রাহুল। রাহুলের চোখের মধ্যে যেন এক বিশেষ রহস্য ছিল, একধরনের শান্তি, যা সিমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল। রাহুল সিমার পাশের টেবিলে বসে এক কাপ কফি অর্ডার করল। প্রথমে সিমা কিছুইবুঝতে পারেনি, কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার চোখ রাহুলের দিকে আকর্ষিত হলো। সে বুঝতে পারল, রাহুলের মাঝে কিছু বিশেষ ব্যাপার ছিল।
একটা সময় ছিল, যখন সিমা তার নিজের মনে শান্তি খুঁজে পেত, কিন্তু রাহুলের উপস্থিতি যেন তার দুনিয়াকে নতুন করে রঙিন করেদিল। তাদের চোখের সংযোগে কিছু ছিল, যা সিমার হৃদয়ের মধ্যে এক অজানা অনুভূতি জন্ম দিল।
এই প্রথম, সিমা অনুভব করল তার জীবনটা সত্যিই কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে চলতে পারে। একে অপরের দিকে তাকানো, কথা বলা—সবইযেন সেই অদৃশ্য রঙের এক অংশ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সিমার মনে অনেক প্রশ্ন ছিল, অনেক অজানা ছিল। সে বুঝতে পারছিল না এইঅনুভূতি কেন হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, এবং এর মানে কী।
এভাবেই সিমার জীবনে প্রথমবারের মতো প্রেমের একটি রং ফুটে উঠল।
রাহুল ও সিমার মধ্যে কথোপকথন শুরু হয়েছিল খুবই সাধারণভাবে। প্রথমে তার দিকে তাকানো, তারপর কিছু কথাবার্তা, তারপর একেঅপরকে বুঝতে শুরু করা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, সিমার মনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসছিল। তার দিনগুলো যেন রাহুলেরউপস্থিতির সাথে আরো রঙিন হয়ে উঠছিল। প্রতিটি মুহূর্তে, সিমার মনে এক নতুন আবেগ, এক নতুন অনুভূতি জন্ম নিত। প্রথমবারেরমতো, সে অনুভব করছিল, তার পৃথিবীটা যেন একটু হালকা হয়ে উঠেছে।
রাহুলের কথা, তার হাসি, এমনকি তার নীরবতা—সবকিছুই সিমার জন্য এক নতুন সুরে বাজছিল। সিমা বুঝতে পারছিল না কেন, কিন্তুতার মনের রং যেন বদলে যাচ্ছিল। একদিন, রাহুল সিমাকে প্রশ্ন করেছিল, "তুমি কি কখনও মনে করো যে, আমাদের জীবনের সবকিছুএকটা ক্যানভাসের মতো? একে একে আমরা সেই ক্যানভাসে আমাদের রং তুলছি, আর জীবনটা হয়ে উঠছে এক অদ্ভুত ছবি?"
সিমা কিছুটা চুপ করে গিয়েছিল। তার মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। সে জানত না কী উত্তর দিবে, কারণ তার নিজের মনের রংকী, সেটা সে নিজেই বুঝতে পারছিল না। তবে, রাহুলের প্রশ্ন যেন তার ভেতর একটা নতুন আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। "হয়তো," সিমাউত্তর দিল, "আমাদের জীবন সত্যিই একটা ক্যানভাস, কিন্তু কখনও কখনও আমাদের হাতে ঠিক মতো রঙ থাকে না।"
রাহুল হেসে বলেছিল, "কিন্তু আমাদের হাতে যতটুকু রঙই থাকুক না কেন, তাও আমরা সেই ক্যানভাসে আমাদের ছবি আঁকতে পারি।" সিমার মনে হয়েছিল, রাহুলের কথা সত্যি—তারা নিজেদের জীবনের রঙ বেছে নিতে পারে, এমনকি যখন সব কিছু অন্ধকার মনে হয়, তখনও তাদের হাতে কিছু রঙ থাকতে পারে।
একদিন, রাহুল ও সিমা ক্যাফেতে বসে কফি খাচ্ছিল। তাদের মাঝে আর কোনো অজানা ছিল না, তাদের সম্পর্ক যেন এক নতুন দিকথেকে বিকশিত হচ্ছিল। সিমা অনুভব করছিল, তার জীবনটা এক নতুন অর্থ পাচ্ছে। তবে, সে এখনও বুঝতে পারছিল না কেন রাহুলেরসাথে তার সম্পর্ক এত গভীর হয়ে উঠছে, কেন তার মনের রঙ এত দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
রাহুল একসময় বলল, "তুমি জানো, মাঝে মাঝে আমি ভাবি, যদি আমাদের সম্পর্কের রঙ কখনো ম্লান হয়ে যায়, তাহলে কি আমরাআবার নতুন করে শুরু করতে পারব?"
সিমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, "আমাদের সম্পর্কের রঙ যদি ম্লান হয়ও, আমি নিশ্চিত, আমরা আবার নতুন রঙ খুঁজে পাব।"
এভাবে, সিমা তার মনের রঙের সাথে আরও কাছাকাছি যেতে শুরু করল, কিন্তু তখনও তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা ছিল—এইসম্পর্কের ভবিষ্যত কী হবে?