Posts

গল্প

অভিশপ্ত বাড়ি

March 3, 2025

Yeashin

75
View

 

প্রথম অধ্যায়: অদ্ভুত আমন্ত্রণ

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। শহরের এক প্রান্তে ছোট্ট একটি ক্যাফেতে বসে রয়েছেন রুদ্র। হাতে এক কাপ কালো কফি, আর সামনে টেবিলের ওপরে রাখা পুরনো একটা চিঠি। চিঠিটা এক সপ্তাহ আগে এসে পৌঁছেছে তার ঠিকানায়। প্রেরকের নাম লেখা নেই, শুধু বলা হয়েছে—

"আপনাকে আমার পারিবারিক বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে এসে আমাদের পরিবারের অতীতের রহস্য উন্মোচন করুন। আপনার উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনাকে জানানো হবে।"

ঠিকানাটি লেখা আছে— শংকরপুর জমিদার বাড়ি।

শংকরপুর নামটা রুদ্রের কাছে অপরিচিত ছিল না। তার দাদুর মুখে এই বাড়ির কথা অনেক শুনেছে। তবে সেই গল্পগুলো কখনোই সুখের ছিল না। তার দাদু বলতেন, শংকরপুর জমিদার বাড়ি একসময় সমৃদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন তা একেবারেই পরিত্যক্ত। কেউ ওখানে থাকতে চায় না। কারণ, এই বাড়িতে বহু বছর আগে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল।

এই চিঠির পর থেকে রুদ্রের মনে একটা অজানা কৌতূহল কাজ করছিল। সে ঠিক করল, যেতেই হবে। রহস্য উন্মোচন করতেই হবে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: ভয়ঙ্কর যাত্রা

পরদিন সকালে রুদ্র রওনা দিল শংকরপুরের উদ্দেশ্যে। শহর থেকে জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়, তবু রাস্তাটা বেশ অন্ধকার আর নির্জন। পুরনো পথ, আশেপাশে শুধু বড় বড় গাছ আর জঙ্গলের মতো পরিবেশ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই রুদ্র দেখতে পেল বিশাল এক পুরনো বাড়ি।

জমিদার বাড়িটি দেখে গা ছমছম করে উঠল তার। ইটগুলো জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে, জানালার কাঁচ ভাঙা। বাড়ির সামনের ফটকটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এলো। রুদ্র একটু শিহরিত বোধ করল।

সে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই একজন বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এলেন। গায়ের পোশাক মলিন, চোখে গভীর গ্লানি।

— "আপনিই রুদ্র বাবু?"

— "জি, চিঠিটা আমি পেয়েছি, তাই এসেছি।"

— "চলুন, জমিদার বাড়ির আসল গল্পটা আপনাকে বলি।"

রুদ্র বৃদ্ধের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। অন্ধকার করিডোর, মোমবাতির আলো, আর আশেপাশে হালকা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা— সব মিলিয়ে পরিবেশটা আরও বেশি অস্বাভাবিক লাগছিল।

তৃতীয় অধ্যায়: জমিদার বাড়ির অতীত

বৃদ্ধ লোকটি বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বলতে শুরু করল,

— "এই বাড়ির শেষ জমিদার ছিলেন রাজীব নারায়ণ রায়। অত্যন্ত কঠোর স্বভাবের মানুষ ছিলেন। নিজের স্ত্রী এবং একমাত্র ছেলেকেও খুব বেশি ভালোবাসতেন না। স্ত্রী একদিন আত্মহত্যা করেন, কিন্তু কেউ জানত না কেন। এরপর এক রাতে তার ছেলেও নিখোঁজ হয়ে যায়। জমিদার পাগলের মতো ছেলেকে খুঁজতে থাকেন, কিন্তু ছেলের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।"

— "তারপর?" রুদ্র কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

— "তারপর জমিদার একদিন নিজের ঘরেই আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, ‘আমার ছেলের আত্মা এই বাড়িতে রয়ে গেছে। কেউ যদি ওর আত্মাকে মুক্ত করতে পারে, তবেই এই অভিশপ্ত বাড়ির রহস্য শেষ হবে।’"

রুদ্রের গা ছমছম করে উঠল।

— "তাহলে আমাকে কেন ডাকা হলো?"

— "কারণ আপনি জমিদার পরিবারের শেষ উত্তরাধিকারী। আপনার রক্তেই আছে সেই ক্ষমতা, যা দিয়ে এই আত্মাকে মুক্ত করা সম্ভব।"

চতুর্থ অধ্যায়: রহস্যের গভীরে

রুদ্র ভাবল, সে যদি সত্যিই জমিদার পরিবারের একজন হয়, তবে এই রহস্যের সমাধান করতেই হবে। সে রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নিল।

রাত বাড়তেই বাড়ির পরিবেশ আরও ভয়ানক হয়ে উঠল। একসময় রুদ্র অনুভব করল, কেউ একজন তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। হঠাৎ করিডোরের এক কোণ থেকে চাপা ফিসফিসানি ভেসে এল—

"আমাকে মুক্ত করো..."

রুদ্রের গা শিউরে উঠল। সে ধীরে ধীরে সেই শব্দের উৎসের দিকে এগোতে লাগল। করিডোরের এক কোণে একটা পুরনো দরজা। দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।

ভেতরে ঢুকতেই রুদ্র দেখতে পেল, দেয়ালে একটা বড় ছবি ঝুলছে। ছবিটা ছিল এক কিশোর ছেলের, চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় যেন সে কিছু বলতে চাইছে।

ঠিক তখনই দরজা বন্ধ হয়ে গেল!

রুদ্র দৌড়ে দরজার কাছে গেল, কিন্তু দরজা খুলল না। ঘরের বাতাস ঠান্ডা হতে লাগল, একটা অস্পষ্ট ছায়া রুদ্রের সামনে আবির্ভূত হলো।

— "তুমি কে?" রুদ্র জিজ্ঞাসা করল।

ছায়াটা ফিসফিস করে বলল,
— "আমি এই বাড়ির অভিশপ্ত আত্মা। আমাকে মুক্ত করতে এসেছ?"

রুদ্র ভয় পেয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিল।

— "কিন্তু আমি কীভাবে তোমাকে মুক্ত করব?"

— "আমার বাবার কাছে আমার মৃত্যু রহস্য লুকানো ছিল। আমার কবর খুঁজে বের করো, তাহলেই আমি মুক্তি পাব।"

পঞ্চম অধ্যায়: অভিশাপের সমাপ্তি

পরদিন সকালে রুদ্র বাড়ির পুরনো নথিপত্র খুঁজতে শুরু করল। একপর্যায়ে সে জমিদার রাজীব নারায়ণের ডায়েরি পেল। ডায়েরির একটি পাতায় লেখা ছিল,

"আমি নিজেই আমার ছেলেকে হত্যা করেছি। সে আমাকে ঘৃণা করত, তাই এক রাতে আমি ওকে পেছন থেকে ছুরি মেরে হত্যা করি। আমি তার লাশ আমাদের বাগানের পুরনো আমগাছের নিচে পুঁতে রেখেছি।"

রুদ্র দ্রুত বাগানের দিকে গেল। সেখানে গাছের নিচে খনন শুরু করতেই এক অস্থির কঙ্কাল বেরিয়ে এলো। ঠিক তখনই আকাশ কালো হয়ে গেল, বাতাস জোরে বইতে লাগল, আর সেই ছায়াটি আবার আবির্ভূত হলো।

— "আমার কঙ্কাল মুক্ত হলো, এখন আমার আত্মা শান্তি পাবে। তোমাকে ধন্যবাদ, রুদ্র। তুমি না এলে আমি চিরকাল এই অভিশপ্ত বাড়িতে বন্দি থাকতাম।"

রুদ্র দেখল, ছায়াটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে বাড়ির চারপাশের পরিবেশও বদলে গেল। অনেক দিনের পুরনো ধুলো, জঞ্জাল, সব যেন মুছে গিয়ে নতুন একটা আলো এসে পড়ল বাড়ির ওপর।

বৃদ্ধ লোকটি এসে বললেন,

— "আপনি পেরেছেন, রুদ্র বাবু। এই বাড়ি এখন অভিশাপমুক্ত।"

রুদ্র তাকিয়ে দেখল, জমিদার বাড়িটি আর আগের মতো ভয়ঙ্কর লাগছে না। সত্যিই, অনেক বছরের পুরনো এক রহস্যের সমাপ্তি ঘটল আজ।

শেষ কথা

সেদিন বিকেলে রুদ্র শংকরপুর জমিদার বাড়ি ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তার মনে হালকা এক প্রশান্তি কাজ করছিল।

কিন্তু যাওয়ার সময়, বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আয়নাটার দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল।

আয়নার ভেতর স্পষ্ট দেখতে পেল— সেই ছেলেটির প্রতিচ্ছবি হাসছে।

হয়তো সে মুক্তি পেয়েছে... অথবা হয়তো রুদ্রের জন্য অন্য কোনো রহস্য রেখে গেছে!

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Ranu Akter 9 months ago

    গল্পটি অনেক ভালো হয়েছে