Posts

প্রবন্ধ

ক্রিকেট ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ

March 7, 2025

এম আর লিটন

37
View

ক্রিকেট বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু এর জনপ্রিয়তার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার ক্রিকেটকে রাজনৈতিক হাতিয়ার, কূটনৈতিক মাধ্যম ও সামাজিক বিভ্রান্তির সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে সমালোচকরা দাবি করেন। এই লেখার লক্ষ্য হলো—কীভাবে ক্রিকেটের মাধ্যমে পতিত সরকার জনগণের দৃষ্টি অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে সরিয়ে রাখছে। তা তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা। লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে সরকারি নথি, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন, স্থানীয় উদাহরণ ও দার্শনিক মতবাদ। 

ক্রীড়া, ক্ষমতা ও সমাজ 

ইতালীয় মার্কসবাদী দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসির মতে, শাসক শ্রেণি শিক্ষা, শিল্প ও ক্রীড়ার মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। তিনি এটিকে ‘হেজিমনি’ বা ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ বলেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্রিকেট এই হেজিমনি বজায় রাখার একটি হাতিয়ার।  মার্কিন ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কি এবং এডওয়ার্ড এস. হারম্যান যুক্তি দেন, গণমাধ্যম ও জনপ্রিয় সংস্কৃতি জনগণের সম্মতি ‘নির্মাণ’ করে। ক্রিকেটের মতো দীর্ঘমেয়াদি খেলা মানুষের মনোযোগ বাস্তব সমস্যা থেকে সরিয়ে দেয়। 

ক্রিকেটের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা 

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ক্রিকেটকে ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সরাসরি সরকারি তত্ত্বাবধানে আসে। ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ক্রিকেট অবকাঠামোতে বিনিয়োগ ৪২০শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যেখানে একই সময়ে কারিগরি শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ মাত্র ১৮শতাংশ বাড়ে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৩)। 

২০২৪ সালের জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সরকার একাধিক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সিরিজ আয়োজন করে। সমাজবিজ্ঞানী ড. তানভীর হায়দারের মতে, ‘আন্দোলন দমনে ক্রিকেটকে সাময়িক বেদনানাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে’ (দ্য ডেইলি স্টার, ২৫ আগস্ট ২০২৪)। 

১. যুবসমাজের মনোযোগ বিভ্রান্তি 

২০২১ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৩১ দশমিক ৬ শতংশ যুবক বেকার। অথচ বিসিবির তথ্য মতে, ২০২৩ সালে মাত্র শন্য দশমিক ৪ শতাংশ যুবক পেশাদার ক্রিকেটে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদের মন্তব্য, ‘ক্রিকেটের স্বপ্ন দেখিয়ে যুবকদের মূল সমস্যা থেকে দূরে রাখা হচ্ছে’ (প্রথম আলো, ২০২২)। 

২. ক্রিকেটারদের রাজনৈতিক মঞ্চে ব্যবহার 

দেশের শীর্ষ ক্রিকেটারদের রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত করার উদাহরণ, ২০১৮ সালে মাশরাফি বিন মর্তুজা আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২৩ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান রাজনীতিতে নাম লেখালেন। মাগুরা-১ আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হন। ক্রীড়া সমালোচক ড. মাহফুজুর রহমানের মতে, ‘খেলোয়াড়দের জনপ্রিয়তা রাজনৈতিক দলের ব্র্যান্ডিং কৌশলের অংশ’।

অবকাঠামো বনাম জনস্বাস্থ্য  

২০২২ সালে মিরপুর স্টেডিয়ামের আধুনিকীকরণে ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। একই বছর ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটে ১২৩ জন রোগীর মৃত্যু হয় (স্বাস্থ্য খাতের প্রতিবেদন, ২০২২)। এই বৈষম্য সমাজে বিতর্ক তৈরি করে। 

ক্রিকেটের অর্থনৈতিক মিথ 

বিসিবি দাবি করে, ক্রিকেট ইন্ডাস্ট্রি বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আয় করে। কিন্তু বাংলাদেশের মোট জিডিপির মাত্র শন্য দশমিক ২ শতাংশ এই খাত থেকে আসে (বিবিএস, ২০২৩)। অর্থনীতিবিদ ড. ডেবপ্রিয়ো ভট্টাচার্য বলেন, ‘ক্রিকেটের অর্থনৈতিক অবদান একটি মিথ। যেটা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে’ (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২০২৩)। 

◾ সফট পাওয়ার ও ভুয়া ইমেজ 

বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচকে ‘সফট পাওয়ার’ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। যেমন, ২০২৩ সালে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনার সময় বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ক্রিকেট সিরিজ আয়োজনের মাধ্যমে বৈশ্বিক মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করা হয় (দ্য গার্ডিয়ান, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। হার্ভার্ডের অধ্যাপক জোসেফ নাইয়ের মতে, ‘ক্রিকেট কূটনীতি একটি দেশের ভঙ্গুর ইমেজ মেরামতের হাতিয়ার।’

◾ ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা 

ভারতে ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয় ও পাকিস্তানে ১৯৯২ বিশ্বকাপ বিজয় জাতীয়তাবাদী প্রচারণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে বাংলাদেশে এর ব্যবহার আরও সুপরিকল্পিত। ২০২১ সালে বাংলাদেশের টি-২০ বিশ্বকাপ জয়কে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্য’ হিসেবে প্রচার করা হয় (বিডিনিউজ, ১৫ নভেম্বর ২০২১)। 

◾ রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার চ্যানেল 

বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ক্রিকেট ম্যাচের সময় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ও ‘ভিশন ২০৪১’ বিষয়ক বিজ্ঞাপন প্রচার করে। ২০২৩ সালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালে প্রতি ওভারে তিনটি করে সরকারি প্রকল্পের বিজ্ঞাপন দেখানো হয় (চ্যানেল আই, ২০ মার্চ ২০২৩)। মিডিয়া গবেষক ড. ফারাহ দীবার মতে, ‘ক্রিকেটের ফ্রেমে রাজনৈতিক বার্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়’ (মিডিয়া স্টাডিজ জার্নাল, ২০২৩)। 

◾ সমালোচনা ও পাল্টা যুক্তি 

কেউ কেউ যুক্তি দেন, ক্রিকেট বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের অংশ। লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার ‘নিষিদ্ধ লোবান’ বইতে উল্লেখ করেন, ‘খেলা মানুষের অবচেতনাকে জাগ্রত করে’। ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপ জয় জাতীয় গর্ব তৈরি করেছে। 

◾ বাস্তবতা নাকি মিথ? 

বিসিবি দাবি করে, ক্রিকেট সরাসরি ৬৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। কিন্তু অধিকাংশ চাকরি অস্থায়ী ও কম বেতনের (বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তর, ২০২৩)। ব্র্যান্ডিং বিশেষজ্ঞ ড. আলমগীর মহিউদ্দিন স্বীকার করেন, ‘ক্রিকেটের অর্থনৈতিক সুবিধা সীমিত। কিন্তু এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিশাল’ (ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ, ২০২২)। 

◾ খেলোয়াড়দের স্বাধীনতা হরণ 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) নিয়ম অনুযায়ী, ক্রীড়াকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে ক্রিকেটারদের রাজনৈতিক সমাবেশে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। ২০২২ সালে বিসিবি একটি নির্দেশিকা জারি করে, ‘জাতীয় দলের সদস্যদের সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক’ (দ্য ডেইলি স্টার, ১৪ এপ্রিল ২০২২)। 

ক্রিকেট বাংলাদেশের গৌরব। কিন্তু এর রাজনৈতিক অপব্যবহার জনগণের মূল সমস্যাগুলোকে আড়াল করছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। ক্রীড়ার মাধ্যমে একটি ‘কল্পিত জাতীয়তাবাদ’ তৈরি করা হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন— 

১. ক্রিকেট প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীন কমিশন গঠন। 

২. যুব নীতিতে ক্রিকেটের পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে বিনিয়োগ। 

৩. মিডিয়ায় ভারসাম্যপূর্ণ সাংবাদিকতা নিশ্চিত করে ক্রিকেটের রাজনৈতিক ব্যবহারের সমালোচনা। 

জার্মান দার্শনিক হান্না আরেন্টের ভাষায়, ‘প্রোপাগান্ডা সত্যকে ধ্বংস করে না, বরং মানুষের সত্যকে দেখার ক্ষমতাকে নষ্ট করে’ (দ্য অরিজিনস অব টোটালিটারিয়ানিজম, ১৯৫১)। বাংলাদেশের জনগণকে ক্রিকেটের মোহ ও রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার ঊর্ধ্বে উঠে বাস্তব সমস্যা মোকাবিলায় সচেতন হতে হবে। 

তথ্যসূত্র— 

১. অ্যান্টোনিও গ্রামসি, সিলেকশন্স ফ্রম দ্যা প্রিজন নোট বুকস (১৯৭১)

২. নোয়াম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস. হারম্যান, ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট (১৯৮৮)

৩. ড. তানভীর হায়দার, ‘ক্রিকেট অ্যাজ আ পলিটিক্যাল টুল’, দ্য ডেইলি স্টার (২০২৪)

৪. বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস, লেবার ফোর্স সার্ভে ২০২৩

৫. ড. দেবপ্রিয়া ভট্টাচার্য, ‘দ্য মিথ অব ক্রিকেট ইকোনমি’, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (২০২৩)

৬. জোসেফ নাই, সফট পাওয়ার: দ্য মিন্স টু সাকসেস ইন ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স (২০০৪)

৭. ড. ফারাহ দীবা, মিডিয়া এন্ড প্রোপাগান্ডা ইন সাউথ এশিয়া (২০২৩)

৮.  ড. আলমগীর মোহিউদ্দীন, ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ থ্রু ক্রিকেট (২০২২)

৯. সৈয়দ শামসুল হক, নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১)

১০. হান্না আরেন্ডট, দ্য অরিজিনস অব টোটালিটারিয়ানিজম (১৯৫১)

ক্রিকেটকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে দেখানো হয়েছে। ছবিতে একটি উজ্জ্বল আলোকিত ক্রিকেট স্টেডিয়াম দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পিছনে এক ছায়াময় শক্তি খেলোয়াড়দের নিয়ন্ত্রণ করছে। দর্শকদের মধ্যে কেউ ক্রিকেট উপভোগ করছে, আবার কেউ বাস্তব সামাজিক সংকটের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। ছবি : সংগৃহীত

Comments

    Please login to post comment. Login