Posts

প্রবন্ধ

আছিয়ার কান্না: রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ!

March 8, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

105
View

আমরা ইতিহাস থেকে মাৎসন্যায়ের পাঠ নিয়েছি। তদ্রূপ এখন এই বাংলা পরগণায় কি ধর্ষণ্যায়ের যুগ চলছে? আমরা আর কত আছিয়ার হৃদয় ভাঙা বেদনা সইব? কত মায়ের অঝোর ধারায় কান্না দেখব?

মাৎসন্যায় হলো এমন এক সামাজিক ও রাজনৈতিক অরাজকতা, যেখানে রাষ্ট্রশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে সমাজে শক্তিশালীরা দুর্বলের ওপর শোষণ ও নির্যাতন চালায়, ঠিক যেমন বড় মাছ ছোট মাছকে গ্রাস করে। মধ্যযুগে, বিশেষ করে সেন ও পাল রাজবংশের পতনের পর এবং মুসলিম শাসনের গোড়ার দিকে বাংলায় একধরনের মাৎসন্যায় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এই সময়ে কেন্দ্রীয় শাসনের অভাবে বিভিন্ন সামন্তপ্রভু, জমিদার ও যুদ্ধবাজ শক্তিগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করত, ফলে সাধারণ মানুষের দুর্দশা চরমে পৌঁছায়।

গেল ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে জাতীয় শহীদ সেনা দিবসের অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, 'একীভূত না থেকে আমরা ব্যক্তিগত হানাহানি ও একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যস্ত রয়েছি বলে অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে। আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতিতে অবস্থান করছি। এমন সময় অপরাধ করলেও এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে -এমনটাই অপরাধীদের ভাবনা।'

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে হেন অপরাধ নাই যা সংঘটিত হচ্ছে না। এরমধ্যে খুন জখম চুরি ডাকাতি তো হরহামেশাই হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে নারী নিপীড়ন, সহিংসতা, নির্যাতন ও ধর্ষণ।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গেল বছর মোট ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জনকে, এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০২৪ সালে দেশের সংবাদপত্রে নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ২,৫২৫টি খবর প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে ৫১৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৬৭ জন শিশু এবং ১৪৯ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ২০২৫ সালের প্রথম তিনমাসেই গেল বছরের ১২ মাস কভার করে ফেলেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার কী করছে? ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের কেবিনেট সদস্য কিংবা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃবৃন্দকে দৃশ্যমান কোনো কার্যবিধি বা কার্যকরী কোনো বক্তব্য দিতে দেখিনি। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সরকার‌ প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, 'নারীবিরোধী যে শক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে, তাকে আমরা দেশের সকল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্যই মোকাবিলা করব।' এই প্রেক্ষিতে আমরা বলব অনেকটাই দেরি হয়ে গেল স্যার। অবুঝ শিশুরা যখন পাষণ্ড কাপুরুষের যন্ত্রণা নিয়ে আইসিইউতে কাতরাচ্ছে তখন কবে আর কার মোকাবেলা করবেন?

বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। কোথাও কারো যেন বিকার নাই। শিশুকন্যা থেকে শুরু করে বৃদ্ধা—কেউই এই পাশবিকতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সম্প্রতি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার আট বছরের শিশু আছিয়ার ঘটনা আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। ওই কন্যাটিতো আমারও। পিতা হিসেবে দায় অনুভব করছি। রীতিমতো কাঁদছি। জঘন্য দুর্বৃত্তের ভয়াল যন্ত্রণা সইবার মতো শক্তি ওর আছে? হে রাষ্ট্র নিয়ন্তা আমরা যে মর্মে মরে যাচ্ছি তোমরা এটা আর কবে বুঝবে?

ঈদের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে আপন বোনের শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় ছোট্ট শিশুটি। তার বড় বোনের ভাষ্য অনুযায়ী, শুধু শ্বশুর নয়, তার স্বামীও এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। নির্দয়ভাবে নিপীড়নের শিকার হয়ে শিশু আছিয়া এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা কী ভয়ংকর এক সমাজে বাস করছি, যেখানে নিজের ঘরও শিশুদের জন্য নিরাপদ নয়!

মানুষ কেন ধর্ষণ করে? মনোবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ কী?
ধর্ষণ কেবল শারীরিক লালসার ফল নয়, বরং এটি একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক সমস্যা। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধর্ষণের পেছনে মূলত ক্ষমতা প্রদর্শন, বিকৃত মানসিকতা, সামাজিক শৃঙ্খলার অভাব ও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারা কাজ করে।

১. ক্ষমতার অপব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা:
আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড ডাটন ও নিকোলাস গ্রিফিন বলেছেন, ধর্ষণ মূলত ভুক্তভোগীর ওপর ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি পদ্ধতি। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকের উদ্দেশ্য যৌনসুখ নয়, বরং ভুক্তভোগীকে অপমানিত করা ও নিজের প্রভাব খাটানো।

২. পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও নারীবিদ্বেষী মানসিকতা:
মনোবিজ্ঞানী ডেভিড লিসাকের গবেষণা (২০০২) দেখিয়েছে, অনেক পুরুষ মনে করে, নারীরা দুর্বল এবং তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করা পুরুষত্বের পরিচায়ক। এই মানসিকতা সমাজ থেকে আসা এক ধরনের বিষাক্ত পুরুষত্ববোধ (toxic masculinity), যা ধর্ষণের পেছনে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৩. শৈশবের ট্রমা ও মানসিক বিকৃতি:
ড. রিচার্ড ট্রেম্বলের গবেষণা (২০১৫) অনুযায়ী, অনেক ধর্ষক নিজের শৈশবে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকতে পারেন। ফলে তারা ভবিষ্যতে সেই ক্ষত সারানোর জন্য অন্যকে নির্যাতন করে বিকৃত আনন্দ পেতে চায়।

৪. সমাজে যৌন শিক্ষার অভাব:
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাংলাদেশসহ অনেক দেশে যৌনশিক্ষার অভাবের কারণে তরুণরা যৌন সম্পর্ক, সম্মতি (consent) ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়। ফলে অনেকেই নারীর স্বাধীন মতামতকে গুরুত্ব দিতে শেখে না এবং জোরপূর্বক সম্পর্ককে "স্বাভাবিক" মনে করে।

৫. পর্নোগ্রাফির অপব্যবহার ও যৌন ফ্যান্টাসি:
বিভিন্ন গবেষণা দেখিয়েছে, সহিংস ও ধর্ষণমূলক পর্নোগ্রাফি দীর্ঘদিন দেখলে মানুষের মধ্যে যৌন আক্রমণাত্মক আচরণ জন্ম নিতে পারে। ড. নিল মালামুথের গবেষণা (২০১৮) বলছে, যেসব পুরুষ নিয়মিত সহিংস পর্নোগ্রাফি দেখে, তাদের মধ্যে ধর্ষণের প্রবণতা সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি। কে না জানে বাংলাদেশের স্মার্টফোন, ইউটিউব, ফেসবুক ও টিকটক এখন পুরোদস্তুর অমানুষদের দখলে। মানুষ বুঁদ হয়ে যা দেখছে, তাই করবার প্রয়াস পাচ্ছে।

৬. আইনের দুর্বলতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি:
কানাডার মনোবিজ্ঞানী ড. ক্রেইগ হোয়াইট বলেন, যখন ধর্ষণের বিচার হয় না, তখন অপরাধীরা সাহস পায় এবং নতুন অপরাধ সংঘটিত হয়। অর্থাৎ বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্ষণের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে।

এই পরিস্থিতি থেকে সমাধানের পথ কী?
ক. সঠিক যৌন শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: সম্মতি (consent), সম্পর্ক ও পারস্পরিক সম্মান নিয়ে শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
খ. আইনের কঠোর প্রয়োগ: ধর্ষকদের দ্রুত ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
গ. পরিবারের ভূমিকা: শিশুদের ছোটবেলা থেকেই লিঙ্গসমতা ও নারীর প্রতি সম্মানের শিক্ষা দেওয়া।
ঘ. মানসিক স্বাস্থ্যসেবা: যারা বিকৃত যৌনচিন্তায় আক্রান্ত, তাদের জন্য মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

মনোবিজ্ঞানীরা একমত যে, ধর্ষণ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত লালসার বিষয় নয়, বরং এটি ক্ষমতা, বিকৃত মনস্তত্ত্ব ও সমাজের কাঠামোগত সমস্যার প্রতিফলন। তাই একে প্রতিরোধ করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা ও মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। আমরা আর কাউকে কাঁদতে দেখতে চাই না।

রেফারেন্সসমূহ:
• ডোনাল্ড ডাটন ও নিকোলাস গ্রিফিন - The Psychology of Power and Control (2002)
• ডেভিড লিসাক - Predatory Nature of Serial Rapists (2002)
• রিচার্ড ট্রেম্বলে - Childhood Trauma and Criminal Behavior (2015
• ড. নিল মালামুথ - Pornography and Aggressive Sexual Behavior (2018)
• ক্রেইগ হোয়াইট - Legal Impunity and Sexual Violence (2020)
• Amnesty International Report on Sexual Violence in South Asia (2021)
• United Nations Report on Gender-Based Violence (2022)
• আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন

লেখক: সাংবাদিক 
৮ মার্চ ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login