Posts

চিন্তা

অবিশ্বাস নিরাপত্তার কার্যকর হাতিয়ার!

March 9, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

127
View

শিশুর প্রতি সমাজের নিষ্ঠুরতা এবং মানুষের প্রতি অবিশ্বাস জারি রাখবার বাস্তবতায় কবি জীবনানন্দ দাশের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতার একটি লাইন খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়—
"কিন্তু শিশুরা তো সব দেখে,
তবু তারা চুপ করে থাকে!"

এই লাইনটি সমাজের ভয়াবহ বাস্তবতাকে তুলে ধরে। শিশুরা যে নির্যাতন, অন্যায় ও অবিচারের শিকার হয়, তারা অনেক কিছু দেখে, বোঝে, অনুভব করে—কিন্তু ভয়, লজ্জা ও অসহায়ত্বের কারণে তারা চুপ থাকে। আমাদের দায়িত্ব হলো তাদের কণ্ঠ হয়ে কথা বলা, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

শিশুর প্রতি নিপীড়ন, যৌন সহিংসতা, পারিবারিক শোষণ ও অবহেলার যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাতে সন্দেহ নেই যে শিশুদের নিরাপত্তা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিশু নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা আগেও ছিল, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের বিস্তারের ফলে এসব এখন অনেক বেশি প্রকাশ্যে আসছে। সম্প্রতি নানা প্রতিবেদন বলছে, পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের হাতেই বেশির ভাগ শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাবা-মায়ের বিশ্বাস যাঁদের ওপর সবচেয়ে বেশি, অনেক সময় তাঁরাই শিশুর জন্য সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ান। দাদা-নানা, চাচা-মামা, কাজিন, এমনকি গৃহশিক্ষক বা পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু—সবাই এই অন্ধকার চক্রের অংশ হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ সালেই শত শত শিশু ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ও হত্যা সংক্রান্ত অপরাধের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটেছে পরিচিতজনের মাধ্যমে। যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুদের ৮০ শতাংশই চেনাজানা কারও দ্বারা আক্রান্ত হয়।

অন্যদিকে, গৃহকর্মী শিশুদের ওপরও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ভয়াবহ রকম বেড়েছে। আমরা প্রায়ই শুনি ধনী পরিবারের কাজের মেয়ে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়ে) দুঃসহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আদালতের রায়েও এসেছে যে, যেসব শিশু এতিমখানায় বা দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে থাকে, তারা সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার হয়।

সমাজ ও সংস্কৃতির এতটা অধঃপতন কীভাবে হলো? বাঙালি সংস্কৃতিতে একসময় "মায়া-মমতা" ও "আত্মীয়তার বন্ধন" গর্বের বিষয় ছিল। কিন্তু এখন আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও শোষণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। পশ্চিমা দার্শনিক জাঁ-জ্যাক রুশো বলেছিলেন, "মানুষ জন্মগতভাবে নিষ্পাপ, কিন্তু সমাজ তাকে কলুষিত করে তোলে।" আমাদের সমাজও এখন এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে অবিশ্বাস, স্বার্থপরতা ও সহিংসতাই প্রধান হয়ে উঠেছে।

জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নীৎশে বলেছিলেন, "Mistrust is the mother of safety." অর্থাৎ, নিরাপত্তার জন্য অবিশ্বাস সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাবা-মাকে এই অবিশ্বাসের মনোভাব নিয়েই শিশুদের রক্ষা করতে হবে।

একইভাবে ইংরেজ দার্শনিক থমাস হবস তাঁর "Leviathan" গ্রন্থে সমাজের প্রকৃত চিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, "Man is a wolf to man." অর্থাৎ, মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমাদের সমাজ এখন এমন এক জায়গায় এসেছে, যেখানে নিজের আত্মীয়স্বজনই শিশুর শত্রু হয়ে দাঁড়াতে পারে।

কী করণীয়?
১. শিশুকে কারো বাড়িতে একা রাখা যাবে না। বিশেষ করে আত্মীয়স্বজনদের সাথেও রাতে থাকার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।

২. শিশুর আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন দেখলে গুরুত্ব দিতে হবে। শিশু যদি হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে যায়, কাউকে এড়িয়ে চলে বা রাতে ভয় পায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হতে হবে।

৩. বাবা-মাকেও সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যাবে না। বহু ঘটনায় দেখা গেছে, শিশুর নিজের বাবা বা সৎবাবাই ভয়াবহ নিপীড়ন চালিয়েছে।

৪. মেয়েশিশুদের প্রতি নজরদারি দ্বিগুণ জরুরি। দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় কন্যাশিশুরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়।

৫. স্কুল বা কোচিংয়ের শিক্ষকদের প্রতিও অন্ধবিশ্বাস করা যাবে না। সম্প্রতি বহু ঘটনায় দেখা গেছে, স্কুল বা কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা শিশুর সঙ্গে ভয়াবহ অপরাধ করছে।

বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির বর্তমান অবস্থা সত্যিই ভয়ংকর। আত্মীয়স্বজনের প্রতি অন্ধবিশ্বাস বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। অভিভাবকদের মনে রাখা দরকার, "বিশ্বাস করুন, তবে যাচাইও করুন।" আর এক মুহূর্তের অবহেলাই সন্তানের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

তথ্যসূত্র: 
• Bangladesh Child Rights Forum (BSAF), "Annual Report on Child Abuse in Bangladesh, 2023-24"
• বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, "শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের প্রতিবেদন, ২০২৩-২৪"
• ব্র্যাক, "শিশু নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার সামাজিক বিশ্লেষণ, ২০২৩"
• Jean-Jacques Rousseau, The Social Contract (1762)
• Friedrich Nietzsche, Beyond Good and Evil (1886)
• Thomas Hobbes, Leviathan (1651)

লেখক: সাংবাদিক 
৯ মার্চ ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login