ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। চারপাশ কেমন ধোঁয়াটে লাগছিল, আকাশটা ঘন মেঘে ছেয়ে ছিল। আট বছরের তৃষ্ণা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, বৃষ্টি তার ছোট ছোট হাতের ওপর পড়ছিল, ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় সে চোখ বন্ধ করল।
"তুমি বৃষ্টিতে এত দাঁড়িয়ে আছো কেন?"
তৃষ্ণা চমকে পেছন ফিরে তাকাল। একটা ছেলে, বয়স হয়তো তার সমানই, ভেজা চুল এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর নেমে এসেছে। চোখদুটো অসম্ভব কৌতূহলী, গায়ের রং মসৃণ গোধূলির মতো, আর ঠোঁটে হাসি লেগে আছে।
"তোমার কী?" তৃষ্ণা ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
ছেলেটা আরও একটু কাছে এল, "আমি আরিয়ান। তুমি কে?"
তৃষ্ণা মুখ ঘুরিয়ে আবার বৃষ্টির দিকে তাকাল। "তোমার নাম বললে কি বৃষ্টি থেমে যাবে?"
আরিয়ান হেসে ফেলল, "না, কিন্তু তবুও শুনতে চাই।"
তৃষ্ণা এবার তাকাল। "আমি তৃষ্ণা।"
"তৃষ্ণা?" আরিয়ান মাথা কাত করল, "তাহলে কি তোমার সবসময় পানি খেতে ইচ্ছা করে?"
তৃষ্ণা বিরক্ত হয়ে বলল, "তুমি খুব বোকা, বুঝলে?"
"তাই নাকি?"
আরিয়ান এবার পকেট থেকে একটা চকোলেট বের করল। "তাহলে এটা খাবে?"
তৃষ্ণা চকোলেটের দিকে তাকিয়ে হাসল। সে তখনও জানত না, এই ছোট্ট মুহূর্তটাই একদিন তার জীবনে সবচেয়ে গভীর সম্পর্কের শুরু হবে।
আরিয়ান আর তৃষ্ণার বন্ধুত্ব কেমন করে গড়ে উঠেছিল, সেটা বোঝার জন্য সময়ের দরকার হয়নি।
তৃষ্ণা ছিল শান্ত, গম্ভীর। বই পড়তে ভালোবাসত, বৃষ্টির জল ছুঁয়ে থাকতে ভালোবাসত, কখনো কখনো একা একা বসে থাকত। আরিয়ান ছিল পুরো উল্টো—চঞ্চল, হাসিখুশি, দুষ্টুমি ছাড়া যার এক মুহূর্তও চলে না।
তাদের বাড়ি পাশাপাশি ছিল। একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া, একসঙ্গে ফিরে আসা, খেলতে যাওয়া—সবকিছুতেই তারা একসঙ্গে থাকত।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ আরিয়ান বলল, "তোমাকে একদিন হারিয়ে ফেললে আমি কী করব?"
তৃষ্ণা অবাক হয়ে তাকাল, "আমাকে হারিয়ে ফেলবে কেন?"
আরিয়ান মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে বলল, "জানি না… কিন্তু মনে হয়, কোনো একদিন আমাদের জীবন বদলে যাবে। আমরা হয়তো একসঙ্গে থাকব না।"
তৃষ্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর মাথা নাড়ল, "এমন হলে খুব খারাপ লাগবে, তাই না?"
"হ্যাঁ," আরিয়ান ফিসফিস করে বলল, "খুব খারাপ লাগবে।"
সেদিন তারা জানত না, ভবিষ্যতে সত্যিই এমন কিছু ঘটবে যা তাদের জীবন চিরতরে বদলে দেবে। কিন্তু সেই মুহূর্তে তারা ছিল নিঃশঙ্ক, একে অপরের পাশে, একে অপরের জন্য।