রহিমের ঘরটা বলতে গেলে একটা ছনের চাল আর বাঁশের বেড়া। এক কোণে মাটির চুলো, যেখানে তার স্ত্রী মরিয়ম শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে ভাত বসিয়েছে। ধোঁয়ায় চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মুখে কোনো অভিযোগ নেই। পাশে বসে ছোট মেয়ে রুপা, যার পরনে ছেঁড়া ফ্রক, পেটে হাত রেখে কান্না করছে।
"মা, খুব খিদে লেগেছে..."
মরিয়ম অসহায় চোখে তাকাল। হাঁড়িতে শুধু একটু ভাত আর জল। তরকারি নেই।
ঠিক তখনই রহিম ভেতরে ঢুকল, মাথায় মাটির ঘাম, হাতে এক পুটলি চিড়া।
"রুপা, এই নে, খা।"
রুপা ঝটপট বাবার হাত থেকে চিড়া নিয়ে খেতে লাগল। মরিয়ম কিছু বলল না, শুধু রহিমের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রহিম জানে, একদিনে সব কিছু বদলাবে না, কিন্তু সে চেষ্টা করবেই।
সকালে কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে রহিম। হাতে কোনো টাকা নেই, বাড়িতে মেয়েটা না খেয়ে আছে, তবু মুখে হাসি রেখে সে কাজে যেতে চায়।
মজুর রহিমের দিন শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগেই। বস্তির ছোট্ট ঘর থেকে বেরিয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে কাজের সন্ধানে হাঁটতে থাকে সে। কখনো মাঠে মাটি কাটে, কখনো ইটভাটায় ঘাম ঝরায়, কখনো আবার দিনমজুরের কাজ করে দু'মুঠো খাবারের জন্য।
আজও ঠিক তেমনই একদিন। রোদ মাথার ওপরে চড়ে এসেছে, পেটে ভাত নেই, কিন্তু কাজের আশায় সে হাঁটছে। এমন সময় রাস্তার পাশে বিশাল এক কালো গাড়ি উল্টে পড়ে থাকতে দেখে সে। ধোঁয়া বেরোচ্ছে, সামনে একটা গাছ ভেঙে পড়েছে, আর ভেতর থেকে কাতরানোর শব্দ আসছে।
রহিম দৌঁড়ে গেল। ভিতরে আটকে থাকা মানুষটাকে টেনে বের করল—বয়সে মাঝবয়সী, দামি পোশাক পরা এক ধনী ব্যক্তি। তাঁর কপাল ফেটে গেছে, নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন। রহিম কাঁধে তুলে নিলেন তাঁকে, হাসপাতালে নিয়ে গেল।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর রহিম ডাক্তার ডাকতে গেল, কিন্তু ঠিক তখনই কয়েকজন লোক এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল।
“এই গরিবটা এখানে কী করছে?” একজন চিৎকার করল।
“স্যারকে ছুঁলো কীভাবে?” আরেকজন বিরক্ত মুখে রহিমের দিকে তাকাল।
রহিম হতভম্ব। সে তো এই লোকটার জীবন বাঁচাল! কিন্তু তার পরিবর্তে... এই ব্যবহার?
লোকটার আত্মীয়রা ব্যস্ত হয়ে গেল চিকিৎসা নিয়ে, কেউ রহিমের দিকে তাকাল না, ধন্যবাদও দিল না। বরং হাসপাতালের গার্ড এসে বলল,
"তোর কাজ শেষ? যা এখান থেকে, ফালতু ঝামেলা করিস না!"
রহিমের চোখে অন্ধকার নামল। একটা তিক্ত হাসি তার ঠোঁটে ফুটল। গরিব মানুষ কি মানুষের চোখে মানুষই না?
সে ধীরে ধীরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু ভাগ্যের খেলাটা যে এখানেই শেষ নয়, সে কি জানত?
কিন্তু কৃতজ্ঞতা পেল না। বরং ধনী লোকটির আত্মীয়রা এসে রহিমকে দূরে সরিয়ে দিল। কেউ একটা ধন্যবাদও বলল না, উল্টে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল, যেন সে চোর।
রহিম মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল। এমনটাই তো হয় সবসময়—গরিবের কাজ কেউ দেখে না, কেবল অবহেলা জোটে।
কিন্তু কয়েক দিন পরেই সব পাল্টে গেল।
একদিন সকালে রহিম যখন কাজে বেরোচ্ছিল, তখন সেই একই কালো গাড়ি এসে থামল তার সামনে। দরজা খুলে নেমে এলেন সেই ধনী ব্যক্তি।
"তোমার নাম রহিম, তাই না?"
রহিম অবাক হয়ে মাথা নাড়ল।
লোকটি এগিয়ে এসে রহিমের হাত ধরলেন, এবার আর অবহেলা নয়, কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে।
"সেদিন তুমি না থাকলে আমি বাঁচতাম না। আমি তোমার ঋণ শোধ করতে চাই।"
এরপর যা হলো, তা রহিম কল্পনাও করতে পারেনি। লোকটি রহিমকে তাঁর ব্যবসায় চাকরি দিলেন, থাকার জন্য একটা ভালো ঘর দিলেন।
জীবন বদলে গেল রহিমের।
সে বুঝতে পারল, অবহেলার পরেও কখনো কখনো মানুষ সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা দেখাতে জানে। সময় বদলায়, ভাগ্যও বদলায়।
(শেষ)