ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এই নতুন প্রেক্ষাপটে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেবল একজন অর্থনীতিবিদ বা সমাজসেবক নন, বরং কার্যকর রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এ দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা তার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থানকেও স্পষ্ট করে তুলেছে। এতদিন রাজনীতির বাইরে থাকা এই ব্যক্তিত্ব কি এবার স্থায়ী রাজনৈতিক ভূমিকা নিতে চলেছেন? যদি তাই হয়, তবে তার সম্ভাবনা কতটা বাস্তব?
ওই সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ একপ্রকার "বিধ্বস্ত গাজার" মতো পরিণত হয়েছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, স্বৈরাচারী শাসন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংসের অভিযোগ তিনি সরাসরি তুলেছেন।
তাঁর নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গোপন কারাগার বন্ধ, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা এবং মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর দ্রুত নির্বাচনের দাবি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট, এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মতো চ্যালেঞ্জও সামনে এসেছে।
২০২৬ সালের মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ড. ইউনূস। তবে তাঁর নেয়া পদক্ষেপগুলো কি তাঁকে গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে গড়ে তুলছে, নাকি কেবল একটি অন্তর্বর্তী পর্বে তাঁর ভূমিকা সীমাবদ্ধ থাকবে?
ড. ইউনূস কি রাজনীতিতে স্থায়ী হতে পারেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে, তবে কয়েকটি বাস্তব কারণ তার দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক ভূমিকার সম্ভাবনা তৈরি করছে—
১. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সমর্থন
ড. ইউনূসের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাঁর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা। তিনি নোবেল বিজয়ী এবং বিশ্বজুড়ে সম্মানিত একজন অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক উদ্যোক্তা। পশ্চিমা বিশ্ব তাকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে একজন নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে দেখছে। যদি তিনি রাজনীতিতে স্থায়ী হতে চান, তবে এই আন্তর্জাতিক সমর্থন তাকে এগিয়ে রাখবে।
২. রাজনৈতিক বিকল্পের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রধান শক্তি হিসেবে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে তৃতীয় বিকল্পের চাহিদা স্পষ্ট। ড. ইউনূস যদি নতুন রাজনৈতিক শক্তি গঠন করতে পারেন বা একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক জোটের নেতৃত্ব দিতে পারেন, তবে তিনি রাজনীতিতে স্থায়ী হতে পারেন। ইতোমধ্যে তাঁর সমর্থনপুষ্ট হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে দল গঠন করেছে।
৩. সামরিক ও প্রশাসনিক সমর্থন
রাজনীতিতে স্থায়ী হতে হলে শুধু জনগণের সমর্থনই যথেষ্ট নয়, বরং প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর আস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক বিভাজন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যা বোঝায় যে সেনাবাহিনীও স্থিতিশীল নেতৃত্ব চায়। ড. ইউনূস যদি তাদের আস্থাভাজন হতে পারেন, তবে তাঁর রাজনীতিতে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ বাড়বে।
৪. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্ন ও রাজনৈতিক বিরোধিতা
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগের একটি হলো, তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে উদাসীন। তিনি একাধিকবার বলেছেন যে, বাংলাদেশকে "রিসেট" করতে হবে, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আদর্শকে উপেক্ষা করার শামিল বলে মনে করা হয়। তাঁর এই অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির তীব্র বিরোধিতার মুখে ফেলতে পারে। আওয়ামী লীগ বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী শক্তি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে আসছে, ফলে তারা তাকে "অতীতকে মুছে ফেলার" প্রচেষ্টার জন্য অভিযুক্ত করতে পারে।
এছাড়া, বিএনপিও তাকে শেখ হাসিনার শূন্যস্থান পূরণের জন্য একটি "নিরপেক্ষ মুখোশ" বলেও আখ্যায়িত করতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে স্পষ্ট অবস্থান না নিলে তার পক্ষে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক ভিত্তি গড়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ী হওয়া সহজ কাজ নয়। ড. ইউনূসের জন্য কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে—
• আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিরোধ:
দুই প্রধান দলই তাঁকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখবে এবং বাধা দিতে চাইবে। আওয়ামী লীগ তাকে "পশ্চিমা প্রভাবিত" এবং "বাংলাদেশবিরোধী" নেতা হিসেবে প্রচার করতে পারে। বিএনপিও তাকে তাদের জন্য হুমকি মনে করতে পারে।
• গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ:
তাঁর অন্তর্বর্তী সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে কি না, সেটিই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যদি তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করেন এবং তারপর রাজনীতিতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, তবে তাঁকে স্ববিরোধী ভাবা হতে পারে।
• জনসমর্থন টিকিয়ে রাখা:
যদি তার সরকার দ্রুত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণের আস্থা হারানোর সম্ভাবনা থাকবে। তাঁর নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি অভ্যন্তরীণ বিভক্তির শিকার হতে পারে, ফলে নতুন কলহ ও গণ-আন্দোলনের সূত্রপাত হতে পারে।
রাজনীতিতে প্রফেসর ইউনূসের ভবিষ্যৎ কী? তিনি কি বাংলাদেশে স্থায়ী রাজনৈতিক নেতা হতে পারবেন? এটি পুরোপুরি নির্ভর করছে তার পরবর্তী সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক কৌশলের ওপর। যদি তিনি শুধুমাত্র অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার পর সরে যান, তবে তিনি রাজনীতিতে স্থায়ী হবেন না। কিন্তু যদি তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী হন, তবে তার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল।
তাঁর জন্য করণীয় হতে পারে—
✔ একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক জোট গঠন করা।
✔ জনগণের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করা যে তিনি কেবল সাময়িক সমাধান নন, বরং দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের প্রতীক।
✔ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন বজায় রাখা এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
✔ সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
✔ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি সম্মানজনক অবস্থান নেওয়া, যাতে তিনি দেশের প্রধান রাজনৈতিক ধারার বাইরে না চলে যান।
যদি তিনি সফলভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারেন, তবে তিনি কেবল নোবেল বিজয়ী হিসেবেই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির এক স্থায়ী নেতা হিসেবেও ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পারেন। এখন সময়ের অপেক্ষা—তিনি কি কেবল গণতন্ত্রের রক্ষক হয়ে থাকবেন, নাকি নতুন এক রাজনৈতিক যুগের সূচনা করবেন?
লেখক: সাংবাদিক
১১ মার্চ ২০২৫
162
View