পুরুষ হয়ে পুরুষকে চুম্বন করবার ব্যাপারটি গে সংস্কৃতিকে মনে করিয়ে দেয় কী?
এটি নির্ভর করে প্রেক্ষাপট, সংস্কৃতি, ও ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার ওপর। পুরুষ হয়ে পুরুষকে চুম্বন করা সবসময়ই সমকামী (gay) সংস্কৃতির ইঙ্গিত দেয় না, কারণ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটি বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা, রাজনৈতিক সম্পর্ক বা ধর্মীয় অভিবাদনের অংশ হিসেবে গৃহীত। তবে দেশের সমসাময়িক সামাজিক পরিস্থিতি ও গণমাধ্যমের কারণে অনেকেই এটিকে "গে কালচারের" প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতে পারেন। এই ধরনের চুমু সাধারণত রোমান্টিক নয়; বরং এটি বন্ধুত্ব, সম্মান বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
ছেলে হয়ে ছেলেদের চুমু দেওয়া বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ভিন্ন অর্থ বহন করে এবং এটি নির্দিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক বলে গণ্য হয়। কিছু কালচারাল উদাহরণ—
• মধ্যপ্রাচ্য ও আরব সংস্কৃতি: অনেক আরব দেশে পুরুষ বন্ধুরা কপালে, গালে বা নাকে চুমু খেয়ে অভিবাদন জানায়। এটি বিশেষ করে পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রকাশ হিসেবে স্বীকৃত।
• রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ: সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়কালে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে "ব্রাদারলি কিস" বা "কমরেড কিস" খুব পরিচিত ছিল। মুখে বা গালে চুমু দেওয়া রাজনৈতিক বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
• ইতালি, গ্রিস ও স্পেন: দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে পুরুষদের মধ্যে কপালে বা গালে চুমু দেওয়া সাধারণ সামাজিক রীতি, যা বন্ধুত্ব, সম্মান বা স্নেহ প্রকাশের একটি উপায়।
• ফ্রান্স: অনেক ফরাসি পুরুষ গালে চুমু দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়, যা তাদের সামাজিক আচরণের অংশ।
• তুরস্ক, ইরান ও ভারতীয় উপমহাদেশ: বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কপালে চুমু দেওয়ার রীতি প্রচলিত।
বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি চর্চা কাদের মধ্যে দেখা যায়?
বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে চুম্বনের (বিশেষ করে গালে বা কপালে) মাধ্যমে অভিবাদন বা স্নেহ প্রকাশের সংস্কৃতি তেমন প্রচলিত নয়। তবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে কতিপয় ব্যক্তিত্বের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
• বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিক ও পারিবারিকভাবে স্নেহপ্রবণ নেতা হিসেবে দেখা যায়। তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের কপালে চুমু দিয়ে স্নেহ প্রকাশ করতেন, যা অনেক অনুসারীও অনুসরণ করতেন।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ১৯৬৯-৭০ মেয়াদের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে বাংলা ট্রিবিউনকে সাক্ষাৎকার দেন আ স ম রব। সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ও দূরত্বের সূচনাসহ জাতির পিতাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম এই নেতা। তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ত্যাগের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয়। তখন বঙ্গবন্ধু লুঙ্গির ভাঁজ থেকে ১৪ হাজার টাকা বের করে দিয়ে আমার কপালে চুমু খেয়ে আদর করেন।
• সোভিয়েত ধাঁচের "ব্রাদারলি কিস" অনুসরণে কিছু কমিউনিস্ট নেতাও গালে চুমু দিয়ে সহমতের প্রকাশ করতেন।
• নাট্যব্যক্তিত্ব সেলিম আল দীন ও আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো ব্যক্তিরা শিল্পী সমাজে স্নেহপ্রকাশের অংশ হিসেবে এমন শারীরিক অভিব্যক্তি ব্যবহার করতেন।
• রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই সাহিত্যে ও নাটকে চরিত্রগুলোর মধ্যে গালে চুমুর মাধ্যমে স্নেহ প্রদর্শনের কিছু উদাহরণ দেখা যায়। 'ডাকঘর' নাটকে অসুস্থ শিশু অমল যখন জানালার পাশে বসে থাকে, তখন গ্রামের মানুষ তার সঙ্গে গল্প করতে আসে। দইওয়ালা একসময় তার স্নেহ প্রকাশ করতে অমলকে বলে—
"আয়, একটুখানি গালে চুমু খেয়ে যাই।"
এটি গ্রামবাংলার সহজ-সরল স্নেহের প্রকাশ, যেখানে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গালে চুমু দেওয়া স্বাভাবিক।
• বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতে কোচ ও খেলোয়াড়দের মধ্যে গালে চুমু বা আলিঙ্গন করে স্নেহ প্রকাশের কিছু উদাহরণ দেখা যায়, বিশেষত বিদেশি কোচদের মাধ্যমে।
• অভিনয় ও বিনোদন জগতে, বিশেষত আধুনিক সময়ের ফ্যাশন ও মডেলিং সংস্কৃতির মধ্যে এমন শিষ্টাচার কখনো কখনো দেখা যায়।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানকে ইদানিং দেখা যাচ্ছে এই ধরনের চুম্বন চর্চা করতে। বেশ কিছুদিন আগে ইফতার পার্টিতে শিশুদের ঠোঁট ও কপালে চুম্বন করেন তিনি। আজকে দেখা যাচ্ছে ইফতার পার্টিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে চুম্বন করছেন। বিষয়টাকে কীভাবে দেখা যেতে পারে?
হ্যাঁ, সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানকে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে কপালে বা গালে চুমু দিতে দেখা যাচ্ছে। এটি সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে প্রচলিত একটি আচরণ, যা স্নেহ ও সৌহার্দ্যের প্রকাশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ইসলামী দল ও মতাদর্শের সঙ্গে সংযুক্ত। সেখানে নেতা-কর্মীদের মধ্যে কপালে বা গালে চুমু দেওয়া সাধারণ ঘটনা। শফিকুর রহমান হয়তো সেই সংস্কৃতির প্রভাবেই এটি চর্চা করছেন।
নিজের শিশুকে আদর করা স্বাভাবিক, তবে লিপ কিস করা থেকে বিরত থাকাই ভালো, কারণ শিশুটি তা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নাও করতে পারে। আর অন্যের শিশুকে আদর করতে গিয়েও সচেতন থাকা জরুরি—শিশুর ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং স্বাস্থ্য দুটোই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাই কারও শিশুকে আদর করতে চাইলেও আগে ভাবতে হবে, এবং প্রয়োজনে ক্রিমিনোলজির 'চাইল্ড অ্যাবিউজ' অধ্যায়টা একবার পড়ে নিতে হবে। মিস্টার শফিকুর রহমান একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক, সংবেদনশীল মানুষ; নিশ্চয়ই এই বিষয়ে সচেতন আছেন। অতিরিক্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখাই শ্রেয়তর।
ফুটনোটস:
মানুষকে কতকিছু নিয়ে যে স্টাডি করতে হয়?
না জানলে একতরফা সিদ্ধান্তের কোপানলে পড়ে অযথা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
লেখক: সাংবাদিক
১১ মার্চ ২০২৫