পোস্টস

সমালোচনা

গ্রন্থালোচনা: শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান

২০ মে ২০২৪

সানজিদা সিদ্দিকা

মূল লেখক সানজিদা সিদ্দিকা

যখন কোনো বোধ, ধ্যান-ধারণা বা আচার-আচরণ পরিবার,সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বৃহৎ জনগোষ্ঠী বছরের পর বছর ধরে লালন পালন করে আসে অথবা মেনে নেয় কোনো রকম প্রশ্ন বা কৌতূহল ছাড়াই তখন সেই লালিত কিংবা পালিত  আচার আচারণ ও ধ্যান ধারণা নিয়ে সহজভাবে কোনো প্রশ্ন তুললে মানুষের কাছে যতটা গ্রহনযোগ্যতা পায় এর চেয়ে বরং উপহাসের ছলে ওই একই বিষয়ে প্রশ্ন তুললে বা বললে মানুষের মনের ভেতরে ভাবনার বুদবুদ তৈরি হয়। সেই বুদবুদ থেকে জন্ম নেয় জানতে চাওয়ার আকুতি । আর এই আকুতিকে ব্যক্তি যখন প্রশ্ন রূপে আঘাত করে জ্ঞানের দরজায় তখনই সম্ভাবনা থাকে যৌক্তিক জবাব খুঁজে পাওয়ার বা অনুধাবন করার।

জর্জ বার্নার্ড শ'র এমনি এক উপহাসমূলক গল্প " "The adventures of the black girl in her search for God" এই গল্পে তিনি কালো মেয়ের চরিত্রকে  দিয়ে উপহাসধর্মী অনেক প্রশ্ন করিয়েছেন এবং  প্রশ্ন করতে করতে গল্পের শেষে মেয়েটিকে এমন অবস্থানে দাঁড় করান সেই চিত্রও যেন আরেক গভীর পরিহাসের জন্ম দিয়েছে।

চলুন এবার অল্পতে গল্পের কিছু কথা বলা যাক....

আফ্রিকার গভীর অরণ্যে মিশনারী মেমদিদির কাছে কালো মেয়েটি খ্রিস্টীয় ধর্মের দীক্ষাগ্রহণ করে। দীক্ষাগ্রহণের পরপরই মেয়েটি মেমদিদিকে প্রশ্ন করে বসে, 'বলুন, ঈশ্বর কোথায়?' মেমদিদি বললেন এজন্যই তো ঈশ্বর নিজেই বলেছেন তাঁকে খুঁজতে। ওদিকে মনে মনে চটছেন মেয়েটির উপর। খ্রিষ্টান হয়েছে এখন সব কিছু মেনে নিলেই তো হয় তা ধর্ম নিয়ে এসব কূট প্রশ্ন কেনো? কিন্তু চটলে কী হবে প্রশ্নের হাত থেকে তো নিস্তার নেই। অবশেষে নিস্তার পেতে মেয়েটিকে ইংরেজি শেখালেন আর আর একটা ছেঁড়া বাইবেল দিলেন। মেয়েটি এবার হাতে একটা মুগুরের মতো ডাণ্ডা ঘোরাতে ঘোরাতে জঙ্গলে ঢুকল ঈশ্বরকে খুঁজে বের করার জন্য। জঙ্গলে দেখা মেলে বহু ধরণের ঈশ্বরের। এদের মাঝে কেউ  বুড়ো, বদমেজাজি। মেয়েটি মনে করে ঈশ্বর এরকম হতে পারেন না। কাউকেই তার মনে ধরে না। জঙ্গলে ঈশ্বর ছাড়াও দেখা মেলে তরুণ কোহেলেথ এর সাথে। যিনি ধর্মের জ্ঞান বিলান। কিন্তু তিনি নিরাশার সাথে মেয়েটিকে বলেন যে, তিনিও ঈশ্বর পাননি। মেয়েটি যেনো খুঁজে পায় এ প্রার্থনাই করেন। আর উপদেশ স্বরূপ গ্রীক ভাষা রপ্ত করার কথা বলেন। কারণ ওই ভাষায় জ্ঞানের ভাণ্ডার রয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে দেখা হয় বিজ্ঞানী, সৈনিক, ইহুদি, জাদুকর, জেলে, কৌতুহল সংস্থার লোকজন ( কিছু সাদা সাহেব, মেম, ও তাঁদের কৃষাঙ্গ চাকর),  শিল্পী, আরবী, বৃদ্ধ (যিনি নিজ বাগানের পরিচর্যা করেন)  আর সবশেষে একজন আইরিশের সাথে। এদের সাথে দেখা হওয়ার পর মেয়েটি অনেক কিছুই জানতে চেয়েছে প্রশ্নের মাধ্যেমে তেমন কিছু প্রশ্নের মাঝে কয়েকটি উল্লেখ করা হল যেমন জাদুকর যখন বললেন, ঈশ্বরকে বলতে পার তোমার পিতা।
মেয়েটি নারাজ হয়ে চট করে প্রশ্ন করলো, "মাতা নয় কেনো?'

ওদিকে জেলের সাথে সত্যিকারের গীর্জা নিয়ে একদল লোক যখন হট্টগোল মারামারি বাঁধাল তখন ইহুদি আশ্বস্ত করলেন, তিনি (বিশেষ কেউ) আসবেন। তার উপস্থিতি মানুষে মানুষে এ মারামারি  হানাহানি বন্ধ হবে। তখন মেয়েটি জানতে চাইলো, " কেউ এলেই এই মারামারি থেমে যাবে ভাবছেন? সব কিছু ঠিকঠাক হবার জন্য বসে থাকলেই হয়েছে আর কী!  তাহলে চিরকালই বসে থাকুন।"

এরপর শিল্পীকেও প্রশ্ন করল, আচ্ছা ঈশ্বর মানেই পুংলিঙ্গ কেন? জবাবে শিল্পী ব্যস্ত হয়ে কাজ থামিয়ে ভেনাসকে দেখিয়ে বললেন, 'কেন,ইনি তো মহিলা!'
ফের প্রশ্ন, 'তা ওঁর নিচের দিকটা অমন মোটা কাপড়ে ঢাকাঢুকি কেন? এই বাকি অর্ধেক শরীরটুকু নিয়ে ওঁর এত লজ্জা!'

এরপর আরবীর সাথে কথপোকথনের সময় আরবী মেয়েটিকে বললেন, ''শোনো, পুরুষের কথার উপর কথা বলো না। যখন জ্ঞানবিদ্যার কথা হচ্ছে তখন এসব আচরণ কী শোভা পায়?পুরুষ হচ্ছে আল্লার প্রথম সৃষ্টি। মেয়েমানুষ তার পরে।''
মেয়েটি জবাবে ফের বলে, ''মানি, একা পুরুষে সৃষ্টি থাকে অসম্পূর্ণ। ঈশ্বর তাই মহিলা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এক পুরুষের পঞ্চাশটি মেয়েমানুষ দরকার আর পঞ্চাশটি মেয়েমানুষকে খুশি থাকতে হবে একটি পুরুষকে নিয়ে? এ কেমন বিচার গো?''
শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান

বার্নার্ড শ গল্পে অন্যান্য যে চরিত্রগুলো দেখিয়েছেন তাঁরা সকলেই মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে কোনো না কোনো ভাবে জড়িত। এখানে বিজ্ঞানী, জেলে,আরবী,বৃদ্ধ, কৌতুহল সংস্থার লোকজন বলতে কাদের বুঝিয়েছেন তা পাঠক পড়ার সময় নিজেই অনুধাবন করতে পারবেন। বইয়ের আরেকটি চমকপ্রদ দিক হচ্ছে গল্পের ঘটনার সাথে মিল রেখে জন ফারলেই'র করা অনেকগুলো চিত্রণ। যেখানে কালো মেয়েটিকে অনাবৃত দেখানো হয়েছে। যদিও গল্পের কোথাও এ বিষয়ের উল্লেখ নেই যে মেয়টি অনাবৃত। বার্নার্ড শ চেয়েছেন ফারলেই যেন এভাবেই আঁকেন। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয়েছে বার্নার্ড শ হয়তো রূপক ভাবে বিষয়টিকে দেখাতে চেয়েছেন। কারণ অনুসন্ধিৎসু মন নিরাবরণ না হলে, মনের ভেতরে আগে থেকে থাকা কোনো ধারণার আবরণ থাকলে নতুন চিন্তাকে বা ধারণাকে সহজে গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এছাড়া কোনো কিছু খুঁজতে হলে গোড়া থেকে শুরু করতে হয় আর মানব সভ্যতার ইতিহাসের শুরুতে নিজেকে আবৃত করার ধারণা ছিল না। এ দুইটি বিষয় ভেবে হয়তো বার্নার্ড শ মেয়েটিকে নিরাবরণ ভাবে আঁকতে বলেছেন। বইয়ের ভেতর ফারলেই'র সাথে বার্নার্ড শ'র অনেকগুলো চিঠি উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ফারলেইকে মাঝে মাঝে তিনি নিজেই ছবি এঁকে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন। সে সব ছবি দেখে ফারলেই এমন মন্তব্য করেছেন যে, ধীরে ধীরে বার্নার্ড শ' একজন ভালো আঁকিয়ে হয়ে যাচ্ছেন। 

জর্জ বার্নার্ড শ’র "The adventures of the black girl in her search for God " বইটি বাংলায় নামকরণ হয়েছে "শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান" এর অনুবাদ করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। অনুবাদের ভাষা সাবলীল। কালোর বদলে 'শ্যামাঙ্গী' শব্দের ব্যবহার কেন এর ব্যাখ্যা বইয়ের শেষে কাবেরী বসু 'দ্বন্দ্বের নিরসন অথবা সূত্রপাত' এই শিরোনামে তা পরিষ্কার করেছেন। আর বইয়ের ভেতর যে সব চিত্রকথা ও চিঠি আছে সে অংশটুকু  আলোচনা করেছেন সৌম্যেন পাল। সব মিলিয়ে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাঙ্গাত্মকধর্মী বই। যা পাঠকের চিন্তার খোরাক যোগাবে।

বই: শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান
মূল লেখক: জর্জ বার্নার্ড শ
অলংকরণ : জন ফারলেই
অনুবাদ: প্রণব মুখোপাধ্যায়, কথামুখ: কাবেরী বসু, চিত্রকথা: সৌম্যেন পাল।
প্রকাশক: বুক ফার্ম
মুদ্রিত মূল্য : ১৮০ ( ভারতীয় রূপি)