ভূমিকা
অন্যায় যখন শাসনের নিয়ম হয়ে যায়, প্রতিবাদ তখন কর্তব্য। কিন্তু যদি সেই প্রতিবাদ দমন করা হয়? যদি সত্যের কণ্ঠ চিরতরে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়? এই গল্প এক নিষ্প্রভ রাষ্ট্রের, যেখানে ন্যায়বিচার একসময় শুধু গল্পের বইয়ে পাওয়া যেত।
এটি দুই ভিন্ন মানুষের কাহিনি—একজন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও সত্য খোঁজেন, আরেকজন সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েন। তাদের পথ আলাদা, কিন্তু গন্তব্য এক। এই গল্প ন্যায়বিচারের পুনর্জাগরণের।
প্রথম অধ্যায়: ছায়ার অন্তরালে
"শক্তি যার হাতে, ন্যায়বিচার তার ইচ্ছার দাস।"
রাজধানী লুমেনগ্রাদ। শক্তিশালী, কিন্তু ভেতর থেকে পচন ধরা এক রাষ্ট্র। শাসকেরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত, জনগণ দিন দিন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
ওয়াসিম, সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল, শাসকের আনুগত্যে বহু বছর ধরে সেবা করেছেন। কৌশলী, চতুর, এবং নিষ্ঠাবান—এই তিন গুণ তাকে সেনাপ্রধানের পদে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার চূড়ায় উঠে তিনি দেখতে পান এক নির্মম বাস্তবতা।
প্রশাসনের গভীরে অন্যায় বাসা বেঁধেছে। বিচার ব্যবস্থা কেবল ধনীদের জন্য, গরিবের কণ্ঠ চিরতরে রুদ্ধ। দুর্নীতিবাজরা দেশের সম্পদ চুষে নিচ্ছে, আর সাধারণ মানুষের জন্য বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ওয়াসিম সবকিছু দেখেন, কিন্তু চুপ থাকেন—কারণ এটাই ছিল তার শর্ত, তার পদোন্নতির মূল্য। কিন্তু একদিন, এক ঘটনা তার পুরো জীবন বদলে দেয়।
দ্বিতীয় অধ্যায়: বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ
"একজন মানুষের কণ্ঠ কখনোই নিভিয়ে রাখা যায় না, যদি সে সত্য বলে।"
সুয়ান, এক তরুণ সমাজকর্মী। তার কাছে কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে আছে অদ্ভুত এক শক্তি। সে চায় একটি ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্র, যেখানে প্রতিটি নাগরিক সমান অধিকার পায়।
একদিন, সে এক বিশাল সমাবেশে বক্তৃতা দেয়—
"তোমরা যদি আজ চুপ থাকো, তবে তোমাদের সন্তানরা দাস হয়ে জন্ম নেবে!"
তার কণ্ঠস্বর সারা দেশে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার তরুণ তার পাশে দাঁড়ায়, তারা রাস্তায় নামে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে শপথ নেয়।
কিন্তু শাসকরা এই বিপ্লবকে সহ্য করতে পারে না। গভীর রাতে, সুয়ানকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকালে, শহরের কেন্দ্রে তার নিথর দেহ পড়ে থাকে। বুক বিদীর্ণ, হাত বাঁধা। মুখে রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
এক তরুণী তার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
"তারা ভেবেছে, তাকে হত্যা করে ন্যায়কে মুছে দেবে। কিন্তু তারা জানে না, আগুন ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না!"
সারা দেশ যেন বিস্ফোরিত হয়।
তৃতীয় অধ্যায়: নীরবতার অবসান
"সত্যের পাশে দাঁড়ানোই একমাত্র মুক্তি।"
ওয়াসিমের মনে ঝড় ওঠে। সুয়ানের লাশ দেখে তিনি উপলব্ধি করেন—তিনি এতদিন শুধু একজন শাসকের অনুগত সৈনিক ছিলেন, কিন্তু কখনোই একজন মানুষের মতো বাঁচেননি।
তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। তিনি নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, এবং অবশেষে একটি পথ বেছে নেন—শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
গোপনে, তিনি দেশের সৎ ও দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মেজর জেনারেল রহমান, ব্রিগেডিয়ার আনোয়ার, কর্নেল জাফর—তারা সবাই দেশের বর্তমান অবস্থার প্রতি ক্ষুব্ধ।
তারা পরিকল্পনা করেন এক বিদ্রোহ, যা এই নিষ্ঠুর শাসনের অবসান ঘটাবে।
চতুর্থ অধ্যায়: রাতের অভ্যুত্থান
"একটি নতুন সূর্য উঠবে, তবে প্রথমে অন্ধকার কাটাতে হবে।"
এক রাতে, অপারেশন "জাগরণ" শুরু হয়। রাজধানীর সমস্ত সরকারি ভবন সেনাবাহিনী দখল করে নেয়। দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করা হয়।
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম থেকে ঘোষণা আসে—
"অবৈধ শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত। জনগণের মুক্তির পথ উন্মুক্ত।"
শাসক পালানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু বিমানবন্দরে তাকে আটক করা হয়।
পঞ্চম অধ্যায়: ন্যায়ের পুনর্জন্ম
"ন্যায় তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন ক্ষমতা মানুষের সেবায় আসে।"
ওয়াসিম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন—
"আমরা এতদিন অন্যায়ের মধ্যে বসবাস করেছি। কিন্তু আজ থেকে তা বন্ধ। এই দেশ ন্যায়, সততা এবং সুশাসনের পথে এগিয়ে যাবে।"
তিনি সামরিক শাসন জারি করেন, তবে এটি হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা। কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই এই শাসন।
সরকারের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়—
- অর্থ আত্মসাৎকারীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হয়।
- ধর্ষকদের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়।
- শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার শুরু হয়, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সুয়ান অন্যায়ের শিকার না হয়।
চারদিন পর, দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। ওয়াসিম ঘোষণা দেন—
"আমি চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে আসিনি। দুই বছরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই দেশ জনগণের, এবং জনগণের হাতেই থাকবে।"
শেষ অধ্যায়: নতুন ভোর
"শাসনব্যবস্থা বদলানো যায়, কিন্তু সত্য ও ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই চিরন্তন।"
ওয়াসিম তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। দুই বছর পর, একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়।
একদিন, এক তরুণ তার সামনে এসে বলে,
"আপনার নেতৃত্ব আমাদের একটি নতুন দিগন্ত দেখিয়েছে।"
ওয়াসিম মৃদু হেসে বলেন,
"আমি কেবল পথ দেখিয়েছি। এই পথ ধরে তোমাদেরই এগিয়ে যেতে হবে।"
উপসংহার:
একজন মানুষের মৃত্যু একটি বিপ্লবের জন্ম দিতে পারে। সুয়ানের আত্মত্যাগ একদিনও বৃথা যায়নি। অন্যায় পরাজিত হয়েছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু এই গল্প এখানেই শেষ নয়। কারণ ন্যায়বিচার কেবল একদিনের বিজয় নয়, এটি প্রতিদিনের সংগ্রাম।
যেখানে অন্যায়, সেখানে প্রতিরোধ। যেখানে অন্ধকার, সেখানে আলো। এবং যেখানে সত্য, সেখানে বিজয় অবশ্যম্ভাবী।