Posts

চিন্তা

কাফফারা, ক্ষমতার খেলা ও দুধে ধোয়া তুলসী পাতা!

March 14, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

118
View

অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গতকাল তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে "শাহবাগে ফ্যাসিবাদ ও 'শাহবাগী'দের কাফফারা" শিরোনামে লিখেছেন—"জামায়াত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী ছিল। কিন্তু, নাহিদ ইসলাম যেভাবে বলেছেন এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা কাফফারা দিয়েছেন। আমিও বলেছি, জামায়াতের যারা বাংলাদেশপন্থী, তারা এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখেন। জামায়াতের নতুন প্রজন্মের অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে কেউই পাকিস্তানপন্থী নন। ফলে, স্বাধীনতাবিরোধী ট্যাগ দিয়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা যাবেনা। রাজনৈতিক ও আদর্শিক লড়াই করেই তাদের বিরুদ্ধে জিততে হবে। তাদের প্রোপাগান্ডা ওয়ারের জবাব দিতে হবে সত্য দিয়ে।"

মাহফুজ আলমের বক্তব্যের সারমর্ম সহজ— জামায়াত তাদের পাপের কাফফারা দিয়েছে, অতএব তাদের আর স্বাধীনতাবিরোধী বলা যাবে না! কিন্তু বাস্তবতা হলো, জামায়াত শুধু কাফফারা দেয়নি, বরং আওয়ামী লীগের উদরের ভেতর ঢুকে সময়মতো একদম পেট কেটে দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসে এটা তাদের বড় প্রতিশোধ। একাত্তরে হেরে গিয়েছিল, ২০২৪-এ এসে জিতে গেছে।

এদিকে আওয়ামী লীগ পরাজয়ের ব্যর্থতা মানতে পারছে না— এটা তাদের ব্যাপার। একাত্তরে স্বাধীনতার রূপকার শেখ মুজিবের চালের কাছে ভূমিধ্বস ধরাশায়ী হয়েছিল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের নিষ্ঠাবান কোলাবোরেটর জামায়াত। অথচ ২০২৪-এ এসে সেই জামায়াত-শিবির দৃশ্যত শেখ মুজিবের নাম-নিশানা মুছে দিয়েছে।

একটা দল যখন বিরোধী দলে থাকে, তখন তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যতই উচ্চকণ্ঠ হোক না কেন, ক্ষমতার স্বাদ পেলেই সবকিছু বদলে যায়। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন জামায়াতকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। অথচ ২০২৪-এর ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে জামায়াতের বোঝাপড়া হলো এক অভাবনীয় ঘটনা। জামায়াত যেন স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে পুরো রাজনৈতিক মোড়টাই ঘুরিয়ে ফেলেছে।

সেই জামায়াতকে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলেছেন মাহফুজ আলমের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি বলছেন, স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দিয়ে তাদের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা যাবে না! অর্থাৎ, যারা একাত্তরে রাজাকার ছিল, ২০২৪-এর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা পুত পবিত্র হয়ে গেছে!

তবে মজার ব্যাপার হলো, জামায়াত এত বড় প্রশংসাও হজম করতে পারছে না। মাহফুজ আলম যখন বললেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী ছিল, তখনই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবৃতি দিয়ে তার নিন্দা জানালেন।

তিনি বললেন, "আমি তার এ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বক্তব্যে আমরা বিস্মিত। মাহফুজ আলমের স্মরণ রাখা উচিত যে, তিনি একটি অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা। সে কারণে কোনো রাজনৈতিক দলকে টার্গেট করে সমালোচনা ও অসত্য বক্তব্য দেওয়ার কোনো নৈতিক ও বিধিগত অধিকার তিনি রাখেন না।"

এবার লও ঠ্যালা! মনে হচ্ছে খেলা জমে উঠেছে। অথচ বিবেকবানরা জানেন, আসলে এটি ‘সেম সাইড গেম’। জামায়াত মুখে নিন্দা জানালেও মূলত তারা মাহফুজ আলমদের সাথে সমভিব্যাহারে ক্ষমতার জন্য এক পা এগিয়ে আছে।

এতক্ষণ জামায়াতের কথা হলো, এবার প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের কথাও বলা দরকার। মাহফুজ আলম তার বক্তব্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকেও একধরনের লেজিটিমেসি দিয়ে দিলেন। যখন তিনি বলছেন, জামায়াত কাফফারা দিয়েছে, তখন বোঝাই যাচ্ছে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের জন্যও এমন সুযোগ তৈরি হচ্ছে!

একটা রাজনৈতিক দল যদি যথেষ্ট সময় ক্ষমতা থেকে দূরে থাকে, তাহলে তাদেরও হয়তো ভবিষ্যতে "কাফফারা দেওয়া"র সুযোগ আসবে। হয়তো তখন মাহফুজ আলমের উত্তরসূরিরা লিখবে—

"বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শত্রুপক্ষ ভেবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা যাবে না। কারণ, তারা অনেক বড় কাফফারা দিয়েছে। তারা এখন দুধে ধোয়া তুলসী পাতা!"

ক্ষমতার খেলায় কেউ চিরকাল দোষী থাকে না, কেউ চিরকাল নির্দোষও থাকে না। একদিনের রা'জাকার, আরেকদিনের কাফফারা দেওয়া বীর— বাংলাদেশি রাজনীতিতে এটাই তো নিয়ম -তাই না?

লেখক: সাংবাদিক 
১৩ মার্চ ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login