গতকাল আছিয়ার জানাজা নামাজের সময় এখন টিভি সম্প্রচারে থাকা অবস্থায় নিউজরুমে প্রোডাকশনের একজন বলেছিলেন হাসনাত ও সার্জিসরাও গেছে নাকি জানাজায়। ওইসময় ন্যাশনাল ডেস্কের নিউজরুম এডিটর ও প্রেজেন্টার জেনিসিয়া বর্ণা বলে উঠেন, "এই শুয়োরগুলো গেলেই কি না গেলেই কি"!
নিঃসন্দেহে এটি অনভিপ্রেত ঘটনা।
তবে এটাও সত্য তারা পাবলিকলি নিশ্চয়ই অমন ভাষায় কথা বলবেন না। পুরোটাই সিস্টেমেটিক মিসটেক। তারা ভেবেছিলেন তাদের কথাবার্তা বাইরে যাচ্ছে না। আসলে যাওয়ার কথাও না। কারিগরি ত্রুটি না থাকলে স্টুডিও ইনসাইড কনভারসেশন বাইরে আসার কথা না। অফ দ্য রেকর্ড মানুষ কত কথাই না বলে!
মুহুর্তের মধ্যে টিভি ফুটেজটি ভাইরাল হয়ে গেলে এখন টিভির সিইও তুষার আব্দুল্লাহ তড়িঘড়ি করে টিভি উপস্থাপিকা জেনিসিয়া বর্ণা ও কারিগরি সতীর্থদের চাকরিচ্যুত করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই ঘটনায় সবচেয়ে ভালো স্ট্যান্ড নিয়েছেন সদ্য রিফর্ম করা জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ্। তিনি তাৎক্ষণিক তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেন, "এখন" টিভির সাংবাদিকদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে। আমরা এই দ্বিমত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যই আন্দোলন করেছিলাম। আপনার এই গালির স্বাধীনতার জন্যই আন্দোলন করেছিলাম। শুধু মত প্রকাশ নয়, দ্বিমত প্রকাশও অব্যাহত থাকুক।
'গালি' দেওয়ার প্রেক্ষিতে এখন টিভির তিনজন সাংবাদিককে বরখাস্ত করা হয়েছে। এই ঘটনায় আমি বিব্রত।
রাজনীতিবিদদের যাতে স্বাধীনভাবে সমালোচনা করা যায় সেই অধিকারের জন্যই আমরা আন্দোলন করেছি। এখনও করছি। আমাদের এই লড়াই একটা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার লড়াই যেখানে যেকোনো মানুষ রাজনীতিবিদদের উচিত বা অনুচিত সমালোচনা করতে পারবে। তবে প্রত্যাশা থাকবে সেটি হবে গঠনমূলক উপায়ে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় আমরা বদ্ধপরিকর, সেই মত আমার বিরুদ্ধে হলেও।'
মিস্টার হাসনাত আব্দুল্লাহ্'র সাথে আমরা সহমত।
বাংলাদেশের সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে। এটি বাংলাদেশের নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করে। তবে সেই মত যেন দেশ ও মানুষের অকল্যাণ উসকে না দেয়।
জেনিসিয়া যেটি করেছেন সেটি একেবারেই ঘরের কথা। নিজস্ব ফোরামে বলেছেন। এটি নিয়ে জাজমেন্টাল হলে ভুল বিচার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এটাও ঠিক ঘরের মধ্যেও আমাদেরকে ভব্যতা বজায় রেখেই কথা বলতে হবে। কথার খেসারত কীভাবে দিতে হবে সেটা বিগত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা দেখিয়ে গেছেন।
ফ্রিডম অব স্পিচ বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হল মৌলিক মানবাধিকার, যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার দেওয়া হয়, যেকোনো ভয় বা সরকারি নিপীড়ন ছাড়াই। এটি গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ এবং মানবাধিকার সনদ ও সংবিধানসমূহে স্বীকৃত একটি অধিকার।
ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস (UDHR), আর্টিকেল ১৯ -এ বলা আছে: "Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers." (প্রত্যেক মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মতামত রাখার অধিকার আছে; এই অধিকার অন্তর্ভুক্ত করে যে কেউ হস্তক্ষেপ ছাড়া মত পোষণ করতে পারবেন এবং যেকোনো মাধ্যমে ও সীমারেখার পরোয়া না করেই তথ্য ও ধারণা খুঁজতে, গ্রহণ করতে ও প্রকাশ করতে পারবেন।)
ইংরেজ লেখক, সাংবাদিক ও তাত্ত্বিক জর্জ ওরওয়েল (George Orwell) বলেছেন, "If liberty means anything at all, it means the right to tell people what they do not want to hear." (যদি স্বাধীনতার কোনো অর্থ থাকে, তবে সেটি হলো মানুষকে এমন কিছু বলার অধিকার যা তারা শুনতে চায় না।)
সুতরাং এখনকান্ডে হাসনাত আব্দুল্লাহ্'র স্ট্যান্ডটা একদম অ্যাপ্রোপ্রিয়েট আছে। রাজনীতিবিদরা সবসময় ভালো কথা শুনবেন এমন সুকর্ম কারো অভিধানেই থাকে না। জেনিসিয়া নিশ্চয়ই সতর্ক ও সচেতন হবেন। তবে সবার আগে তাঁর এবং তাঁর সতীর্থদের চাকরিতে বহাল করা জরুরি। অন্যথায় 'ফ্রিডম অব স্পিচ' তার চিরায়ত জরুরত হারাবে।
লেখক: সাংবাদিক
১৪ মার্চ ২০২৫