বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে যে, বাঙালি মুসলমানের মনস্তত্ত্ব শুধু ধর্মীয় আবেগ দ্বারা চালিত নয়, বরং এটি রাজনৈতিক কৌশল, প্রোপাগান্ডা ও আর্থসামাজিক বাস্তবতার জটিল মিশ্রণ। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিলিয়ন ডলারের ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ নিয়ে বিতর্ক, যেখানে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও মানুষের প্রতিক্রিয়া এসেছে সম্পূর্ণ উল্টো দিক থেকে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিগত সরকার যখন দাবি করেছিল যে এই প্রকল্প সৌদি আরবের দান করা অর্থে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তখন বেশিরভাগ মানুষ এটাকে সৌদি দান হিসেবেই দেখছিল। কিন্তু প্রেস সচিব শফিকুল আলম যখন সত্যটা প্রকাশ করলেন—এই মসজিদগুলোর পুরো ব্যয়ই বাংলাদেশের জনগণের করের টাকায় বহন করা হয়েছে—তখন তা নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠলো কৌতুককর। নেটিজেনরা দুর্নীতির প্রতিবাদ না করে বরং শেখ হাসিনার প্রতি প্রশংসা বর্ষণ করলো, যেন এটা তার এক মহান কীর্তি!
এই মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থের দিকে, যেখানে তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের দ্বৈততা। ছফা দেখিয়েছেন, বাঙালি মুসলমান তার আত্মপরিচয়ে দ্বিধাগ্রস্ত—সে আরব সংস্কৃতির অংশ হতে চায়, কিন্তু তার মাটির শেকড় উপড়ে ফেলে দিতে পারে না। ফলে, তার মনোজগতে তৈরি হয় একধরনের অস্পষ্ট বিভ্রম, যা তাকে যুক্তির বদলে আবেগনির্ভর করে তোলে।
কেন ধর্মীয় অনুভূতির কাছে দুর্নীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে? ৫৬০টি মডেল মসজিদের বিতর্কে আহমদ ছফার সেই পর্যবেক্ষণই যেন বাস্তবে প্রতিফলিত হলো। ছফা লিখেছিলেন—
"বাঙালি মুসলমানের রাজনীতি চেতনার সঙ্গে তার ধর্মচেতনার এক অদ্ভুত সম্পর্ক বিদ্যমান, যেখানে ক্ষমতার প্রশ্নটি ঈমানের প্রশ্নে পরিণত হয়।"
অর্থাৎ, যিনি ক্ষমতায় আছেন, তিনি যেন কোনো না কোনোভাবে ধর্মীয় সুরক্ষা দিচ্ছেন—এমন ভাবনা গেঁথে দেওয়া হয় জনমনে। শেখ হাসিনা যখন বলছেন, ‘আমি ইসলামের খেদমত করছি’, তখন কিছু মানুষ এটাকে গ্রহণ করছে নির্দ্বিধায়, কারণ তাদের কাছে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। এখানে দুর্নীতির বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, কারণ মসজিদ নির্মাণকে তারা ধর্মীয় কর্তব্য ও জাতীয় গর্ব হিসেবে দেখে। জনগণের অর্থ অপচয় হয়েছে, ব্যাপক কমিশনবাণিজ্য হয়েছে, টেন্ডারবাজি হয়েছে—এসব প্রশ্নের বদলে মানুষের প্রতিক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়—‘আমরা ভাবছিলাম সৌদির টাকায় হয়েছে, কিন্তু আসলে এটা আমাদের টাকায় হয়েছে! কী দারুণ ব্যাপার!’
এই মানসিকতা কীভাবে তৈরি হলো? এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি মনস্তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক কারণ—
১. রাষ্ট্রীয় প্রচারণার শক্তি:
বাংলাদেশে রাষ্ট্রশক্তি যখন কিছু প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তখন তা শুধু উন্নয়নমূলক প্রকল্প হিসেবে থাকে না; সেটাকে ধর্ম, জাতীয় গৌরব ও ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করে উপস্থাপন করা হয়। ‘মডেল মসজিদ’ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার এটিকে ইসলামের সেবার অংশ হিসেবে প্রচার করেছে, ফলে মানুষ এটাকে যুক্তিসিদ্ধ মনে করেছে।
২. মধ্যবিত্তের মানসিক নিরাপত্তার সংকট:
মডেল মসজিদের মতো প্রকল্প সাধারণ মানুষের মনে একধরনের মানসিক স্বস্তি দেয়, কারণ এটি ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আহমদ ছফা দেখিয়েছেন, বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় এখনো অসম্পূর্ণ, কারণ একদিকে তার ধর্মীয় শেকড়, অন্যদিকে আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব। ফলে, সে সহজেই এমন কিছুতে গর্ব অনুভব করে, যেখানে তার জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় আবেগ একসঙ্গে কাজ করে।
৩. দুর্নীতিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দুর্নীতি যেন এক অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ মনে করে, দুর্নীতি হবেই, কিন্তু তার বদলে যদি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, তাহলে সেটাকে মেনে নেওয়া যায়। এই মানসিকতার ফলে দুর্নীতির বিরোধিতা করার বদলে তারা গর্ববোধ করতে শুরু করে।
৪. ক্ষমতার ধর্মীয় বৈধতা:
আহমদ ছফা তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—
"বাঙালি মুসলমানের রাজনীতির মধ্যে একটা অলৌকিক বিশ্বাস কাজ করে। যে-ই ক্ষমতায় থাকে, তার প্রতি আল্লাহর রহমত আছে—এমন ধারণা জনসাধারণের মধ্যে প্রবল।"
এই ধারণার ফলে কতিপয় সাধারণ মানুষ ধরেই নিয়েছে, মসজিদ যেহেতু বানানো হয়েছে, তবে সেটা অবশ্যই ভালো উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, দুর্নীতির কথা মুখ্য নয়।
৫৬০টি মডেল মসজিদের বিতর্ক আমাদের দেখিয়ে দেয়, কীভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও ধর্মীয় আবেগ একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে। জনগণের করের টাকায় দুর্নীতি হয়েছে, কিন্তু একশ্রেণীর জনগণ সেটাকে শেখ হাসিনার এক অনন্য কীর্তি হিসেবে দেখছে—এটাই বাঙালি মুসলমানের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা।
আহমদ ছফা বলেছিলেন—
"বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস হলো আত্মপরিচয় খোঁজার ইতিহাস। সে কখনো মধ্যপ্রাচ্যের অনুসারী হতে চায়, কখনো নিজের সংস্কৃতিকে গর্বের সঙ্গে ধারণ করতে চায়। কিন্তু সে জানে না, সে কীভাবে দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য আনবে।"
এই আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়েই রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদ নির্মাণের নামে দুর্নীতি যখন গৌরবের বিষয় হয়ে ওঠে, তখন বুঝতে হবে, এই মনস্তত্ত্বের শেকড় খুব গভীরে। আহমদ ছফার লেখা তাই আজও প্রাসঙ্গিক—বাঙালি মুসলমান যুক্তির চেয়ে আবেগে বেশি বিশ্বাসী, এবং সেটাই তাকে শাসকদের জন্য বশংবদ ও আদর্শ প্রজা করে তোলে।
লেখক: সাংবাদিক
১৪ মার্চ ২০২৫