রাজনীতিতে টিকে থাকা এবং শক্তিশালী হওয়া কেবল একটি দলের জন্য নয়, বরং ব্যক্তিগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক ক্ষমতার কাঠামোতে প্রবেশ করতে হলে কেবল সংগঠনের কর্মী হওয়া যথেষ্ট নয়; বরং বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর দখল করা, এলিটদের মধ্যে অবস্থান তৈরি করা এবং মতাদর্শগত প্রভাব বিস্তার করাই মূল কৌশল হওয়া উচিত। এই প্রেক্ষাপটে, বিকল্প চিন্তার পরিসর তৈরি করে সেটিকে মূলধারার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চর্চার অংশ করে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম।
রাজনীতিতে সফল হওয়ার অন্যতম প্রধান উপাদান হলো বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর দখল করা। এটি করার জন্য বিকল্প সংবাদ মাধ্যম ও বিশ্লেষণধর্মী লেখালেখির চর্চা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ অন্যান্য প্রচলিত গণমাধ্যম মূলধারার চিন্তার ধারক হয়ে উঠেছে, যা রাজনীতির একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে নিয়ে আসে। তবে, যদি কেউ নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান তৈরি করতে চান, তাহলে তাকে প্রচলিত গণমাধ্যমের বাইরে গিয়ে এমন একটি পরিসর তৈরি করতে হবে, যা বিদ্যমান ধারার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে "আমার দেশ" পত্রিকার গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য।
"আমার দেশ" দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে একটি বিকল্প বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা তৈরি করেছে। এটি শুধু একটি সংবাদপত্র নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের পক্ষে জনমত গঠনের একটি প্ল্যাটফর্ম। প্রথম আলোর অবস্থানের বিপরীতে গিয়ে "আমার দেশ"-কে এলিট শ্রেণির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ, প্রথম আলো শুধু গণমানুষের মধ্যে নয়, বরং উচ্চবিত্ত, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি বড় অংশ, আমলাতন্ত্র ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মানুষদের মধ্যেও প্রভাব রাখে। যদি "আমার দেশ" বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে এবং এলিটদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তাহলে এটি শুধু একটি সংবাদপত্র থাকবে না, বরং এটি একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠবে।
এলিটদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উচ্চবিত্ত ও নীতিনির্ধারক শ্রেণির কাছে "আমার দেশ"-এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হলে একাধিক কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, সংবাদপত্রটির গবেষণাধর্মী ও বিশ্লেষণধর্মী লেখালেখির পরিমাণ বাড়াতে হবে, যাতে এটি কেবল একটি মতাদর্শিক পত্রিকা হিসেবে না থেকে বরং একটি তথ্যভিত্তিক ও গভীর বিশ্লেষণমূলক মিডিয়া হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, প্রথম আলো যেখানে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কলাম প্রকাশ করে, সেখানে "আমার দেশ"-কেও একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, নীতিনির্ধারক, সাবেক আমলা ও কূটনীতিকদের লেখালেখির জায়গা দিতে হবে। তৃতীয়ত, বিদেশি থিংক-ট্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সঙ্গে সংযোগ বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে, কারণ এলিটদের কাছে কোনো সংবাদমাধ্যম তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যখন এটি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হয়।
রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার জন্য শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যম যথেষ্ট নয়; বরং ইতিহাসের কৌশলী ব্যবহারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস মানে শুধু অতীতের ঘটনা নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি কৌশলগত হাতিয়ার। এ ক্ষেত্রে "জুলাই গণঅভ্যুত্থান" একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে। এটি একটি শক্তিশালী ঐতিহাসিক ঘটনা, যা সঠিকভাবে প্রচারিত হলে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিসরে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। ইতিহাসের পুনর্লিখন ও পাঠ্যবইয়ে জায়গা করে নেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের বইয়ে যদি সুকৌশলে কিছু নির্দিষ্ট বিষয় সংযোজন করা যায়, তাহলে নতুন প্রজন্ম স্বাভাবিকভাবেই সেই বয়ানের মধ্যে বড় হবে এবং এটি ভবিষ্যতের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে।
পাঠ্যবইয়ের কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করতে হলে একাধিক কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, গবেষণা ও একাডেমিক চর্চার মাধ্যমে নির্দিষ্ট ঘটনাগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে, যাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে এসব বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রস্তাবনা আনা যেতে পারে। তৃতীয়ত, বিদেশি গবেষকদের মাধ্যমে "জুলাই গণঅভ্যুত্থান"-এর ওপর গবেষণা করিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করতে হবে, কারণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকলে এটি সহজেই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে।
রাজনৈতিকভাবে এলিটদের মধ্যে প্রভাব তৈরি করতে হলে শুধু ইতিহাস নয়, বরং একাডেমিক ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অবস্থান নিশ্চিত করাও জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যদি বিকল্প মতাদর্শের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা যায়, তাহলে এটি দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুধু একাডেমিক চর্চার জন্যই নয়, বরং তারা গবেষণা, নীতিনির্ধারণী সংলাপ, এবং পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন, যা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যদি এই পুরো কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে এটি শুধুমাত্র দলীয় স্বার্থে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ব্যক্তি পর্যায়েও একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করা সম্ভব হবে। প্রথম আলো বা অন্যান্য প্রচলিত গণমাধ্যম যেখানে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিকে প্রভাবিত করে, সেখানে এর বিপরীতে একটি শক্তিশালী বিকল্প পরিসর তৈরি করতে পারলে ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করা সম্ভব হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক দখলদারিত্ব কেবল মতাদর্শের লড়াই নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের নেতৃত্বের ভিত্তি গড়ে তোলে। তাই শুধুমাত্র সংগঠনকে শক্তিশালী করার কৌশল নয়, বরং ব্যক্তিগতভাবে কিভাবে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করা যায়, সেটিই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রশিবিরের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এই আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের সদস্যরা তাদের সংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা কাজে লাগিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।