Posts

ফিকশন

কিছুটা আড়াল থাকা ভালো

March 19, 2025

সাজিদ রহমান

101
View

বেশ কয়েক দিন হলো। সন্ধ্যা হলে গিন্নি ছাদে যায়। কিছুক্ষণ হাটে। আমি তারাবির জন্য বের হই। আমার উপরে ওঠা হয় না। 

গতকাল কি যে মনে আসলো। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। দেখি গিন্নি হাটছে। আমাকে দেখে মিচকি হাসি দিয়ে সে তাঁর মত হাঁটতে থাকে। প্রত্যেকের নিজস্ব একটা হিসাব থাকে। হাঁটারও থাকে। মাঝপথে থেমে গেলে হয়ত ক্যালরি বার্নের হিসেব মিলবে না। 

এই বাড়িতে অনেক গাছ। আম কাঁঠাল আছে, জলপাই আছে, কৃষ্ণচূড়া আছে। আরও কিছু গাছ আছে, নাম জানি না। এদের অনেকগুলোই দুই তলার ছাদকে ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। 

আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদটা সুন্দর। আচ্ছা, এই চাঁদই কি সেই চাঁদ? সুকান্ত যে চাঁদ ঝলসানো রুটি মনে করে খেতে চেয়েছিল? নাকি 'চাঁদের সাথে তোমার তুলনা' না দেবার যে প্রতিজ্ঞা কবি করেছেন, আমি কি সেই চাঁদকে দেখছি? এমনও তো হতে পারে, চাঁদের সুন্দরী যমজ বোন আছে। হতে পারে সে খবর কেউ জানে না। এমন সুন্দর চাঁদ অনেক আগে একবার দেখেছিলাম। এক সন্ধ্যায় চাপাই থেকে রাজশাহী ফেরার পথে।

কিছুটা আঁধার থাকা ভালো 



রমজান মাসে ইলেক্ট্রিসিটি যায় না বললেই চলে। এটা জনগণের জন্য আরামের বিষয়, সরকারের জন্য স্বস্তির। কিন্তু ঐ মুহুর্তে মনে হচ্ছিলো, কিছু সময়ের জন্যে শহরটা আঁধারে ডুবে গেলে মন্দ হতোনা।এই সময় কবি Tamim ভাইয়ের কথা মনে আসে। 'কিছুটা অন্ধকার থাকা ভালো' নামে তাঁর একটা চমৎকার কবিতার বই আছে। তামিম ভাই কি এই অন্ধকারের কথা বলেছিলেন? জিজ্ঞেস করা হয়নি কখনও। 

ঐ সময় আমার আরও একজন মানুষ Sadra Amaniর কথা মনে আসে। সারেতে সাদরা আমার সহপাঠী ছিল। এখনও কদাচিৎ কথা বার্তা হয়। পিএইচডি করে ইউকেতে সেটেল্ড হয়েছে। 

সাদরা তেহরানের ছেলে। লাইব্রেরিতে এক সাথে পড়তে পড়তে অনেক আলাপ হত আমাদের মাঝে। একদিন সে আমাকে ইরানের এক মরুভূমি থেকে আকাশ দেখিয়েছিল। ছবিতে। মরুভূমির ঘুটঘুটে অন্ধকার বালিতে মাদুর পেতে আকাশ, আকাশের তারা ও চাঁদ দেখার আয়োজন। ঘন অন্ধকারে বসে আকাশ যে কি অদ্ভুত সুন্দর দেখায়, ছবি দেখে বুঝেছিলাম। বাস্তবে সেই সৌন্দর্য দেখলে যে কেউ জ্ঞান হারাতেও পারে। সাদরার কাছে শুনেছি, অনেক দেশ থেকে পর্যটকরা সেটা দেখতে যায়। 

অন্য একদিন লাইব্রেরিতে। মুখ থমথম অন্ধকার নিয়ে বসে আছে সাদরা। বিধ্বস্ত চেহারা, উষ্কখুষ্ক চুল, রাতে ঘুমাতে পারেনি, সাক্ষ্য দিচ্ছে তার চোখ। আগের দিনে শুনেছি, কাসেম সোলাইমানিকে বাগদাদ এয়ারপোর্টে হত্যা করেছে। ইরান দীর্ঘকাল ধরে মার্কিন বশ্যতা স্বীকার না করেই টিকে আছে। এরই চরম মূল্য দিতে হয়। এর সর্বশেষ সংযোজন কাসেম সোলাইমানি। আমি অবাক হই, সাদরার অবস্থা দেখে। আসলে সোলাইমানি ছিল ইরানের শৌর্যবীর্যের প্রতীক। মার্কিন হামলা, অর্থনৈতিক অবরোধের পরেও ইরানের প্রভাব বেড়ে যাচ্ছিল মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। সোলাইমানিকে ভয় পেয়েই মেরে ফেলেছে মার্কিনিরা। কয়েকদিন পরে ইরান পাল্টা হামলা চালায় মার্কিন স্থাপনায়। এরপর সাদরা কিছুটা শান্ত হয়ে আসে।     

কিন্তু এখানে সেই অবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে চাঁদের আলো এই শহরের মিথ্যে আলোর সাথে মিশে যায়। যেন দুধের সাথে ইচ্ছেমত পানি মিশিয়ে দিয়েছে এই শহরের মেয়র। কারণ অন্ধকারকে ভালোবাসার কে বা আছে! কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ, যদি তাঁর মধ্যে হঠাৎ কবি হতে ইচ্ছে করে, তাঁর কাছে আঁধার অনেক কাম্য হয়ে উঠতে পারে। কর্পোরেশনকে একজন কবি আর কয় টাকা ট্যাক্স দেয় যে তাঁর কথা শুনতে হবে! তাঁর কথা মত শহরটাকে আঁধারে চুবিয়ে রাখবে! 

গিন্নির ক্যালরির হিসেব মিলেছে হয়ত। সে নিচে নেমে গেছে। আমার হাতে মোবাইল আছে, এতক্ষণে টের পাই। হাতের মোবাইলই বুদ্ধি দেয়, আমি চাইলে চাঁদের সুন্দরী এই যমজ বোনের স্মৃতি ধরে রাখতে পারি। কথাটা মনে ধরে। চাঁদের ছবি তুলি। এত দূরের চাঁদের সুন্দরী যমজ বোনকে ঠিক জুতসই ভাবে তুলে আনা যায় না। 

এর মাঝে খেয়াল করি, গাছের আড়াল থেকে চাঁদকে দেখা যাচ্ছে। এক জায়গায় দাঁড়ালে গাছের আড়ালে হারিয়ে যায়, কিছুটা সরে গেলে গাছের ফাঁক গলে তাঁকে দেখা যায়। গাছের আড়াল থেকে ফোকাস ঠিক করি। বেশ কয়েকবার ক্লিক করি। কিছুটা আড়াল থাকায় বেশ ভালো ছবি আসে। 

হঠাৎ মনে হয় সুন্দরের একটা আড়াল লাগে। কিছুটা আড়ালে থাকে বলে অনেক জিনিসই ভালো লাগে। পুরাপুরি সামনে চলে আসলে সুন্দর জিনিসও পানসে হয়ে যেতে পারে। সেই জন্যেই হয়ত আড়ালের প্রতি আমাদের খুব ঝোঁক, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি এত এত টান। 

কিছুটা আড়াল থাকা ভালো।

Comments