পোস্টস

গল্প

এলানিসের দেয়াল

২১ মে ২০২৪

মিলু আমান

সারা বাড়ির দেয়াল জুড়ে আঁকিবুকি করা। যেন একটুও জায়গা খালি নেই, দেয়ালের রং যে কি ছিল তা এখন বোঝা মুশকিল। ঘরের ঠিক মাঝখানে ৭/৮ বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপরাধীর মত দেয়ালগুলো দেখছে, যদিও দেয়ালের এই আঁকিবুকির জন্য সে একাই দায়ী না!


এলানিসদের এই বাড়িটি অনেক পুরানো, মুক্তিযুদ্ধেরও আগের। এলানিসরা থাকে দোতালায়, এলানিসের দাদা যুদ্ধের পর বাড়ি দোতলা করেন। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, এলানিসের বাবা, তিন চাচা আর তিন ফুফুর বেড়ে ওঠা এই বাড়িতেই। আনন্দ-বেদনা নিয়ে অনেক স্মৃতি, অনেক গল্প এই বাড়িটি ঘিরে। আজ থাক সেসব গল্প, আজ শুধু অনেক অনেক বছর পর এলানিসের গল্পটিই শুনবো।
 

দেয়ালের এই আঁকিবুকির দায়ভার যেমন এলানিসের, তেমনি তার বাবা, চাচা আর ফুফুরও। এলানিসের চাচারা বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন অনেক আগেই। তিন ফুফুও বিয়ে করে ছেলে-মেয়ে আর সংসার নিয়ে এখন ব্যস্ত, তবে ঢাকায় থাকার সুবাদে সবসময়ই আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে। তেমনি আজ তিন ফুফুকে একসঙ্গে পেয়ে যায় এলানিস এবং সে তার অপরাধবোধের কথা তাদেরকে জানায়। তারাও ব্যাপারটি নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পরে। আসলেইতো সারা বাড়িময় আঁকিবুকি, কেমন দেখায়? এলানিসের আম্মুকে নিয়ে ফুফুরা চিন্তা করলো কি করা যায়। এমন কিছু একটা করতে হবে যা করলে এই দাগ থেকেও পরিত্রাণ পাওয়া যায় আবার এলানিসও আনন্দ পায়, তার অপরাধবোধটাও কেটে যায়।
 

পরদিন সকালে ফুফুরা একগাদা রং আর তুলি নিয়ে হাজির। দাদা-দাদুর ঘরে আঁকা হল লতাপাতা আর সুন্দর কিছু ফুলের ছবি। দাদু নিজেই ফুলগুলো আঁকছেন, দাদা তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন কিন্তু দাদুর মনমতো হচ্ছে না, আর শুধু ধমক খাচ্ছেন, তাই দেখে সবাই মুখটিপে হাসছে। লাউড স্পিকারে গান চলছে আর চলছে সকালসন্ধ্যা ওয়াল টু ওয়াল দাগ ঢাকার নানা কৌশল। ডাইনিং রুমের দেয়ালে আঁকা হল ফল-ফ্রুটের স্টিল পিকচার। ড্রয়িং রুমে আঁকা চলছে লাইফ সাইজের সব জন্তুজানোয়ার; বাগস বানি, টম এন্ড জেরি, লায়ন কিং আর কত কি। কোন কোনটা কার্টুন ক্যারেক্টার, কোনটা আবার মনগড়া। ছবি আঁকতে আঁকতে এলানিসের জামার হাতায় একটু রং লেগে যায়, সে ভয়ে ভয়ে মা’র দিকে তাকায়। মা একটা হাসি দিয়ে তার তুলি থেকে একটু রং ছিটকে দেয় এলানিসের দিকে, আর শুরু হয়ে যায় রঙ্গের যুদ্ধ! এ ওকে, আর সে তাকে, সবাই রঙ্গে মাখামাখি... এ সময়ই এলানিসের বাবা ফিরে অফিস থেকে। প্রথমে কিছুটা অবাক হয়ে গেল বটে, কিন্তু একটুপরই সেও একটা তুলি হাতে নিয়ে রঙ্গের যুদ্ধে লেগে পরে। এরপর বাবা চলে যায় সোজা এলানিসের ঘরে, আর আঁকতে শুরু করে দেয় বিশাল সাইজের একটা মিকিমাউস।
 

বাবা-মা’র ঘরের ফিনিশিং টাচ চলছে। ঘরের একদিকে সমুদ্র, সন্ধ্যাআকাশ, পূর্ণিমার চাঁদ আর তাঁরা। আরেক দিকে সবুজ ঘাস, নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর উজ্জল সূর্য। বাবা একমনে কাজ করে যাচ্ছে। এলানিস একটু ফ্রেশ হয়ে বাবার পাশে এসে বসেছে। বাবা খেয়াল করেনি, তার হাতের রং লাগানো তুলিটি বেখেয়ালে রাখতে গিয়ে এলানিসের জামায় আবারও রং লেগে যায়। বাবা বলে উঠলো, “ইস!” আর মা বললো, “আবার রঙের দাগ লাইলো! এইনা নতুন জামাটা পরলি?” এলানিস বলে উঠলো, “কিছু হবে না আম্মু, দাগ থেকেই তো আমরা সুন্দর সুন্দর কত কি এঁকে ফেললাম।” সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো।
 

সারা বাড়ির দেয়াল এখন আর আগের মত কদাকার লাগছে না। এলানিসের বাবা-চাচা-ফুফুরা প্রোফেসনালি কেউ আর্ট না শিখলেও মন্দ আঁকেনি, তার মা’ও কম যান না। বাড়িটিকে এখন বেশ প্রানবন্ত দেখাচ্ছে। এলানিসকে ঘিরে ধরল সবাই আর তাকে জড়িয়ে ধরে উপরের দিকে উঠিয়ে নিয়ে নাচতে লাগলো।