১৯৭৬ সাল, দেশ স্বাধীন হবার পাঁচ বছর হয়ে গেল। পুরান ঢাকার মোগলটুলীর একটা বিরাট বাড়ি, সেই বাড়িতে বসবাস করে সৈয়দ পরিবারের সদস্যবৃন্দ। আসলে বাড়িটা সৈয়দদের নয়, এই বাড়িটা ছিল এক হিন্দু জমিদারের। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় বাড়ির মালিক ঢাকা ছেড়ে কোলকাতায় পাড়ি জমান। আবার সেই সময় সৈয়দ পরিবারের সদস্যরা বরিশাল থেকে ঢাকায় চলে আসে। তখন পুরান ঢাকার এক সর্দার এর মারফতে তারা বাড়িটা পেয়ে যায় বাড়ির প্রধান কর্তা সৈয়দ হাফিজুর রহমান একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা, বয়স ৫৬, উচ্চতায় লম্বা, কাঁচা পাকা কোকড়া চুল,ঘন গোফ,বেশ সুদর্শন চেহারা,খুব সৎ এবং ধর্মপরায়ন একজন মানুষ। এলাকার মানুষেরা তাকে খুব মান্য গণ্য করেন। হাফিজ সাহেবের বাবা মা অনেক আগেই মারা গেছেন, তখন তার বয়স ২০ বছর। এক বড় বোন আর ছোট দুই ভাই, বড় বোনের বিয়ে পরে হাফিজ সাহেব দেন। ছোট ভাইদের মানুষ করতে গিয়ে তার আর বিয়ে করা হয়নি। মা,বাবার পর তিনি সবচেয়ে বেশি মানেন তার বড় বোন হালিমা বেগম আর দুলাভাই সিরাজুল আলম কে। হালিমা বেগমের বয়স ৬০ বছর, একজন গৃহিণী জমিদার বাড়ির মেয়ে হয়েও খুব সাধারন জীবনযাপন করেছেন, স্বামীর অল্প টাকার চাকরির ব্যপারে কখনও স্বামীকে কথা শোনাননি। কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের আর তিন ভাইদের মানুষ করেছেন। । হালিমা বেগমের স্বামী সিরাজুল আলম একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, তিনি ঢাকা কলেজ, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ,রাজশাহী কলেজ,এডওয়ার্ড কলেজ সহ বাংলাদেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন। তিনি ইতিহাসের শিক্ষক, রিটায়ার করেছেন ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে। সিরাজ সাহেবের বয়স ৬৫ বছর, একজন সাধারন এবং নীতিবান মানুষ। জীবনেও তিনি তার নীতির সাথে আপোষ করেননি, কঠিন সময়েও তিনি তার নীতির উপর অটল থেকেছেন। হাফিজ সাহেবের মেঝ ভাই সৈয়দ বদিউর রহমান, পেশায় একজন উকিল, বয়স ৫০ বছর, স্ত্রী শাহানা আর বড় মেয়ে নীলু, দুই ছেলে শহীদ আর মনসুর কে নিয়ে তার সংসার। একজন দক্ষ ও সৎ আইনজীবি হিসেবে তার সুনাম আছে। বদির স্ত্রী শাহানা শিক্ষিত, মার্জিত এবং ভদ্র স্বভাবের, সংসারটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলেছেন। সৈয়দ পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, পেশায় একজন ডাক্তার, স্ত্রী শারমিন আর দুই ছেলে সাজ্জাদ আর জহির কে নিয়ে তার সংসার। শারমিন একজন গৃহিণী, খুব বিচক্ষণ এবং মার্জিত মহিলা। দুই বউ সবসময় মিলে মিশে থাকে, তাদের মধ্যে কোনদিন দ্বন্দ হয়নি। পুরো সৈয়দ পরিবার মিলেমিশে থাকে। তারা যখন এই বাড়িতে ওঠে, আলম সর্দার বলেছিলো যে নীচের একটা ঘরে যাতে কেউ না ঢোকে। কিন্তু কেন ঢোকা যাবে না, তা কেউ জানতে পারেনি। রাত ৩টা, হালিমা বেগমের বড় ছেলে শাহেদ এর ঘুম ভেঙ্গে যায়, ভাবলো যে নীচে গিয়ে একটু পায়চারি করবে, নীচে যখন হাটছিলো সে লক্ষ করলো যে সেই রহস্যময় ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, শাহেদ ভাবলো এত রাতে কে কাঁদছে, দরজার ফুটো দেখলো এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ে, পরনে তার মসলিনের শাড়ী, মাথায় ঘোমটা দেয়া অঝোড় নয়নে কাঁদছে। শাহেদ দৌড়ে উপরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। শাহেদ খুব মেধাবী ছাত্র, দেখতেও সুদর্শন,সুঠাম দেহের অধিকারী, বয়স ১৯ বছর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়াশোনা করছে, খুব সাহসী কিন্তু এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেছে। পরদিন সকালে ফজরের নামাজের পরে শাহেদ হাফিজ সাহেবকে বললো মামা, রাতে নীচের একটা ঘর থেকে এক মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি, হাফিজ সাহেব বললো কার কান্নার আওয়াজ? শাহেদ বললো জানি না মামা, শুনে কেমন অস্বস্তি লাগছিলো। হাফিজ সাহেব চিন্তায় পড়ে গেল, শাহেদ পরে হাফিজ সাহেব এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্লাসে চলে গেল। কিছুক্ষন পর হালিমা বেগম দেখলো হাফিজ সাহেব কে জিজ্ঞেস করলো কী রে হাফিজ, তুই কী নিয়ে চিন্তা করছিস ? হাফিজ সাহেব বললো আপা, শাহেদ বলছিলো যে নীচের একটা ঘর থেকে সে এক মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছে, হালিমা বেগম আশ্চর্য হয়ে বললো কী বলিস! এ তো আসলেই চিন্তার বিষয়। এর মধ্যে এলো সিরাজ সাহেব, এসেই বললেন কী ব্যপার,কী নিয়ে আলাপ হচ্ছে? হাফিজ সাহেব বললেন দুলাভাই, শাহেদ নাকি নীচের ঘর থেকে একটা মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। , সিরাজ সাহেব বললো হায় আল্লাহ! এটা তুই কী বললি, আসলেই তো চিন্তা করার বিষয়। হাফিজ সাহেব নাস্তা করার সময় এই ব্যপারটা সবাইকে বললো, বদি বলে উঠলো কী বলেন ভাইজান, কার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছে শাহেদ? আমরা বাদে তো এত বড় বাড়িতে কেউ থাকে না, নিশ্চয়ই কেন রহস্য আছে। তখন মাহবুব বলে উঠলো না মেঝ ভাই, মনে হয় শাহেদ এর কোন ভ্রম হয়েছে। এই কথার মাঝখানে শাহানা বললো না মাহবুব,এটা তো শুনেছি হিন্দু জমিদারদের বাড়ি ছিলো সেই ১৫০-২০০ বছর পুরনো, মনে হয় জমিদারের বাঈজী বা রক্ষিতার ঘর ছিলো সেটা, এই জমিদারেরা তো ছিলো লম্পট আর ব্যভিচারী কোন না কোন পুরুষ সেই নারীর সাথে কোন অন্যায় করেছিলো বা তাকে হত্যাও করতে পারে সেই সময়ের জমিদার। শারমিন বললো তোমার কথায় যুক্তি আছে ভাবী, দেখি একবার রাতে আমি,তুমি,মীনু,আর বাকিরা গিয়ে দেখে আসবো ঘরের রহস্য টা কী? শাহানা বললো ঠিক আছে,তুই যখন বলছিস,আমরা গিয়ে দেখবো কী ব্যপার। শাহেদ বাড়ি ফিরুক, তারপর ওর সাথে আলাপ করবো। নাস্তা শেষ করে বদি আর মাহবুব কাজে চলে গেলো। হাফিজ সাহেব কিছুটা নিঃসঙ্গ, ভাই-বোন, ভাগ্না-ভাগ্নীদের দেখে রাখার জন্য তার আর বিয়ে করা হলো না। অবশ্য ছাত্র জীবনে এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলো , কিন্তু পরে সেই মেয়েটার বিয়ে অন্যখানে ঠিক হয়ে যায় , সেই প্রথম প্রেম ভূলতে না পেরে আর বিয়ে করেননি তিনি। তবে ভাই বোন, ভাগ্না-ভাগ্নী, ভাতিজা-ভাতিজীদের নিয়ে তার সময় খুব সুন্দর ভাবে কেটে যায়। এছাড়া তিনি একটা সাদা বেড়াল পোষেন যার নাম মিনি, হালিমা বেগমের বড় মেয়ে মিনু, বয়স ২২ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী, মেধাবী এবং স্পষ্টভাষী, ভদ্র এবং দেখতে খুব সুন্দর। মিনু সবার খুব আদরের। হালিমা বেগমের মেঝ ছেলে খালেদ ঢাকা কলেজের ছাত্র, বড় ভাই শাহেদের মত মেধাবী না হলেও একজন তুখোড় খেলোয়ার। দালিমা বেগমের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ফরিদ, ক্লাস ১০ এ পড়ে, মেধাবী ছাত্র এবং কিছুটা ডানপিটে স্বভাবের। বদিউর রহমানের বড় মেয়ে নীলু, বয়স ১৪ ক্লাস এইট এ পড়ে, সাহসী এবং সবার প্রিয়, নীলুর পরে শহীদ, ক্লাস সিক্স এ পড়ে যেমন চঞ্চল তেমন মেধাবী। বদিউর রহমানের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মনসুর, ক্লাস ফাইভে পড়ে সবার ছোট আর সবার আদরের। মাহবুবের দুই ছেলে জাফর আর সাজ্জাদ। জাফর আর শহীদ সমবয়সী এবং সাজ্জাদ আর মনসুর সমবয়সী। শাহেদের কথাটা নিয়ে চিন্তা করার পর হাফিজ সাহেব এর মনে পড়লো যখন তারা প্রথম এই বাড়িতে ওঠে তখন আলম সর্দার বলেছিলো নীচের সেই ঘরে কাউকে ঢুকতে দিতে না। এবার হাফিজ সাহেব চিন্তা করলো কেন আলম সর্দার ঐ ঘরটার ব্যপারে এমন কথা বলেছিলো। আজ আলম সর্দার বেঁচে নেই, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় পাক সেনারা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। যেহেতু আলম সর্দার নেই, ভাবলো অন্য কারও কাছে এই ব্যপারে জিজ্ঞেস করবে। সিরাজ সাহেব হাফিজ সাহেবের পাশে বসে বললো হাফিজ, তোর মনে আছে আলম সর্দার একবার বলেছিলো যে ঐ ঘরে কাউকে ঢুকতে দিতে না হাফিজ সাহেব বললো জ্বী দুলাভাই, মনে আছে। কেনো বলেছিলো তার রহস্য অতি শীঘ্রই উদঘাটন করতে হবে। সিরাজ সাহেব বললো কখন করবি? হাফিজ সাহেব বললো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করবো। রাত ১:৩০ টা, বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে। এর মধ্যে শাহানা বিছানা থেকে উঠলো, পাশে মাহবুবের ঘরের পেছনের জানালা থেকে শারমিন কে ডাকলো, শারমিন উঠে মিনু, শাহেদ,খালেদ,ফরিদ,নীলু,শহীদ,মনসুর, জাফর আর সাজ্জাদ কে ডাকলো। সবাই নীচে নেমে সেই রহস্যময় ঘরের দিকে এগুলো। শাহানা আর শারমিন ঘরের দরজার ফুটো দিয়ে দেখলো সেই মসলিন শাড়ী পরিহিতা সুন্দরী মেয়েটিকে, তখনও সে কাঁদছিলো। শাহানা শাহেদ কে বললো শাহেদ, তুই তো ঠিক বলেছিস, এ তো আসলেই কাঁদছে। কিন্তু সে কে সেটাই তো জানিনা। শাহেদ বললো মামী, তোমার ধারনা ঠিক হতে পারে সে নিশ্চয়ই জমিদার বাড়ির রক্ষিতা ছিলো। কিছুক্ষন পর তানপুরার সুর বেজে উঠলো, তারপর সেই মেয়েটির কন্ঠে গান শোনা যায়। এবার শারমিন কান পেতে দিলো দরজার সামনে, তানপুরা বাজিয়ে মেয়েটি গাইছিলো পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা আমার জীবনে শুধু আঁধারের রেখা। শারমিন মুগ্ধ হয়ে গান শুনছিলো, গান শেষ হবার পরে বললো যে যাই বলুক গানটা ভারি সুন্দর হয়েছে। শাহানা সবাইকে নিয়ে উপরে গিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। পরদিন সকালে নাস্তা শেষ খাবার সময় হাফিজ সাহেব বললো আজ দুলাভাই আর আমি পেনশন নিতে যাচ্ছি, বাড়ি ফেরার পথে হারুনের বাড়িতে গিয়ে ঐ ঘরের বিষয়ে আলাপ করবো। সিরাজ সাহেব বললো একবার তো আমাদেরকেও দেখতে হবে। হাফিজ সাহেব বললো তা ভূল বলেননি দুলাভাই, চলেন রাতে আপনি,আমি আর আপা গিয়ে ঐ ঘরটার রহস্য দেখে আসি। বদি বললো ভাইজান, মাহবুব আর আমিও দেখতে চাই। হাফিজ সাহেব বললো ঠিক আছে তোরাও থাকিস। সবার নাস্তা শেষ, হাফিজ সাহেব আর সিরাজ সাহেব নিজ নিজ ঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষন পর হাফিজ সাহেব বের হয়ে এলো ঘর থেকে, তার হাতে একটা কালো লাঠি, পরনে সাদা পাঞ্জাবী, ঢোলা পায়জামা, পাঞ্জাবীর ওপর একটা হাটু পর্যন্ত কালো আচকান আর মাথায় একটা সাদা কিস্তি টুপি। পাশ দিয়ে শারমিন হঁটে যাচ্ছিলো, দেখলো হাফিজ সাহেব কে, জিজ্ঞেস করলো ভাইজান কোথাও যাচ্ছেন? হাফিজ সাহেব বললো হ্যা বৌমা,দুলাভাইকে নিয়ে নিয়ে পেনশন তুলতে যাচ্ছি,তিন মাসের পেনশন বাকি, তোমার জন্য কিছু আনবো? শারমিন বললো না ভাইজান, আনতে হবে না। আপনি তো প্রায়ই আমাদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেন।এবার আপনার জন্য কিছু একটা কিনেন। হাফিজ সাহেব বললো আমার আর কী লাগবে, তাও টুকটাক কিনে নেবো। হাফিজ সাহেব হালিমা বেগমের ঘরে গিয়ে ডাক দিলো কই দুলাভাই! দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। সিরাজ সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে এলেন, তার পরনে সাদা কিস্তি টুপি, ঢোলা পায়জামা, সাদা পাঞ্জাবী, হাতে একটা বাদামী লাঠি, আর পাঞ্জাবীর ওপর একটা হাটু পর্যন্ত সাদা আচকান। দুজন একসাথে বের হলো। বের হবার আগে হাফিজ সাহেব ডাক দিলো বশির,বশির! বশির এ বাড়ির কাজের লোক, প্রায় ২০ বছর যাবত সৈয়দ পরিবারে কর্মরত। বাড়ি ফরিদপুর, বয়স ৫০ বছর। বাড়ির সবাই তাকে কখনও চাকরের মত দেখেনি, দেখেছে তাদের পরিবারের সদস্যের মত। হাফিজ সাহেবের দ্বরাজ কন্ঠের ডাক ভেসে ওঠার পর বশির ছুটে এলো, এসে বললো ভাইজান, আমারে ডাকছেন? সিরাজ সাহেব বললো হ্যা, আমরা পেনশন তুলতে যাচ্ছি। তোর কিছু লাগবে? বশির বললো না দুলাভাই, প্রায়ই তো আনেন তয় আমার লাইগা একটা শার্ট নিয়া আইসেন। ভালো কোন শার্ট নাই, সব ছিড়া গেছে। সিরাজ সাহেব বললো ঠিক আছে, তা নিয়ে আসবো। সব কথা সেরে তারা চলে গেলো পেনশন অফিসে। পেনশন অফিসে গেল, এক লোক তাদের ফাইল দেখলো, পুরো তিন মাসের পেনশন বাকি ছিল। হাফিজ সাহেবের পেনশন মাসে ৩০০ টাকা আর সিরাজ সাহেবের মাসে ২৫০ টাকা পেনশন, সর্বমোট হাফিজ সাহেব ৯০০ টাকা পেলেন আর সিরাজ সাহেব তুললেন ৭৫০ টাকা। শালা-দুলাভাই মিলে পরিবারের সবার জন্য কিছু না কিছু নিলো। শাহানা আর শারমিন খু্ব বই পড়তে পছন্দ করে, হাফিজ সাহেব ওদের জন্য নীহাররঞ্জন গুপ্তের দুইখানা বই কিনলো একটা উত্তরফাল্গুনী আর আরেকটা কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী। সিরাজ সাহেব তার তিন ছেলের জন্য প্যান্টপিস কিনলেন, স্ত্রীর জন্য একটা শাড়ী, মেয়ের জন্য সালোয়ার কামিজের কাপড়, হাফিজ সাহেব সব ভাগ্না আর ভাতিজাদের জন্য নিলেন প্যান্ট পিস আর সিরাজ সাহেব তার তিন ছেলে আর ভাতিজাদের জন্য আর বশিরের জন্য নিলেন শার্ট পিস। হাফিজ সাহেব তার দুই ভাইয়ের জন্য দুটো মানিব্যাগ কিনলো। পরে সিরাজ সাহেবকে বললো দুলাভাই, চলেন এক কাপ চা খাই। সিরাজ সাহেব বললো হ্যা, মন্দ হবে না। সিরাজ সাহেব তার দুই শালার জন্য দুটো দামি মানিব্যাগ কিনলো। তারপর দুই শালা-দুলাভাই মিলে মালাই চা খেলো। বাড়ি যাবার পর বশিরের কাছে সব জিনিস দিয়ে বললো এগুলো লুকিয়ে রাখ, আমি আসার পর এগুলো সবাইকে দেবো, আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। বশির বললো ঠিক আছে ভাইজান। পরে তারা হারুন সাহেবের বাসায় গেল, হারুন সাহেব হাফিজ সাহেবের বন্ধু, মোগলটুলীতেই থাকেন। হাফিজ সাহেবের সমবয়সী, পেশায় আইনজীবি। সৎ, ধর্মভীরু, এবং বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। সিরাজ সাহেব হাফিজ সাহেবকে বললো এতদিন পর হারুনের বাসায় যাচ্ছি, কিছু একটা কিনে নিয়ে যাই। হাফিজ সাহেব বললো ঠিক আছে, পাশের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নেই। মিষ্টি নিয়ে গেলো হারুন সাহেবের বাড়িতে। হাফিজ সাহেব দরজার কড়া নাড়লেন, দরজা খুললো হারুন সাহেবের স্ত্রী সালেহা বেগম। সিরাজ সাহেব বললো সালেহা, হারুন বাড়িতে আছে? সালেহা বেগম বললো জ্বী সিরাজ ভাই ও আছে। আপনারা বসেন আমি জহিরের আব্বাকে ডেকে দিচ্ছি। হারুন সাহেব বসার ঘরে এসে খুশি হয়ে বললো আরে হাফিজ, অনেকদিন পর। কেমন আছো, কেমন আছেন সিরাজ ভাই? সিরাজ সাহেব বললো আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি। হাফিজ সাহেব বললো হারুন, একটা জরুরী বিষয়ে তোমার কাছে এসেছি। ৪৭ সালে যখন আমরা এখানে আসি তখন আলম সর্দার বলেছিলো যে আমাদের বাড়ির নীচতলায় নাকি একটা ঘর আছে, সেই ঘরে কেউ যেন না যায়। একদিন আমার ভাগ্নের ঘুম ভেঙ্গে যায়, সে নীচে যখন পায়চারি করছিলো তখন দেখতে পায় সেই ঘর থেকে এক মেয়ের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পরে আমার ভাগ্না-ভাগ্নী, ভাতিজা-ভাতিজি আর দুই ভাইয়ের বউ একই দৃশ্য দেখে। একটু চিন্তায় আছি, আলম সর্দার থাকলে তাঁর কাছেই যেতাম কিন্তু সে তো নাই। তুমি কিছু জানো এই ব্যপারে। হারুন সাহেব বললো আমি জানি, আসলে এই ব্যপারটা অনেকেই জানে কিন্তু কেউ বলে নাই। আজ আমি তোমাদের বলছি, এই বাড়িটা প্রায় ১৫০-২০০ বছর আগের বাড়ি। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে তোমাদের ঐ বাড়িটা ছিল জমিদার প্রতাপ নারায়ন রায় চৌধুরীর বাড়ি, তাঁর ছেলে শশাঙ্ক নারায়ন রায় ঐ বাড়িরই এক বাঈজী চন্দ্রমুখীর প্রেমে পড়ে যায়, ওদের সম্পর্ক অনেকদিন চলছিলো। শশাঙ্ক চন্দ্রমুখীকে কথা দিয়েছিলো যে সে তাকে বিয়ে করবে, কিন্তু সে কোন কথা রাখে নাই। সেই দুঃখে চন্দ্রমুখীআত্মহত্যা করে, এই খবর জানাজানি হবার পর প্রতাপ নারায়ন রায় চৌধুরী আদেশ দেয় চন্দ্রমুখীরলাশটা দেয়ালের ভেতরে গেঁড়ে দিতে। পুরো কাহিনী শোনার পর হাফিজ সাহেব বললো সর্বনাশ! এই জমিদার গুলো তো আচ্ছা রকমের লম্পট ছিলো। আল্লাহর কাছে হাজার শুকুর যে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাহেবের মত নেতারা জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে অবদান রেখেছেন। সিরাজ সাহেব বললো ঠিক বলেছিস, না হলে এই লম্পটগুলো আজও সমাজে থাকতো। বেশ কিছুক্ষন গল্প করার পর হাফিজ সাহেব আর সিরাজ সাহেব হারুন সাহেবের বাড়ি থেকে চলে গেলো। যাবার পথে সিরাজ সাহেব এর হঠাৎ মনে হলো যে নীলু,শহীদ, মনসুর, জাফর আর সাজ্জাদ এর জন্য কিছু নেওয়া হয় নাই। হাফিজ সাহেব বললো আমরা তো বাচ্চাদের জন্য কিছু নিলাম না, চল কিছু একটা কিনি ওদের জন্য। হাফিজ সাহেব রাজি হয়ে গেলেন দোকানে, সিরাজ সাহেব বাচ্চাদের জন্য কয়েকটা বাকরখানি কিনলেন আর হাফিজ সাহেব বাচ্চাদের জন্য কয়েকটা লজেঞ্চুস কিনে আনলেন। বাড়ি ফেরার পর হাফিজ সাহেব সবাইকে ডাকলেন, সবাই হাজির হলো, সবাইকে সবার জিনিস তারা দিলো। যেদিন সিরাজ সাহেব আর হাফিজ সাহেব বাড়ির সবার জন্য জিনিস কিনে আনেন সেদিন বাড়িতে ঈদের আনন্দ হয়। বাড়িতে ভালো রান্না করা হয়। হাফিজ সাহেব দুই ভাইয়ের বউদের নিজের ছোটবোনের মত স্নেহ করে, ওদের হাতে যখন বই দেয়া হলো তখন শাহানা আর শারমিন খুশিতে আত্মহারা, বললো ভাইজান, এই বইটা ভাবছিলাম পড়বো, কিন্তু আপনার ভাইয়েরা সময় পায় নাই সেই জন্য পড়া হয়নি। এবার প্রাণ খুলে বইগুলো পড়বো। বদি বললো ভাইজান, আপনি কেন আমাদের জন্য কেনেন, নিজের জন্য অন্তত একটুয খরচ করুন। আপনারও তো শখ আছে। মাহবুব বললো মেঝ ভাই ঠিক বলেছে ভাইজান, আপনি তো সারাজীবন আমাদের জন্য করে গেলেন। নিজের জন্য কিছু একটা কেনেন। হাফিজ সাহেব বললো এই দুনিয়ায় এক তোরা বাদে আমার আর কে আছে। জানি আল্লাহ সব বান্দার আপন। কিন্তু আমার স্ত্রী নেই, সন্তান নেই, তোরাই তো এই দুনিয়ায় আমার ভাই, আমার সন্তান। তিন মাসের পেনশন পেয়েছি, সব টাকা ফুরিয়ে যায়নি, এখনও অনেক টাকা বাকি আছে। আমি তো আর তাজমহল বা কোহিনুর কিনে আনি নাই। এগুলো তো সামান্য জিনিস। শারমিনের চোখে পানি চলে এলো, বললো আল্লাহ যেন প্রতিটা ঘরে আপনার মত বড় ভাই পাঠায় যে পরিবারের প্রতি দ্বায়িত্বশীল, যে তার ভাই-বোনদের খুব ভালোবাসে। হাফিজ সাহেব হাসলেন, বশিরকে আদেশ দিলেন পোলাও আর কোরমা রান্না করতে। আজ সবাই খুব আনন্দ করলো। পরদিন সকালে শাহেদ সিরাজ সাহেবকে বললো আব্বা, ঐ ঘরের রহস্যের ব্যপারে কিছু জানতে পেরেছেন? সিরাজ সাহেব বললো হ্যা জানতে পারলাম, কিন্তু এখন যাছাই বাছাই করতে হবে। খালেদ এসে বললো জানেন আব্বা, ঐ ঘরের মেয়েটা খুব সুন্দর গায়, কিন্তু কেন জানি কাঁদে সারা রাত। ফরিদ এসে বললো মেঝ ভাই ঠিক বলেছে আব্বা, আমিও সেইদিন মামীদের সাথে ছিলাম। মীনু ঘর থেকে বের হয়ে এলো, সিরাজ সাহেব বললো কী রে মা মীনু, তুই এই সময় কই যাচ্ছিস? মীনু বললো ক্লাসে যাচ্ছি আব্বা । সিরাজ সাহেব বললো ভালো, শাহেদ তোর ক্লাস নেই? শাহেদ বললো আজ আর নেই, স্যার ছুটিতে গেছেন। কিছুক্ষন পর হঠাৎ হারুন সাহেব বাড়িতে এলো হাফিজ সাহেবের সাথে দেখা করতে। শাহানা দরজা খুলে সালাম দিয়ে বসতে বললো, শাহানা হাফিজ সাহেবকে ডাকলো ভাইজান, হারুন ভাই এসেছেন। হাফিজ সাহেব ঘর থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবী আর চেক লুঙ্গী। হারুন সাহেব কে দেখে বললো আরে হারুন, এ সময়ে হঠাৎ? হারুন সাহেব বললেন তোমাদের নীচতলার সেই রহস্যময়ী ঘরের আরেকটা কাহিণী আছে যা আমি বলতে ভূলে গেছি। লোকমুখে আরেকটি কাহিণীর প্রচলন আছে, সেটা হলো চন্দ্রমুখীকে শশাঙ্ক হত্যা করে, আর আরেকটা তো কালকেই বললাম। এই ঘটনার পর থেকেই ঐ ঘরের নাম হয় অভিশপ্ত কক্ষ। হাফিজ সাহেব বললো কোনটা যে সত্যি আল্লাহই জানে, রহস্যটা একবার উদঘাটন করবো। হাফিজ সাহেব আর হারুন সাহেবের কথোপকথনের সময় হালিমা বেগম সেখানে হাজির হন, হারুন সাহেব তাকে দেখে সালাম দিলো। হালিমা বেগম বললো কী হারুন মিয়া, অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয় না । কেমন আছো? হারুন সাহেব বললো আলহামদুলিল্লাহ, কয়েকদিন একটা জটিল মামলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই সময় হয়নি আপা। পরে বদি আর মাহবুব সেখানে হাজির হলো, বেশ কিছুক্ষন গল্প করার পর হারুন সাহেব, বদি মাহবুব একসাথে বিদায় নেয়। পরে রাতে খাবার শেষ করে হাফিজ সাহেব সবাইকে নিয়ে বসার ঘরে বসলেন, বসে বললেন ভাবছি আজ আপা,দুলাভাই আর আমি সেই রহস্যময় ঘরের ব্যপারটা দেখে আসবো। বশির তুইও থাকিস। বশির বললো না ভাইজান, আমার ডর করে। নীলু বললো না বশির চাচা, ভয় পাবেন না, আপনারা তো আর ঘরে যাচ্ছেন না খালি দরজার ফুটো দিয়ে দেখবেন। মাহবুব বললো আল্লাহই জানে আসলে ব্যপারটা কী, তাও একবার দেখে আসি। মীনু বললো মেয়েটাকে দেখে মনে হয়েছে খুব সুশীল, আদব কায়দা জানা। শারমিন বললো এমনই তো হবার কথা কারণ আগের দিনের বাঈজীরা খুব ভদ্র ছিলো, সুন্দর করে কথা বলতো আজকাল তো এমনটা নেই। মাহবুব বললো তা ভূল বলোনি শারমিন। পরে রাত ৩টা বেজে গেলো। সিরাজ সাহেব আর হালিমা বেগম হাফিজ সাহেব কে ডাকতে...