পোস্টস

গল্প

গানের সুরে জীবন

১১ জুন ২০২৪

বিরহ দাস

মূল লেখক বিরহ দাস

গানের সুরে জীবন

 

কলকাতার এক শান্ত পাড়ায় বাস করতো রিমা। ছোটবেলা থেকেই তার গান গাওয়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। তার মা-বাবা তাকে গান শেখার জন্য স্থানীয় সঙ্গীত শিক্ষকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তবে তাদের আর্থিক অবস্থার কারণে তার গানের শিক্ষা নিয়মিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। একদিন, রিমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাড়ির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। তখন থেকেই রিমা বুঝতে পারল যে তাকে কিছু করতে হবে। সে তার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম শুরু করলো।

রিমার শৈশব কেটেছে কলকাতার বুকে, যেখানে প্রতিদিন বিকেলে সে মায়ের হাত ধরে বাজারে যেত। বাজারে যাওয়ার পথে তাদের গলির মোড়ে বসে থাকতেন এক বৃদ্ধ ভিখারি, যিনি তার তবলা বাজিয়ে গান গাইতেন। সেই সুরেই রিমা প্রথমবারের মতো গান গাওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। একদিন, স্কুল থেকে ফেরার পথে রিমা লক্ষ্য করল যে সেই বৃদ্ধ ভিখারি গান গাওয়ার সময় হঠাৎ থেমে গেলেন। কৌতূহলী রিমা কাছে গিয়ে জানতে পারল যে তার তবলাটা ভেঙে গেছে। রিমা তার পকেটে থাকা ছোট্ট টাকার থলিতে থাকা সমস্ত টাকা সেই ভিখারিকে দিয়ে দিলো। বৃদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, “মা, তুমি অনেক বড় গায়িকা হবে একদিন। তোমার সুরই তোমার জীবন বদলাবে।”

সেই দিন থেকেই রিমার মনের কোণে একটা স্বপ্ন বাসা বাঁধলো—সে বড় হয়ে একজন প্রখ্যাত গায়িকা হবে। কিন্তু তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তার মা ছিলেন একজন সাধারণ গৃহিণী, আর বাবা একটি ছোট্ট চাকরি করতেন। তবুও তারা চেয়েছিলেন যে রিমা গান শিখুক। প্রথমবারের মতো যখন রিমার মা তাকে গান শেখানোর জন্য স্থানীয় সঙ্গীত শিক্ষকের কাছে নিয়ে গেলেন, রিমার আনন্দের সীমা ছিল না। সঙ্গীত শিক্ষকের নাম ছিল শ্রীমান মজুমদার। তিনি ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সঙ্গীত শিক্ষক, যিনি তার বাড়ির সামনের ছোট্ট ঘরে সঙ্গীত শিক্ষা দিতেন। রিমার প্রথম সঙ্গীত ক্লাসের দিনটি ছিল তার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন।

শিক্ষক মজুমদার তাকে প্রথমেই শিখিয়েছিলেন সুরের মাধুর্য এবং তাল-লয়ের গুরুত্ব। “গান হলো আত্মার ভাষা, যা সুরের মাধ্যমে প্রকাশ পায়,” তিনি বলেছিলেন। রিমা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনত এবং সুরে সুর মিলিয়ে গান গাইতে চেষ্টা করত। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাদের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। রিমার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং তার চাকরিটা চলে গেল। এখন বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল রিমার মায়ের উপর। রিমার সঙ্গীত শিক্ষাও বাধাগ্রস্ত হলো। তবুও রিমা হাল ছাড়েনি। সে বাড়িতে বসে সঙ্গীত চর্চা চালিয়ে যেতে লাগল।

রিমার পরিবারের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকায় সে নিজের শক্তি আর সাহসকে নতুনভাবে ঝালিয়ে নিতে লাগল। সে বুঝতে পারল যে তার গানই একমাত্র সম্বল যা দিয়ে সে তার পরিবারের এই কঠিন সময় পার করতে পারবে। একদিন, স্থানীয় এক রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পথে রিমা দেখল যে সেখানে গান গাওয়ার জন্য একজন গায়কের প্রয়োজন। রিমা সাহস করে রেস্টুরেন্টের মালিকের সাথে কথা বলল এবং তাকে গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। প্রথমে মালিক দ্বিধাগ্রস্ত হলেও রিমার আত্মবিশ্বাস দেখে তিনি রাজি হলেন।

রিমার প্রথম দিনের গান শুনে রেস্টুরেন্টের ক্রেতারা মুগ্ধ হলেন। তার কণ্ঠের মাধুর্য আর সুরের জাদু সবার মনে দাগ কাটল। সেই দিন থেকে রিমা প্রতি সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে গান গাইতে শুরু করল। তার গানের উপার্জন দিয়ে সে পরিবারের খরচ চালাতে লাগল। রিমার মা প্রথমে তার এই উদ্যোগে খুশি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন যে রিমা পড়াশোনায় মনোযোগ দিক। কিন্তু রিমার দৃঢ় সংকল্প আর মনের ইচ্ছা দেখে তিনি বাধা দেননি। রিমা দিনভর পড়াশোনা আর রাতে গান গাওয়া চালিয়ে গেল।

রিমার গানের খ্যাতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল। স্থানীয় মানুষজন তার গান শুনতে রেস্টুরেন্টে আসতে লাগলেন। একদিন রেস্টুরেন্টে গান গাওয়ার সময় রিমার সামনে এলেন এক ভিন্ন মানুষ। তার নাম ছিল অভিজিৎ সেন, যিনি একজন প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক। অভিজিৎ সেন রিমার গানের প্রতি মুগ্ধ হন এবং তাকে প্লেব্যাক গানের জন্য সুযোগ দেন। রিমার জীবন সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। সে গান গাওয়ার মাধ্যমে দ্রুত খ্যাতি অর্জন করে এবং তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে।

অভিজিৎ সেনের সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটি ছিল রিমার জন্য স্বপ্নের মতো। অভিজিৎ তাকে বললেন, “তোমার কণ্ঠে এমন এক মাধুর্য আছে যা মানুষকে মুগ্ধ করে দেয়। তুমি যদি রাজি থাকো, আমি তোমাকে একটি প্লেব্যাক গানের সুযোগ দিতে চাই।” রিমা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। সে ভাবল, “এ কি সত্যি? আমি কি সত্যিই প্লেব্যাক গানের সুযোগ পেতে যাচ্ছি?” অভিজিৎ তাকে আশ্বস্ত করলেন এবং তার সাথে স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন। সেখানে রিমা প্রথমবারের মতো একটি প্লেব্যাক গান রেকর্ড করল।

গানটি মুক্তি পাওয়ার পরেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল। রিমার কণ্ঠে গান শুনে সবার প্রশংসা পেল। তার পরিবারও খুশি হলো এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করল। রিমা এখন একজন প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে পরিচিতি পেতে লাগল। রিমার প্লেব্যাক গানের সাফল্য তাকে আরও প্রেরণা দিল। সে একের পর এক হিট গান উপহার দিতে লাগল। তার গানগুলি সিনেমার সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকল।

রিমার কণ্ঠের মাধুর্য এবং তার গানের বৈচিত্র্য মানুষকে মুগ্ধ করত। সে প্রতিটি গানে নতুন কিছু নিয়ে আসত। তার গানের ক্যারিয়ার আরও উন্নত করতে সে বিখ্যাত সঙ্গীতগুরু পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌধুরীর কাছ থেকে সঙ্গীত শেখা শুরু করল। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌধুরী একজন প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তার কাছ থেকে রিমা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খুঁটিনাটি শিখল। তিনি বলতেন, “গানের মাধুর্য তখনই প্রকৃত অর্থে প্রকাশ পায়, যখন তা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাধুর্যে মিশে যায়।” রিমা তার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত এবং সেভাবে গানের চর্চা করত।

রিমার সাফল্য এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার গান দেশ-বিদেশের মানুষ শোনে এবং প্রশংসা করে। রিমা এখন শুধু একজন গায়িকা নয়, বরং এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে। তার মা-বাবা এখন গর্বিত। তাদের মেয়ে যে এত বড় সাফল্য অর্জন করবে, তা তারা কখনো ভাবেননি। রিমা মাঝে মাঝে তার ছোটবেলার সেই রেস্টুরেন্টে যায় এবং সেখানে গান গায়। তার মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা, যখন সে এক সাধারণ গায়িকা ছিল।

রিমা এখন নতুন প্রজন্মের সঙ্গীতশিল্পীদের জন্য একটি সঙ্গীত একাডেমি খুলেছে। সেখানে সে নতুন গায়কদের সঙ্গীত শেখায় এবং তাদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়। রিমার বিশ্বাস, তার মত আরও অনেক তরুণ-তরুণী আছে যারা স্বপ্ন দেখছে এবং তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য পরিশ্রম করছে।

রিমা তার একাডেমিতে শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে থাকে, “কখনো হাল ছেড়ো না। তোমার স্বপ্নই তোমার পথ দেখাবে। সঠিক পরিশ্রম আর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তুমি সব কিছু অর্জন করতে পারবে।” তার শিক্ষার্থীরা তার কথা মনে রেখে সঙ্গীতের চর্চা করে এবং তার মতোই সফল হতে চায়।

এভাবেই রিমার সংগ্রামের কাহিনী, তার গানের প্রতি ভালোবাসা এবং সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছানোর গল্প আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। রিমা আমাদের শেখায় যে স্বপ্ন পূরণের পথে কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ় সংকল্পই সাফল্যের চাবিকাঠি।